বই পড়ুয়াদের সংগঠন
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
সপ্তাহে একটি বই, দুই মাসে বিশটি, চার মাসে পঞ্চাশটি- এভাবে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে আত্মপ্রকাশ করেছে ব্যতিক্রমী সংগঠন বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম। আর এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ দেশের স্বনামধন্য কয়েক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের একদল উদ্যমী শিক্ষার্থী। বাংলাদেশের অতীত পাঠ, বর্তমানকে ধারণ, অনুধাবন এবং বর্তমান সমস্যা পাঠ, সমাধান অনুসন্ধান ও ভবিষ্যতের দিকনির্দেশনা দেওয়ার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য নিয়ে কাজ শুরু করে ব্যতিক্রমী সংগঠন বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম। ২০১৪ সালের ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসকে কেন্দ্র করে প্রতিষ্ঠানটির যাত্রা শুরু হয়। বাংলাদেশ তৈরিতে বুদ্ধিজীবী ও জ্ঞানী-গুণী মানুষের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং ভবিষ্যতেও তাদের কৃতিত্ব ও গুরুত্বের কথা মাথায় রেখে এই সংগঠন তাদের কাজ করে যাচ্ছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, সরকারি তিতুমীর কলেজ, কবি নজরুল সরকারি কলেজসহ বেশ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একযোগে কাজ করছে বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম। এ ছাড়া বিডিএসএফের উন্মুক্ত পাবলিক লেকচারগুলোতে ঢাকার প্রায় সব পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী, শিক্ষকসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ ধারাবাহিকভাবে অংশ নিয়ে আসছেন।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী ডাকসু ভবনে এখন পর্যন্ত আশিটি পাবলিক লেকচার আয়োজন করেছে বিডিএসএফ। নব্বই মিনিটের পাবলিক লেকচারে একজন বক্তা তার নির্বাচিত বিষয়ের ওপর জ্ঞানগর্ভ আলোচনা করার জন্য সময় পান সর্বোচ্চ ৪০ মিনিট। বক্তার বক্তব্য শেষে উপস্থিত সবাই অংশ নেন।
বক্তার বক্তব্য এবং উপস্থিত অংশগ্রহণকারীরা মিলে একটি প্রাণবন্ত পরিবেশে জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় সাঁতার কাটেন বিডিএসএফের সদস্যরা। তারা এ দেশের ইতিহাস এবং শত শত বছরের সংস্কৃতির কথা মনে করিয়ে দেন উপস্থিত শ্রোতাদের। বিডিএসএফের সদস্যদের আত্মোন্নয়নের জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় চ্যাপ্টার প্রতি মঙ্গলবার আয়োজন করছে বুক টক ও আইডিয়া টক। চলতি সপ্তাহের পঠিত বই এবং সপ্তাহের সেরা আইডিয়াগুলো শেয়ার করা হয় সেখানে। এর ফলে বিডিএসএফ সদস্যরা প্রতিনিয়ত তাদের জ্ঞানভাণ্ডার সমৃদ্ধ করছেন।
এ ছাড়া প্রায় প্রতিদিনই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় লাইব্রেরির পাশে সংগঠনটির নিয়মিত আড্ডা বসে। আড্ডায় বিশ্ববিদ্যালয়ের তরুণ শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, লেখক, গবেষক, শিল্পীসহ অনেকে অংশগ্রহণ করেন। সারা দিন পঠিত বিষয় কিংবা মাথার ভেতরে কাজ করতে থাকা কোনো প্রশ্ন নিয়ে আড্ডা জমে, তর্ক ওঠে, আলোচনা এগোতে থাকে। মূলত ইতিহাসের বইসহ গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ পাঠের মাধ্যমের দেশের ইতিহাস এবং সংস্কৃতির দীর্ঘ ঐতিহ্য নিয়ে আলোচনার মাধ্যমে দেশ এবং দেশের সূর্যসন্তানদের কথা জানার চেষ্টা করেন সংগঠনটির সদস্যরা।
এ বছরের প্রথম দিকে বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম কাজ শুরু করে শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতি মাসে একটি বিশেষ লেকচারের সঙ্গে সঙ্গে প্রতি সপ্তাহে একটি সাপ্তাহিক আড্ডার আয়োজন করে যাচ্ছে সংগঠনটি। দুই মাস আগে কাজ শুরু করে সরকারি তিতুমীর কলেজ চ্যাপ্টার ছয়টি সাপ্তাহিক লেকচার আয়োজন করেছে। এ ছাড়াও কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয় ও চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে নিয়মিত সাপ্তাহিক ও মাসিক উন্মুক্ত আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের ছাত্র তানজির সরকার বলেন, ‘বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম (বিডিএসএফ) শুধু একটি সংগঠন নয়, একটি প্ল্যাটফর্ম। জ্ঞানপিপাসু সবার জন্য এর দ্বার উন্মুক্ত। পর্যাপ্ত তথ্য এবং জ্ঞান আহরণের মাধ্যমে আমরা বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে চাই। তার জন্য আমাদের অতীত ইতিহাস জানতে হবে। জানতে হবে আমাদের দীর্ঘ সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের কথা। তার জন্য ইতিহাসনির্ভর বই পাঠকে এ সংগঠন বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে আসছে। আমরা চাই বই পাঠের মাধ্যমে আমাদের প্রজন্ম তার জ্ঞানের ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করবে। যেন বাইরের পৃথিবীতে যুক্তি-তর্কের লড়াইয়ে আমরা কখনও পিছিয়ে না পড়ি।’
১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস ও বাংলাদেশ স্টাডি ফোরামের দ্বিতীয় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে একটি আন্তর্জাতিক কনফারেন্সের আয়োজন করা হয়। ২২-২৩ ডিসেম্বর আয়োজিত কনফারেন্সে ডজনখানেক দেশ থেকে প্রথিতযশা পণ্ডিতরা তাদের গবেষণাপত্র পেশ করেন। তাদের সঙ্গে অংশ নেন বাংলাদেশের শিক্ষক, গবেষক ও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থী মেহেদী কাউসার তাই মনে করেন, ‘বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম হচ্ছে সেই স্বপ্নবাজ মানুষদের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াস, যারা জ্ঞানভিত্তিক টেকসই পৃথিবী বিনির্মাণে অঙ্গীকারবদ্ধ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক সমাজ গঠনে সদা যুদ্ধরত।’
স্টাডি ফোরামের সদস্যদের আত্মোন্নয়নে বিভিন্ন স্টাডি প্রোগ্রাম হাতে নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে বিডিএসএফ। নতুন সদস্যরা প্রথমে আড্ডায় ও সাপ্তাহিক লেকচারে অংশগ্রহণের মাধ্যমে স্টাডি ফোরামের সঙ্গে যুক্ত হন। আড্ডায় অংশগ্রহণের ফলে তাদের মাথায় প্রশ্নের উদ্ভব ঘটে, জানার প্রতি আগ্রহ, জ্ঞানের প্রতি ভালোবাসা তৈরি হয়। এরপর সদস্যদের ‘সপ্তাহে একটি বই’ পড়ার প্রোগ্রামে যুক্ত করা হয়। সপ্তাহে একটি বই পড়তে অভ্যস্ত হয়ে পড়লে এবং জানার প্রতি আগ্রহ আরও তীব্র হয় যখন, তখন তাদেরকে দুই মাসে বিশটি বই পড়ার প্রোগ্রাম ‘টি- টুয়েন্টি’তে যুক্ত করা হয়! দুই মাসে বিশটি বই পড়ার চ্যালেঞ্জে যারা সফল হন তাদেরকে আরও দীর্ঘ ও দৃঢ় পাঠাভ্যাস তৈরির জন্য চার মাসে পঞ্চাশটি বই পড়ার প্রোগ্রাম ‘ওডিআই’-এ যোগ করা হয়। বাংলাদেশের জনপ্রিয় খেলা ক্রিকেট থেকে শব্দগুলো নেওয়া হয়েছে, যাতে সদস্যরা আনন্দের সঙ্গে পড়ার বিষয়টি গ্রহণ করতে পারে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আলিফ চৌধুরীর কাছে স্টাডি ফোরাম তাই ভালোলাগার আরেক নাম, ‘শত ব্যস্ততা এবং অন্তর্জালের প্রভাব দূরে সরিয়ে রেখে তরুণ সমাজের জন্য বই পাঠের একটি বড় মাধ্যম হয়ে উঠবে বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম এবং সে পথেই আমরা এগিয়ে যাচ্ছি।’
পড়াশোনায় বৈচিত্র্য আনা এবং প্রকৃতির সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনের জন্য বিডিএসএফ নিয়মিত বিভিন্ন স্টাডি ক্যাম্পের আয়োজন করে যাচ্ছে। প্রকৃতি থেকে শিখি_ এই স্লোগান সামনে রেখে গত ১২ নভেম্বর বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম মানিকগঞ্জের বালিয়াঢ়ি জমিদার বাড়ি ও টাঙ্গাইলের পাকুটিয়া জমিদার বাড়িতে একটি দিনব্যাপী স্টাডি ক্যাম্পের আয়োজন করে। বইয়ের জ্ঞানকে বাস্তব দুনিয়ার সঙ্গে মেশানো এবং প্রকৃতির কাছ থেকে তালিম নেওয়ার জন্য এ ক্যাম্পটি আয়োজন করা হয়েছিল। এ নিয়ে বিডিএসএফ ঢাবি চ্যাপ্টারের সাধারণ সম্পাদক রওনক জাহান বলেন, ‘প্রযুক্তির আসক্তিতে ডুবন্ত তরুণ প্রজন্মকে রক্ষা করার প্ল্যাটফর্মের নাম বাংলাদেশ স্টাডি ফোরাম। যার একমাত্র হাতিয়ার আনন্দদায়কভাবে জ্ঞান অন্বেষণ করা, কখনও তা বই পড়ার মাধ্যমে আবার কখনও ভ্রমণের মাধ্যমে। জ্ঞানচর্চা, জ্ঞান প্রচার এবং জ্ঞান উৎপাদনের মাধ্যমে আমাদের বাংলাদেশ হয়ে উঠবে একটি জ্ঞানভিত্তিক, সমতাভিত্তিক ও শান্তিপূর্ণ বাংলাদেশ।’