ফিজিকস অলিম্পিয়াডের সেরা তিন
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
২০–২১ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অনুষ্ঠিত হয় সপ্তম ডিবিবিএল বাংলাদেশ ফিজিকস অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্ব। বিজ্ঞানভিত্তিক বাংলাদেশের বৃহত্তম এ অলিম্পিয়াডে তিন ক্যাটাগরিতে প্রথম হওয়া কৃতী তিন শিক্ষার্থী ও তাদের কোচের কথা জানুন এই প্রতিবেদনে
অতনু দে
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজ, ‘এ’ ক্যাটাগরি
২১ জানুয়ারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট ভবন। মঞ্চে পুরস্কারের ঘোষণা চলছে। প্রতিটি ক্যাটাগরিতে ২০ জনকে পুরস্কার দেওয়া হবে। ঘোষক পুরস্কার ঘোষণা করছেন নিচের দিক থেকে। ২০তম পুরস্কার থেকে বলা শুরু করছেন। ফলাফলে নিজের নাম শোনার জন্য অপেক্ষা করছিল অতনু দে। ঘোষণা যত আগাচ্ছিল, বুকের ঢিবঢিব শব্দও বাড়ছিল ততটা। ঢাকা বিভাগের প্রতিযোগিতায় অতনু হয়েছিল ১৭তম। দ্বিতীয় পুরস্কার পর্যন্ত ঘোষণা হলো। নাম নেই। ধরেই নিয়েছিল, এবার পাওয়া হবে না। বিজয়ী হিসেবে নিজের নামটা শোনার পর বিশ্বাসই হচ্ছিল না। এক দৌড়ে মঞ্চে।
রাজউক উত্তরা মডেল কলেজের শিক্ষার্থী অতনু দে এখন নবম শ্রেণিতে। বিজ্ঞানের প্রতি ভালো লাগা শুরু হয় পঞ্চম শ্রেণি থেকে। মহাকর্ষ, অপেক্ষবাদ বরাবরই মুগ্ধ করে তাকে। সায়েন্স ফিকশন, এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্স পড়ে নিয়মিত। দুই বছর আগে সহপাঠী ফায়েজের কাছে শুনেছে ফিজিকস অলিম্পিয়াডের কথা। ওয়েবসাইট ঘেঁটে সিলেবাস দেখেছিল। গত বছর পরীক্ষা দেব দেব করেও দেওয়া হয়নি। এ বছর আর ভুল করেনি। ঢাকা বিভাগের প্রতিযোগিতায় সেরা ২০-এ স্থান পাওয়ায় নিজের আত্মবিশ্বাস বাড়ে। ফিজিকস অলিম্পিয়াডের প্রস্তুতি বাড়িয়ে দেয়। ফলাফল হিসেবে জাতীয় পর্বে এ ক্যাটাগরিতে প্রথম হয়।
ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নিতে উদ্বুদ্ধ করায় মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ অতনু। ‘তাঁরা বলতেন, প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়ার সুযোগ আছে। অংশ নাও। পুরস্কার পেলে ভালো। না পেলে অসুবিধা নেই। ’
অবসরে অতনু ফুটবল খেলে এবং পদার্থবিজ্ঞানের সমস্যার সমাধান করে। ভবিষ্যতে পদার্থবিজ্ঞানী হতে চায় সে।
ইরতিজা ইরাম
সেন্ট জোসেফ হায়ার সেকেন্ডারি স্কুল, ‘বি’ ক্যাটাগরি
ইরতিজা ইরাম আলাদা করে পদার্থবিজ্ঞানের জগতে ঢু মারে নবম শ্রেণিতে উঠে। অনেকের কাছে ফিজিকস জটিল মনে হলেও তার বেশ মজার লাগে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় একদিন ফিজিকসের শিক্ষক নিয়াজ ইসলাম ফিজিকস অলিম্পিয়াডের কথা জানান। গত বছর অলিম্পিয়াডের ঘোষণা দিলে পরীক্ষার জন্য রেজিস্ট্রেশন করে। ওয়েবসাইট থেকে সিলেবাস, নমুনা প্রশ্নসহ বিস্তারিত তথ্য নেয়। সাধারণত অলিম্পিয়াডে একটু ভেতর থেকে প্রশ্ন করা হয়। তাই নিজের প্রস্তুতি ভালো করতে ওয়াকারের ফান্ডামেন্টাল অব ফিজিকস এবং বিভিন্ন ই-বুক পড়া শুরু করে ইরতিজা। সাফল্যও আসে। গত বছর অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্যায়ে ‘বি’ ক্যাটাগরিতে তৃতীয় হয়। গতবার প্রথম হতে না পারলেও সফল এ বছর। ‘আমি পড়াশোনার পাশাপাশি নিয়মিত ফিজিকস পড়ি। বিভিন্ন সমস্যা সমাধান করি। অনেকের কাছে ফিজিকস দুর্বোধ্য, কিন্তু আমার বেশ ভালো লাগে। আমাকে আরো অনেক দূর যেতে হবে। আন্তর্জাতিক ও এশিয়ান ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়ে দেশকে অ্যাওয়ার্ড উপহার দিতে চাই।’ বলল ইরতিজা। ঝুলিতে রয়েছে আরো কিছু পুরস্কার। অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব সাউথ ওয়েল আয়োজিত বিজ্ঞান ও গণিতের অ্যাসেসমেন্ট টেস্টে চার বছর স্বর্ণপদক জেতে ইরতিজা। গত নভেম্বরে ভারতের লক্ষ্ণৌতে আয়োজিত ম্যাথ কুইজে তার দল দ্বিতীয় হয়। গত বছর ন্যাশনাল বায়োকেমিস্ট্রি অলিম্পিয়াডে হয় দ্বিতীয়। এ বছর এসএসসি পরীক্ষা দিচ্ছে ইরতিজা ইরাম। অবসরে বই পড়ে ও টিভি দেখে। সে-ও পদার্থবিজ্ঞানী হতে চায়।
এস এম জুহাইর জাওহার জাকি
রাজশাহী কলেজ, ‘সি’ ক্যাটাগরি
এস এম জুহাইর জাওহার জাকি পড়ছে রাজশাহী কলেজে দ্বাদশ বর্ষে। তার ভালো লাগে ফিজিকস ও গণিত। দুটি বিষয়েই অলিম্পিয়াডে অংশ নেয় প্রতিবছর। বিভাগীয় পর্ব উতরে জাতীয় পর্যায়েও অংশ নেয়। ফলাফলে দেখা যায়, গণিতের চেয়ে পদার্থবিজ্ঞানেই বেশি ভালো করে। ‘দুটি অলিম্পিয়াডের জাতীয় পর্বে অংশ নিলেও ফিজিকসে আমি সব সময় ভালো করি। তাই গত বছর থেকে ফিজিকসকে বেশি গুরুত্ব দিচ্ছি। ’
এ বছর ‘সি’ ক্যাটাগরিতে প্রথম হওয়া জাকি ফিজিকসের প্রতি আকৃষ্ট হয় অষ্টম শ্রেণিতে পড়ার সময়। ইলেকট্রনিকস তাকে বেশ টানে। নবম শ্রেণিতে পড়ার সময় প্রথম ফিজিকস অলিম্পিয়াডের কথা শোনে। গত বছর প্রথম অংশ নিয়ে প্রথমবারই সাফল্য পায়। জাতীয় পর্বে পুরস্কার পেয়ে এশিয়ান ফিজিকস অলিম্পিয়াডেও অংশ নেয়।
প্রস্তুতি সম্পর্কে জাকি বলে, ‘ফিজিকস অলিম্পিয়াডে সব সময় উচ্চতর পর্যায়ের ফিজিকস পড়তে হয়। আমি পাঠ্য বইয়ের পাশাপাশি হেলেডি-ক্রেন-রেসলিকে ফান্ডামেন্টাল অব ফিজিকস বই পড়ে থাকি। পরীক্ষার সময় ছাড়া বাকি সময়ও কমবেশি পড়ি। এর বাইরে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করাটাও জরুরি। ’
নিজের সাফল্যের পেছনে মা-বাবা এবং গত বছর সুইজারল্যান্ডে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডে ব্রোঞ্জজয়ী ফাহিম তাজওয়ারের সহযোগিতা ছিল বলে জানায় জাকি।
ফিজিকসের পাশাপাশি গণিত ও প্রগ্রামিংয়েও দক্ষতা আছে তার। এ বছর গণিত অলিম্পিয়াডে রাজশাহী বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে জাতীয় পর্বে অংশ নেবে। ২০১৪ সালে ন্যাশনাল সায়েন্স অলিম্পিয়াডে পদক জিতেছে। সি এবং সি++ প্রগ্রামিং জানে সে। সিনেমা দেখে কাটে অবসর। ভবিষ্যতে প্রকৌশল নিয়ে পড়তে চায় সে।
ড. এম আরশাদ মোমেন
কোচ, বাংলাদেশ ফিজিকস অলিম্পিয়াড
ফিজিকস অলিম্পিয়াডের কৃতী শিক্ষার্থীরা প্রতিবছর বিশ্বের স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে স্কলারশিপসহ পড়ার সুযোগ পায়। বাংলাদেশে এর অংশগ্রহণকারী বাড়ছে। এ বছর তিন ক্যাটাগরিতে সারা দেশে ১০ হাজারের বেশি শিক্ষার্থী অংশ নিয়েছে। অলিম্পিয়াডে ভালো করতে চাইলে শ্রেণির তুলনায় উচ্চতর ফিজিকস পড়তে হবে। যেমন নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা তাদের পাঠ্য বইয়ের ফিজিকস পড়া হলে একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির বই পড়তে পারে। বিগত বছরগুলোর জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াডের প্রশ্ন সমাধান করলে প্রশ্ন সম্পর্কে ধারণা পাওয়া যাবে। আত্মবিশ্বাসও বাড়বে।
রেজিস্ট্রেশন : অক্টোবরে ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের জন্য বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। http://bdpho.org/ ওয়েবসাইটে প্রতিযোগিতা হয়। ক্যাটাগরি তিনটি। সপ্তম-অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এ ক্যাটাগরি, নবম-দশম শ্রেণির বি ক্যাটাগরি এবং একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণির শিক্ষার্থীরা সি ক্যাটাগরিতে। ডিসেম্বরে আঞ্চলিক পর্ব এবং জানুয়ারিতে জাতীয় পর্ব। আঞ্চলিক পর্বে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে ২০ জনকে পুরস্কৃত করা হয়। তারাই জাতীয় পর্বে যায়। জাতীয় পর্বে প্রতিটি ক্যাটাগরিতে ২০ জন করে ৬০ জন পুরস্কার পায়। বি এবং সি ক্যাটাগরির বিজয়ীদের নিয়ে ন্যাশনাল ক্যাম্প অনুষ্ঠিত হয়। সেখান থেকে পাঁচজন আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াড এবং আটজন এশিয়ান ফিজিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নেওয়ার সুযোগ পায়। সাধারণত এপ্রিলে এশিয়ান ফিজিকস অলিম্পিয়াড এবং জুলাইয়ে আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াড হয় । এ বছর রাশিয়ার সাইবেরিয়ায় এশিয়ান ফিজিকস অলিম্পিয়াড ও ইন্দোনেশিয়ায় আন্তর্জাতিক ফিজিকস অলিম্পিয়াড অনুষ্ঠিত হবে।