এই সময়ের তরুণ লেখকেরা
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
সময়টা এখন প্রতিযোগিতার। স্কুলজীবন থেকেই শুরু হয় ক্যারিয়ার ভাবনা। অভিভাবক, স্বজনেরা কানের কাছে মন্ত্র পড়েন, ‘ডাক্তার হও, প্রকৌশলী হও, বড় ব্যবসায়ী হও…।’ প্রচলিত ধারা থেকে বেরিয়ে এসে লেখক হওয়ার স্বপ্ন কি তরুণেরা দেখেন? প্রতিবছর বইমেলায় প্রকাশিত হয় বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া অনেক শিক্ষার্থীর লেখা বই। তাঁরা কি আদতে ‘লেখক’ হতে চান?
সাহিত্যচর্চা কোনো খণ্ডকালীন কাজ নয়—বলেছেন সব্যসাচী লেখক সৈয়দ শামসুল হক। সেই কথাটিই আরও জোর দিয়ে বলেছেন কবি হেলাল হাফিজ। তিনি সাহিত্যচর্চাকে ‘সার্বক্ষণিক কাজ’ বলেছেন তাঁর এক সাক্ষাৎকারে। তাঁদের কথার সঙ্গে এই সময়ের তরুণ লেখকদের মিল খোঁজা যেতে পারে। নাবীল অনুসূর্যর কথাই ধরা যাক। শুধু লেখালেখির জন্যই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএতে পড়ার সুযোগ ছেড়ে বাংলায় ভর্তি হয়েছেন। স্নাতকোত্তরপড়ুয়া এই তরুণ নিয়মিত লেখেন। এ বিষয়ে নাবীলের বক্তব্য সোজাসাপ্টা, ‘আমি যেটা করে আনন্দ পাই, সেটাই করি। আনন্দ পাই না বলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাকাউন্টিং অ্যান্ড ইনফরমেশন সিস্টেমসে সুযোগ পেয়েও পড়িনি। পরের বছর আবার পরীক্ষা দিয়ে বাংলায় ভর্তি হয়েছি।’ এবার বই মেলায় আসা পৌরাণিক বাগধারাসহ তাঁর লেখা বইয়ের সংখ্যা ৪।
নাবীলের মতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের আরেক শিক্ষার্থী সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টি, বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের দীপ্ত আকাশ রায় বা শাদমান সাকিব সায়েম, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের আহমেদ পিনাক, নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুহী আহমেদ সুসান, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সৈয়দ নাজমুস সাকিবসহ অনেকই আছেন, যাঁদের বই এবারের অমর একুশে গ্রন্থমেলায় এসেছে। কেউ লিখছেন নিজের গল্পটা অন্যকে জানানোর তাগিদে। কেউ লিখছেন ‘ভালো লাগা’র খোঁজে। কেউ আবার গল্প-উপন্যাস নয়, নিজের পছন্দের বিষয়টা নিয়ে একটা কিছু লিখতে চান। দীপ্ত আকাশ রায়ের যেমন বিজ্ঞান নিয়ে লেখার আগ্রহ। ‘বাংলায় বিজ্ঞানের বই অনেক কম বলেই আমরা অনলাইনে বিজ্ঞান স্কুল করেছি।’ লেখালেখির সঙ্গে কিন্তু এই তরুণের সখ্যটা আরও পুরোনো। দীপ্ত ও তাঁর বন্ধুরা উচ্চমাধ্যমিকে পড়ার সময়ই ময়মনসিংহ শহরে বসে বিজ্ঞান নিয়ে অনলাইন ম্যাগাজিন করেছেন। ‘সে সময় আমাদের সহযোগিতা করেছেন বুয়েটের বড় ভাইয়েরা। আর এখন নিজেরাই এটার তত্ত্বাবধান করছি।’ বলছিলেন তিনি। তিনি জানান, তিনজন মিলে লিখেছেন ‘জ্যামিতি: লক্ষ্য যখন অলিম্পিয়াড ১’। বাকি দুজন হলেন দিপু সরকার ও প্রীতম কুমার মণ্ডল।
দীপ্তদের মতো শাদমান সাকিব সায়েম, মুহাইমেনুল মারুফ, জি এম জুনায়েদ কামাল, মোহাম্মদ শাহরিয়ার—এ চারজন মিলেও বই লিখেছেন, নাম শৈশব কৈশোরে গণিতের মুখোমুখি। তাঁদের লক্ষ্য ছোটদের কাছে গণিতকে জনপ্রিয় করে তোলা, গণিতভীতি দূর করা।
একজন বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া শিক্ষার্থীর লেখা কয়টা বই থাকতে পারে? পাঠক, প্রশ্নটা আপনাকেই করছি। একটু ভেবে নিয়ে হয়তো বলবেন, ‘বড়জোর তিন-চারটা?’ জেনে নিন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী সাদিয়া ইসলাম বৃষ্টির লেখা প্রকাশিত বইয়ে সংখ্যা ১১। এই বইমেলাতে বই এসেছে চারটি। এত লেখার অনুপ্রেরণা পান কোথা থেকে? এমন প্রশ্নে একটি গল্প শোনালেন বৃষ্টি। ‘দুদিন আগের কথা, সেদিন মেলায় হাঁটছি। এক পাঠকের হাতে আমার বই দেখে নিজ আগ্রহেই তাঁর সঙ্গে কুশল বিনিময় করতে গেলাম। ভেবেছিলাম তিনি আমাকে চিনতে পারবেন। উল্টো প্রশ্ন করে বসলেন আমি তাঁকে চিনি কি না? এই পাঠকেরাই আমার লেখার প্রেরণা।’ বলেন বৃষ্টি।
এবারই প্রথম বই প্রকাশিত হয়েছে নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সুহী আহমেদ সুসানের। বই বেরিয়েছে প্রথম, তবে লেখালেখির জন্য পুরস্কার পেয়েছেন স্কুলে পড়ার সময়ই। ‘ঐতিহ্য-গোল্লাছুট পুরস্কার’ পেয়েছেন ২০০৮ সালে। এরপর ২০১০ সালে প্রথম আলোর শনিবারের ক্রোড়পত্র ‘ছুটির দিনে’তে ভালোবাসার অণুগল্প লিখেও পেয়েছিলেন প্রথম পুরস্কার। বাবার সরকারি চাকরির সুবাদে বিভিন্ন জেলায় ঘুরে বেরিয়েছেন। যতগুলো স্কুল বদলেছেন, ততজন বন্ধু তাঁর নেই। সুহীর ভাষ্য, ‘স্কুল টু বাসা, এই ছিল আমার দৌড়।’ একটু অন্তর্মুখী সুহী সব সময় খুব আগ্রহ নিয়ে দেখেছেন চারপাশের নানা কিছিমের মানুষ। এই অদ্ভুত মানুষগুলোই তাঁর লেখার উৎস।
সুহী একা থাকতেন বলে লিখতেন, আর ওদিকে আহমেদ পিনাক লেখার জন্যই একা থাকতে চান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের এই শিক্ষার্থীর এবারের বই মেলায় এসেছে উপন্যাস যদিও কুয়াশা। লেখার জন্য মাঝেমধ্যেই ঘর থেকে বেরিয়ে পড়েন তিনি।
সিনেমাপাগল আরেক লেখকের কথা বলা যাক। সৈয়দ নাজমুস সাকিব। পড়াশোনা করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যে। লেখাজোখা সব সিনেমাকেন্দ্রিক। এবারের বইমেলায় তাঁর বই সিনেম্যান। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা শুরুর পর থেকেই সিনেমাবিষয়ক বিভিন্ন ম্যাগাজিন বা অনলাইনে নিয়মিত লিখছেন। সব বাদ দিয়ে শুধু সিনেমা কেন? এমন প্রশ্নে সাকিবের উত্তর ‘সিনেমা নিয়ে লিখে বেশ আরাম পাই। তাই লিখি।’ প্রায় প্রতিদিন জাহাঙ্গীরনগর ক্যাম্পাস থেকে বাসে চড়ে বইমেলায় চলে আসেন সাকিব। প্রথম বইয়ের রোমাঞ্চ বলে কথা!
কবি হেলাল হাফিজের কথায় আবার ফেরা যাক। ‘সার্বক্ষণিক কাজ’-এ কে কেমন সময় ব্যয় করছেন? দীপ্ত বলেন, গণিত অলিম্পিয়াডের জন্য প্রয়োজনীয় সব বিষয়ের ওপর বই লেখার কাজ চলছে। গণিতের পাশাপাশি, পদার্থবিজ্ঞান, জীববিজ্ঞান ইত্যাদি অলিম্পিয়াড নিয়ে লিখছেন তিনি, যার ফল হয়তো আগামী বইমেলায় দৃশ্যমান হতে পারে। জানা গেল, পড়াশোনার বাইরে বাকি সময়টা লেখালেখি করেই কাটে বৃষ্টির। আহমেদ পিনাকেরও তাই। চট্টগ্রামের বিভিন্ন লিটল ম্যাগাজিনে নিয়মিত লেখেন তিনি। পৌরাণিক বাগধারা নিয়ে ব্যস্ত থাকায় এবার ছোটদের জন্য লেখা গল্পের বইটির কাজ শেষ হয়নি নাবীল অনুসূর্যের। মেলার পরই এ কাজটিতে আবার হাত দেবেন তিনি। তাঁরা প্রত্যেকেই চান, লেখালেখির সঙ্গে থাকতে। আর বিশ্বাস করেন, তাঁদের লেখাগুলোই অন্যের মাঝে নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবে।