ব্র্যাকাথনবিজয়ী চার অগ্নিযোদ্ধা
- মারুফ ইসলাম
আগুন লাগার মতো প্রাণঘাতী দুর্ঘটনা দেশে অহরহই ঘটছে। কি গার্মেন্টস, কি শিল্পকারখানা, কি বাসাবাড়ি, কি বস্তি-প্রায় সবখানেই কোনো না কোনো দিন আগুন লাগছেই। রাস্তায় বেরোলেই প্রায় দিনই চোখে পড়ে তীব্র হুইসেল বাজিয়ে ছুটে চলেছে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি। কিন্তু যতক্ষণে গাড়ি পৌছায় অকুস্থলে, ততক্ষণে ক্ষয়ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই যায়!
এর কি কোনো সমাধান নেই? ভাবতে বাসলেন চার বন্ধু সাবরিনা রশিদ সেওঁতি, কিঞ্জল বড়ুয়া, এস এম রাইয়ান আকাশ ও রাফিদ উল ইসলাম। ভেবে ভেবে তারা একটি মোবাইল অ্যাপস উদ্ভাবন করলেন যার নাম ‘ফায়ারকম’। আর এই ফায়ারকম দিয়েই বাজিমাত করলেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে (বুয়েট) পড়ুয়া এই চার বন্ধু।
কী সেই বাজিমাত? সে গল্প শুনতেই একদিন পা রাখি বুয়েটের বান্দায়। অডিটোরিয়ামের সামনের খোলা মাঠে অড্ডাটা জমে ওঠে বেশ।‘একদিন ফেসবুকে দেখতে পাই সামাজিক সমস্যা সমাধানের আইডিয়া আহ্বান করেছে ব্র্যাক। প্রতিযোগিতার নাম ব্র্যাকাথন। বন্ধুদের বলি, ‘আমাদের ফায়ারকম আইডিয়া এখানে জমা দেয়া যেতে পারে।’ শুরুর গল্প বলছিলেন তড়িৎ কৌশল বিভাগের শিক্ষার্থী কিঞ্জল বড়ুয়া। তাকে থামিয়ে দিয়ে বলতে শুরু করেন দলপতি সাবরিনা সেওঁতি, ‘ফায়ার রেসপন্স বিভাগে আইডিয়া জমা দেই আমরা এবং কি অবিশ্বাস্য, চ্যাম্পিয়ন শিরোপা অর্জন করি!’
এরপর দলের আরেক সদস্য রাইয়ান জানান, পুরস্কার হিসেবে তারা পেয়েছেন ৫ হাজার মার্কিন ডলার, টাকার অঙ্কে যা দাঁড়ায় প্রায় ৪ লাখ টাকা।
এত টাকা দিয়ে কী করবেন এখন? তাৎক্ষণিক প্রশ্ন করে বসি। উত্তরে সেওঁতি বলেন, কী করব সেটা জানার আগে আপনাকে জানতে হবে ফায়ারকম সম্পর্কে।
জি বলুন।
সেওঁতি বলতে শুরু করেন, কোথাও আগুন লাগলে সেখানে ক্ষয়ক্ষতি হয় মূলত তিনটি কারণে। এক. সময় মতো ফায়ার সার্ভিস স্টেশনে খবর না পৌঁছা। দুই. রাস্তায় যানজটের কারণে সময় মতো ঘটনাস্থলে ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি পৌঁছতে না পারা। এবং তিন. নিকটস্থ হাসপাতালে খবর না পৌঁছা। আমাদের অ্যাপস মূলত এই তিনটি কাজই করবে। অ্যাপসের জরুরি বোতামে (ইমার্জেন্সি বাটন) চাপ দিলে একই সঙ্গে খবর চলে যাবে নিকটস্থ ফায়ার সার্ভিস কন্ট্রোলরুমে, ট্রাফিক কন্ট্রোলরুমে এবং হাসপাতালে। ফলে দমকল বাহিনি দ্রুত রওনা দেবে, ট্রাফিক পুলিশ ওই রুটের (দুর্ঘটনাস্থলে যাওয়ার রুট) রাস্তা যানজটমুক্ত রাখবে এবং নিকটস্থ হানপাতাল কর্তৃপক্ষ দ্রুত ঘটনাস্থলে অ্যামবুলেন্স পাঠাবে।
সেওঁতি থামলে ফের বলতে শুরু করেন রাফিদ। ‘এটি গেল প্রকল্পের সফটওয়্যার ভার্সন। এটির একটি হার্ডওয়্যার ভার্সনও তৈরি করেছি আমরা। এটির নাম দিয়েছি এএফসিএস (অটোমেশন ফায়ার কন্ট্রোল সিস্টেম)।’ এটুকু বলে একটু থামেন রাফিদ। তারপর আবার বলতে শুরু করেন, ‘গভীর রাতে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়েছে তখন হয়ত কোথাও আগুন লাগল; মোবাইল অ্যাপসের বোতামে চাপ দেবার মতো অবস্থায় কেউ নেই, তখন কাজ করবে এই এএফসিএস। অর্থাৎ ধোঁয়ার উপস্থিতি টের পেলেই এএফসিএস সয়ংক্রিয়ভাবে বার্তা পাঠাবে ওই ফায়ার সার্ভিস কন্ট্রোলরুমে, ট্রাফিক কন্ট্রোলরুমে এবং হাসপাতালে।’
রাফিদ আরো জানান, এই যন্ত্রটি মাত্র এক হাজার টাকাতেই কেনা সম্ভব।
রাফিদকে থামিয়ে দিয়ে আবার বলতে শুরু করেন সেওঁতি, ‘একটু আগে জানতে চাইছিলেন না, পুরস্কারের টাকা দিয়ে কি করব? আমরা মূলত এএফসিএস তৈরির পেছনে ব্যায় করব এই টাকা এবং এটি বিতরণ করব বস্তিবাসীর মধ্যে। কারণ আমরা দেখেছি, বস্তিতে আগুণ লাগলে সেখানে ক্ষয়ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি।’
সবমিলিয়ে এই ছিল ব্র্যাকাথনবিজয়ী ‘বুয়েট ফায়ার ফাইটার্স’ দলের গল্প। তবে গল্পের শেষে ব্র্যাকাথন সম্পর্কে আর একটু তথ্য যোগ করেন কিঞ্জল বড়ুয়া। তিনি জানান, ব্র্যাকাথন প্রতিযোগিতা শুরু হয় গত ৮ জানুয়ারি। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের জন্য ২০০টি আবেদন জমা পড়ে। এর মধ্যে যাচাই-বাছাই করে ৪০ জনের একটি সংক্ষিপ্ত তালিকা করা হয়। গত ৩ ও ৪ মার্চ প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে ১৬ দলের মধ্য থেকে ১১টি দলকে চূড়ান্তভাবে বিজয়ী ঘোষণা করা হয়। সেই ১১ দলের একটি বুয়েট ফায়ার ফাইটার্স। এরপর গত ৬ মার্চ রাজধানীর ব্রাক ইন সেন্টারে বিজয়ী দলের প্রত্যেকের হাতে ক্রেস্ট ও ৫ হাজার ডলার তুলে দেওয়া হয়।