তিন ভুবনের তিন মেধাবী
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
একজন বিতর্কের নেশায় ছুটে আসে রাজশাহী থেকে ঢাকায়। আরেকজন কঠিন কঠিন নাচ আর গানের পরীক্ষায় উতরে যাচ্ছে অবলীলায়। বিজ্ঞানের মজায় অন্যকে আগ্রহী করতে ভিডিও বানিয়ে ইউটিউবে আপলোড করছে আরেকজন। তিন মেধাবীর গল্প শুনুন এই প্রতিবেদনে।
ঝোঁক তাঁর বিতর্কে
‘বিতর্ক আমাকে মানসিক শান্তি দেয়’। এভাবেই বললেন মাহবুব মোর্শেদ হক। রাজশাহী কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। বিতর্কের শুরুটা ষষ্ঠ শ্রেণি থেকেই। ‘পরিবেশ বিপর্যয় প্রতিরোধই এই শতকের বড় চ্যালেঞ্জ’—এই বিষয়ে বিপক্ষে থেকে সেবার হেরেছিলেন ওই সময়ের তুখোড় বিতার্কিকদের কাছে। এর পরের বিতর্কের জন্য সময় নিলেন বেশ খানিকটা। নিজেকে তৈরি করলেন। পরবর্তী বিতর্কে অংশ নেন নবম শ্রেণিতে। এর পর থেকে নিয়মিত বিতর্ক চালিয়ে যাচ্ছেন। এখন পর্যন্ত পঞ্চাশেরও বেশি বিতর্কে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছেন। বিতর্ক যেন তার রুটিন। বিতর্কের ডাক পড়লে রওনা হয়ে যান তড়িঘড়ি।
মাহবুবের মতে, বিতর্কের জন্য বিতর্ক করাই যায়। তবে শেখার জন্য করলে সময় দিতে হয়। এখানে সময় দিলে ক্ষতি না হয়ে বরং লাভই হয়। কারণ বিতর্কের জন্য তথ্য জড়ো করতে হলে অনেক বই পড়তে হয়, সেই সঙ্গে নজর রাখতে হয় সমসাময়িক সব বিষয়ের দিকে। কারণ বিতর্ক বিষয়টার ব্যাপ্তি অনেক।
উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছেন। আছে পড়ার চাপও, তবে মাহবুব মনে করেন, এটা ম্যানেজ করা তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। মাধ্যমিকে সব বিষয়ে জিপিএ পাঁচ পেয়ে পাস করেন মাহবুব। বললেন, ‘আমরা ধরেই নিই, সায়েন্সে অনেক লেখাপড়া। তাই শিক্ষাসহায়ক কাজগুলোয় আমরা মনোযোগ দিই না। প্রতিদিনের পড়াটা প্রতিদিন শেষ করে রাখলে তেমন কোনো কঠিন কিছু নয়; বরং এই কাজগুলো পরবর্তী সময়ে লেখাপড়ার জন্য অনেক সহায়তা করে।
আত্মবিশ্বাসী মাহবুব অনেক সাফল্য পেয়েছেন বিতর্কে। ২০১৫ ও ২০১৬ সালে বিটিভি-দুদক বিতর্কে চ্যাম্পিয়ন হন তাঁরা। প্রথম আলো বিতর্কেও স্কুলপর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন। রাজশাহীর ক্লাবভিত্তিক বিতর্কেও আছে অনেক সাফল্য।
মাহবুব মনে করেন, গান, খেলাধুলা, নাচ—এগুলো অনেক দর্শক টানে। বিতর্কে অতটা গ্ল্যামার নেই, বিতর্ক অতটা দর্শকও টানে না। তবে বিতর্ক মানুষের ভুল ধরিয়ে দেওয়া ও সঠিক যুক্তি গ্রহণ করার পাঠ দেয়। যেটা অন্য অনেক কিছু থেকেই আসে না। নতুন যারা বিতর্ক করতে ইচ্ছুক, তাদের অন্তত এই বিষয়গুলো ভেবেই বিতর্কে আসতে হবে।
পরিবারের সমর্থন পেয়েছেন সব সময়ই। প্রতিযোগিতার জন্য প্রায়ই রাজশাহী থেকে ঢাকায় আসতে হয়। পরিবারের এতে তেমন কোনো আপত্তি নেই। তবে পড়াশোনার বিষয়টি আগে রেখে বাকি সব করার তাগিদ দেয় পরিবার।
একসঙ্গে তিন
হিমির নাচ ও গানে আগ্রহটা একেবারেই ছোটবেলা থেকে। শখের মিউজিশিয়ান বাবার তবলার তালে নাচত হিমি। আর গানপ্রেমী মায়ের সঙ্গে সা রে গা মা পা। তখনো ঠিকমতো হাঁটতেই শেখেনি। আগ্রহ দেখে মা-বাবা সিদ্ধান্ত নিলেন, হিমিকে নাচ ও গান শেখাবেন। তবে গানের শিক্ষক বললেন, যেকোনো একটি পছন্দ করতে হবে। তবে হিমির দুটিতেই ঝোঁক। মা-বাবা ঠিক করলেন, হিমিকে কোনোটিতেই বাধা দেবেন না। সেই থেকে হিমি মারিয়ার সংগীত ও নৃত্য সাধনার শুরু। সেই সূত্রে হিমি নাচের স্কুল, গানের স্কুল আর পড়াশোনার স্কুলে একসঙ্গে ভর্তি হয়।
এখন রাজধানীর বীরশ্রেষ্ঠ নূর মোহাম্মদ পাবলিক কলেজে একাদশ শ্রেণিতে পড়েন হিমি। পড়াশোনার পাশাপাশি সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের জন্য ছাত্র-শিক্ষক সবার কাছে প্রিয় হিমি। শিক্ষকরা মাঝেমধ্যেই শুনতে চান তাঁর গান। এককথায় বললে শ্রেণিকক্ষের প্রাণ হিমি।
এখন হিমি ক্লাসিক্যাল গানের তালিম নিচ্ছেন ছায়ানটে। ক্লাস এইট পর্যন্ত ভরতনাট্যমে তালিম নিয়েছিলেন। এখন নাচের অনুশীলন আপাতত বন্ধ আছে। তবে সুযোগ পেলেই আবার শুরু হবে।
নাচ-গান করে বলে লেখাপড়ায় কিন্তু পিছিয়ে নেই। মাধ্যমিকে এ প্লাস পেয়েছেন। উচ্চ মাধ্যমিকে বিজ্ঞান নিয়ে পড়ছেন। লেখাপড়া ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রমের সঙ্গে ম্যানেজ করে চলছেন প্রতিদিন। হিমি এ কাজ ভালোই পারেন। তিনি মনে করেন, লেখাপড়ার দোহাই দিয়ে নিজের কোনো শখ তুলে রাখা একেবারেই উচিত নয়। লেখাপড়ার পাশাপাশি কিছু করলে নিজের মানসিক শান্তিটা পাওয়া যায়। এতে লেখাপড়ায় আরো মনোযোগ বাড়ে।
গানের ক্ষেত্রে উচ্চাঙ্গসংগীত ও নজরুলগীতি পছন্দ হিমির। সাফল্যও এসেছে। খুলনা বিভাগ থেকে দ্বিতীয় হয়েছিলেন একবার। রাজশাহী বেতারের অডিশনটার কথা জানালেন আলাদাভাবে। সেখানে ছড়া গান ও দেশের গানে অডিশন দিয়েছিলেন। দুই ক্যাটাগরিতেই হিমি সুযোগ পেয়ে যান।
বাবা প্রকৌশলী ওয়াহেদুর রহমান। মেয়েকে নিয়ে তাঁর গর্বের সীমা নেই। ‘আমি আর ওর মা যখন ওর স্কুলে যাই বা ওর কোনো প্রোগ্রামে যাই, তখন সবাই বলে হিমির মা-বাবা, এর চেয়ে বড় আনন্দের আর কী হতে পারে?’ নাচ ও গানের সুবাদে হিমিকে অনেকেই চেনে, সেটি নিয়েও আপত্তি নেই হিমির বাবার। বরং তিনি খুব উপভোগ করেন।
ইউটিউবে বিজ্ঞান জাদুকর
ছিদ্রযুক্ত বোতল উপুড় করলে কেন পানি পড়ে না। কেনই বা পানির ভেতর কয়েন আঁকাবাঁকা চলে? এগুলো তোমরা নিশ্চয়ই বইয়ের ভাষায় পড়েছ। তোমাদের এসব বিষয় মজাদার উপায়ে ভিডিও করে দেখানোর জন্য তোমাদেরই বয়সী একজন শুরু করেছে একটি ইউটিউব চ্যানেল। এসব মজার মজার বিজ্ঞান জাদুতে আগ্রহ থেকেই ইউটিউবে চ্যানেল তৈরি করেছে আবদুল্লাহ আল মুতী। বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ও বিজ্ঞান লেখকের নামে তার নাম। বড় হয়ে এমনই যে হতে চায় আবদুল্লাহ!
বিজ্ঞানে আবদুল্লাহর আগ্রহ অনেক আগ থেকেই। তবে ঠিক উপভোগ্য কিছু করা হয়ে উঠছিল না। নিজের বিজ্ঞান-ভাবনা বিশ্বময় ছড়িয়ে দিতে শেষ পর্যন্ত বেছে নিল ইউটিউবকে। অন্য শিশুদের বিজ্ঞানের মজার মজার বিষয়গুলো দেখিয়ে বিজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করার জন্য আবদুল্লাহর এই কাজ। রাজধানীর চেতনা মডেল একাডেমির নবম শ্রেণির বিজ্ঞান বিভাগে পড়ছে ও। একঘেয়ে পড়াশোনায় উপভোগ্য পরিবর্তন আনতেই তার এই প্রয়াস।
প্রজেক্ট ইমপেল নামে তার এই ইউটিউব চ্যানেলের লক্ষ্যই হচ্ছে বিজ্ঞানের মজার মজার খেলা সমবয়সীদের সামনে তুলে ধরা। চ্যানেলটি একেবারেই নতুন, তবে আবদুল্লাহ তার জায়গায় অনন্য। কারণ তার বয়সী এ ধরনের ইউটিউবার দেশে খুব একটা দেখা যায় না।
আবদুল্লাহর মা জাহানারা বেগম পেশায় সাংবাদিক। জানালেন, বড় ভাই লেখাপড়ার কাজে ব্যস্ত আর আমিও কাজ করি। আবদুল্লাহকে বেশির ভাগ সময় ঘরে একা থাকতে হয়। সেই একা সময়কে কাজে লাগাতেই তার এই প্রয়াশ। আবদুল্লাহর এই প্রয়াসে সহায়তা করছেন আবদুল্লাহর বড় ভাই।
লেখাপড়ার পাশাপাশি ইউটিউবের ভিডিও বানাতে তার সমস্যা হয় না। বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ থেকে নবম শ্রেণিতে উঠে বিজ্ঞান বিভাগকে পছন্দ করেছে আবদুল্লাহ। তাই এখন বিজ্ঞানের লেখাপড়া ও বিজ্ঞানের জাদুকে ভালোভাবেই সমন্বয় করছে।
আর ভিডিওতে দেখা যায়, এটি নিয়ে খুবই উচ্ছ্বসিত আবদুল্লাহ। আবদুল্লাহর ভাষায়, ফেসবুকেও আমি আমাকে দেখি, তবে ইউটিউবে ভিডিওতে নিজেকে দেখার অনুভূতিই আলাদা।
ভিডিও বানানোর জন্য এখনো আছে অনেক সীমাবদ্ধতা। তবে আবদুল্লাহ ভিডিও এডিটিং শিখবেন ও নিজের দক্ষতা আরো বাড়াতে কাজ করবেন বলে প্রত্যয়ী।
আবদুল্লাহর চ্যানেলের লিংক : www.youtube.com/c/projectimpel