গার্মেন্টস শিল্পে আঁধার তাড়াবে সান-বিম
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
একদিন ফেসবুক ঘাঁটাঘাটি করতে করতেই নজরে এলো বিজ্ঞাপনটি-‘শুরু হচ্ছে দেশের প্রথম ন্যাশনাল এনার্জি হ্যাকাথন-২০১৭’। বিস্তারিত পড়ে ফিরোজ হোসেন তখনই ফোন করলেন শরীফ, মারজান, মোস্তাফিজ, শহিদুল ও তানজিমকে।‘এ সুযোগ হাতছাড়া করা উচিত হবে না। যেহেতু দেশের প্রথম এনার্জি হ্যাকাথন, সেহেতু এখানে ভালো কিছু করতে পারলে আমরা চিরস্মরণীয় হয়ে থাকব।’ বন্ধুদের বললেন ফিরোজ। বন্ধুরা তার কথায় সায় দিলেন। বললেন, ‘তাহলে আর দেরি কেন? চলো, দল গঠন করে আইডিয়া জমা দিই।’
ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স বিভাগের (ইইই) এই ছয় বন্ধু মিলে দলের নাম দিলেন ‘সান-বিম’। তারপর ভাবতে বসলেন আইডিয়া নিয়ে। কী নিয়ে প্রজেক্ট রেডি করা যায়? ভাবতে ভাবতে, ভাবতে ভাবতে তিন-চারদিন কেটে গেল। অবশেষে খুঁজে পেলেন অভিনব এক আইডিয়া।
ফিরোজ হোসেন যেমনটা বলছিলেন—‘বাংলাদেশের অর্থনীতি দাঁড়িয়ে আছে তৈরি পোশাকশিল্পের ওপর। আর পোশাকশিল্প দাঁড়িয়ে আছে গ্যাস তথা জ্বালানী ওপর। কেননা জ্বালানী না থাকলে পোশাক কারখানায় উৎপাদন হবে কী করে? কিন্তু উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে, আমাদের মজুদ গ্যাস দিনকে দিন ফুরিয়ে আসছে। ফলে দিনের একটা বড় সময় কারখানাগুলোতে গ্যাস সরবরাহ বন্ধ রাখে সরকার। এ সময় অনেক পোশাক কারখানায় উৎপাদনও বন্ধ থাকে। কেউ কেউ অবশ্য এলপি গ্যাস কিংবা সোলার প্যানেলের মাধ্যমে এই সময়ে কারখানা সচল রাখেন। কিন্তু এ পদ্ধতি অনেক ব্যয়বহুল। ফলে অনেক গার্মেন্ট প্রতিষ্ঠান কুলিয়ে উঠতে পারছেন না।এই সমস্যা ভীষণভাবে নাড়া দিল আমাদেরকে। আমরা ভাবলাম, এই সমস্যার সমাধানসূচক প্রকল্পই জমা দেব ন্যাশনাল এনার্জি হ্যাকাথনে।’
যেই ভাবা সেই কাজ। ছয় বন্ধু লেগে পড়লেন প্রকল্পকে চূড়ান্ত রূপ দিতে।‘টানা দুই মাস যে কী পরিমাণ পরিশ্রম করেছি তা বলে বোঝানো সম্ভব নয়। সারা রাত ইন্টারনেটে পড়ে থেকেছি সংশ্লিষ্ট তথ্য জোগাড় করতে, তারপর সকালে উঠে আবার ল্যাবে গিয়ে সারাদিন কাজ করেছি।’ বলছিলেন শরীফ মিয়া। শুধু তাই নয়, শরীফের সঙ্গে যোগ করেন মারজান হোসেন—‘এই হ্যাকাথনে অংশ নিতে গিয়ে সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষা পর্যন্ত বিসর্জন দিতে হয়েছে আমাদের।’
তবে, বিসর্জনের পথ ধরেই সম্ভবত আসে অর্জন। অবশেষে এলো সেই কাঙ্ক্ষিত দিন। ১৯ ও ২০ এপ্রিল দুই দিন টানা ৩৬ ঘণ্টার হ্যাকাথনে অংশ নিলেন তারা। স্থান: রাজধানীর বসুন্ধরা কনভেনশন সেন্টার। হ্যাকাথনের আয়োজক: বাংলাদেশ সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানী ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়। তাদের সঙ্গে প্রতিযোগিতায় দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় ও শিল্প প্রতিষ্ঠান থেকে যোগ দিয়েছেন আরও ২১৩টি দল। মোট ৭টি ক্যাটাগরিতে ৮০০ জন প্রতিযোগি লড়াই করছেন এই হ্যাকাথনে। অবশেষে বিজয়ের হাসি হাসলেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ছয় শিক্ষার্থীর দল সান-বিম। ‘শিল্প ক্ষেত্র’ ক্যাটাগরিতে তারা অর্জন করলেন রানার আপ শিরোপা। পুরস্কার হিসেবে প্রত্যেকে পেলেন একটি করে স্মার্ট ফোন, ক্রেস্ট ও সনদ। এই প্রতিযোগিতায় অবশ্য চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন গার্মেন্টস প্রতিষ্ঠান থেকে আসা একটি দল।
সে যাইহোক, পুরস্কার পেয়ে কেমন লাগছে? জিজ্ঞেস করি বিজয়ী দল সান-বিমকে। উত্তরে সান-বিম দলপতি ফিরোজ হোসেন মৃদু হেসে বলেন, ‘এ অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করার মতো নয়।জীবনের প্রথম এরকম একটি জাতীয় প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া এবং রানার আপ হতে পারা আমাদের জন্য অনন্য অর্জনই বটে।’
‘আমরা আরও অনুপ্রাণিত হবো, যদি আমাদের প্রকল্প বাস্তবায়নে সরকার কিংবা কোনো প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে।’ বলছিলেন মোস্তাফিজুর রহমান। ‘এটা এমন একটি প্রকল্প সেটা বাস্তবায়িত হলে উপকৃত হবে আমাদের গার্মেন্টস শিল্প।’ এটুকু বলার পর নিজেদের প্রকল্প সম্পর্কে বিশদ বর্ণনা দেন তিনি—‘গ্যাসের বিকল্প হিসেবে সৌর শক্তিকে কাজে লাগিয়ে কীভাবে কারখানাগুলোকে সচল রাখা যায় সেই ধারনাই দিয়েছি আমাদের প্রকল্পে। এটি কম খরচে, স্বল্প পরিসরে বাস্তবায়ন সম্ভব। এমনকি পুরো ব্যবস্থা নিয়ন্ত্রণ করতে কোনো লোকবলেরও প্রয়োজন পড়বে না, একটিমাত্র অ্যাপস দিয়েই এটি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে।’
তাদের এই প্রকল্প পুরোপুরি পরিবেশবান্ধব বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
মোস্তাফিজের কথা শেষ হলে নিজের অনুভূতির কথা জানান শহিদুল ইসলাম—‘শুরু থেকেই আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম যে, শূন্য হাতে ফিরবো না। আমাদের সেই আত্মবিশ্বাস কাজে লেগেছে।’
সবশেষে এই ছয় শিক্ষার্থী একযোগে জানান, সান-বিমের এই প্রকল্প কাজে লাগিয়ে যদি এ দেশের তৈরি পোশাকিশিল্প উপকৃত হয় তবেই তারা নিজেকে ধন্য মনে করবেন।