প্রোগ্রামিংয়ের পাঁচ তারকা

প্রোগ্রামিংয়ের পাঁচ তারকা

  • ক্যাম্পাস ডেস্ক

জমজমাট আয়োজনে শেষ হলো জাতীয় হাই স্কুল প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতা ২০১৭। সারা দেশ থেকে ১৯টি আঞ্চলিক পর্বের এক হাজার ২০০ বিজয়ী শিক্ষার্থীকে নিয়ে ৭ এপ্রিল রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশনে অনুষ্ঠিত হয় চূড়ান্ত পর্ব। এ পর্বে প্রগ্রামিং ও কুইজ কন্টেস্টে সেরা পাঁচের গল্প শুনুন।


রুহান হাবীব, লেভেল

প্রোগ্রামিংয়ের পাঁচ তারকা

গত বছর রাশিয়ার কাজানে অনুষ্ঠিত ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে বিশ্বের মেধাবী সব প্রতিযোগীকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশিদের মধ্যে প্রথম ব্রোঞ্জ মেডেল পায় রুহান হাবীব। গত বছর প্রগ্রামিং কন্টেস্টে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়নও তার ঝুড়িতে। এ ছাড়া আরো বেশ কিছু অর্জন রয়েছে তার। ২০১৬ সালের বাংলাদেশ ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে সেকেন্ড রানার-আপ এবং ২০১৪ সালে জুনিয়র ক্যাটাগরিতে ফার্স্ট রানার-আপ। তা ছাড়া বাংলাদেশ ফিজিকস অলিম্পিয়াডে ২০১৬ ও ২০১৫ সালে এ- ক্যাটাগরিতে ফার্স্ট রানার-আপ। এ বছর জাতীয় হাই স্কুল প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতায় প্রগ্রামিং কন্টেস্টে সিনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়ে নিজের জায়গা দখলে রেখেছে সে। প্রগ্রামিং কন্টেস্টে ২০১৫ সালের জুনিয়র ক্যাটাগরিতে ফার্স্ট রানার-আপও অর্জন করে। মেধাবী এই খুদে প্রগ্রামার আন্তর্জাতিক আরো বেশ কয়েকটি প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে পুরস্কার জিতে নেয়। রুহান হাবীব ঢাকা রিজেন্ট এডুকেয়ার, ও-লেভেলে পড়াশোনা করছে। বাবা ফজলুস সাত্তার মানবাধিকার গবেষক এবং মা জাকিয়া হাবীব কলেজ শিক্ষিকা। গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষার চাপ না থাকলে বেশির ভাগই প্রগ্রামিং নিয়ে সময় দেয় রুহান হাবীব। পরীক্ষা, ক্লাস ও কন্টেস্ট একই সময় হয়ে গেলে সমন্বয় করতে ঝামেলায় পড়তে হয় তাকে। তবে এ ব্যাপারে তার অভিভাবক ও শিক্ষক সর্বোচ্চ সহযোগিতা করেন। এ বছর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার নিজের প্রতি আত্মবিশ্বাসও তার ছিল। এ ছাড়া তার আগেরও অভিজ্ঞতা ছিল। বাবা ফজলুস সাত্তার প্রগ্রামিং নিয়ে ছেলেকে সময় দিতে নিয়মিত উৎসাহ জোগান। তিনি মনে করেন, তাঁর ছেলে ইন্টারন্যাশনাল গুরুত্বপূর্ণ সব অলিম্পিয়াডে দেশের জন্য সম্মানজনক সব মেডেল অর্জন করতে পারবে, সেভাবেই তাকে তৈরি করা হচ্ছে। এ ছাড়া বুয়েটের প্রফেসর কায়কোবাদ স্যারও বলছেন, রুহান হাবীবের হাত ধরেই ইন্টারন্যাশনাল ইনফরমেটিকস অলিম্পিয়াডে গোল্ড মেডেল অর্জন করবে বাংলাদেশ। বড় হয়ে প্রগ্রামিং ও পদার্থ বিজ্ঞান নিয়ে কাজ করার ইচ্ছা তার।

.

2-মামনুন সিয়াম, নবম শ্রেণি

সিয়াম পড়ছে চট্টগ্রাম কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণিতে। ২০১৩ সালের প্রাথমিক সমাপনী ও ২০১৬ সালে জেএসসিতে জিপিএ ৫.০০ পায়। বাবা জাহাঙ্গীর আলম, তিনি চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এবং সাবেক ভাইস-চ্যান্সেলর। মা রোকসানা মান্নান লিপি। মামনুন সিয়াম এ বছর জাতীয় হাই স্কুল প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতায় প্রগ্রামিং কন্টেস্টে জুনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয়। এর আগে জাতীয় ফিজিকস অলিম্পিয়াড ২০১৬-এ ১৫তম এবং জাতীয় ফিজিকস অলিম্পিয়াড ২০১৭-এ সপ্তম হয়। দুই বছরই এ ক্যাটাগরিতে অংশগ্রহণ করে। এবার আঞ্চলিক গণিত উৎসবে চট্টগ্রাম থেকে চ্যাম্পিয়ন অব দ্য চ্যাম্পিয়ন এবং জাতীয় উৎসবে ফার্স্ট রানাস-আপ অর্জন করে। অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণের কারণে স্কুলের পড়াশোনা নিয়মিত করা হয় না তার। তাই পরীক্ষার আগে চাপে পড়তে হয়। তার পরও সব কিছু সমন্বয় করে প্রতিদিন দুই-আড়াই ঘণ্টা পড়াশোনায় সময় দেওয়া হয়।   অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করতে পারিবারিকভাবে কোনো বাধাই আসে না তার; বরং অলিম্পিয়াডে অংশগ্রহণ করে ভালো কিছু অর্জন করতে মা-বাবা নিয়মিত উৎসাহ জোগায়। তার পরও এ উৎসাহ বাবার চেয়ে মা থেকে বেশি পায় মামনুন সিয়াম। ক্যাম্পাসের বন্ধুরাও তাকে বেশ সাহায্য করে, উৎসাহও জোগায়। চ্যাম্পিয়ন হব—এ রকম আত্মবিশ্বাস ছিল। এ জন্য গত দেড় মাস বেশ পরিশ্রম করে। গতবার প্রগ্রামিং কন্টেস্টে ৩৬তম হওয়ার পর এ বছর চ্যাম্পিয়ন হওয়ার লক্ষ্য ঠিক করে রেখেছিল সে। সফলভাবেই এ বছর কন্টেস্ট শেষ করেছে। বড় হয়ে কী হতে চাও এ প্রশ্নের জবাবে মামনুন সিয়াম বলে, এখনো ঠিক করিনি। তবে কম্পিউটার সায়েন্স, পদার্থ বিজ্ঞান বা গণিত—যেকোনো একটি বিষয়ের ওপর ভালো বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার ইচ্ছা আছে। বড় হয়ে দেশে তথ্যপ্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে পরিবেশ দূষণ ও দুর্নীতি বন্ধ করতে চাই।

ইমামুন নূর, একাদশ শ্রেণি

3কুইজ কন্টেস্টে হাইয়ার সেকেন্ডারি গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন ইমামুন নূর। গত বছর ঠাকুরগাঁও সরকারি বালক উচ্চ বিদ্যালয় থেকে এসএসসিতে গোল্ডেন এ-প্লাস পেয়ে উত্তীর্ণ হয়। এর পরই চলে আসে ঢাকায়, সেন্ট যোসেফ উচ্চ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে একাদশ শ্রেণিতে ভর্তি হয়। বাবা মিজানুর রহমান ও মা রওশন আখতার। দুজনেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক। পত্রিকায় জাতীয় হাই স্কুল প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতার খবর দেখেই অংশগ্রহণ করে। যেহেতু এখন ঢাকায় থাকে, তাই অন্য কোনো ঝামেলা হওয়ার আশঙ্কা থাকছে না। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার চিন্তাভাবনাও ছিল না তার। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে কিছু অভিজ্ঞতা অর্জন করবে—এত টুকুই ভাবনা। জাতীয় পর্বে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেই বাসায় চলে আসে সে। পরে জানতে পারে সে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। তাই পুরস্কার পর্বে আইসিটি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক ও জাফর ইকবাল স্যারের হাত থেকে চ্যাম্পিয়ন পুরস্কার নেওয়ার সুযোগ হয়নি তার। তবে ব্যাপারটা তার কাছে অন্য রকম আনন্দের। প্রগ্রামিং ও পড়াশোনার সমন্বয় কিভাবে করো এ প্রশ্নের জবাবে ইমামুন বলে, আসলে আমি যখন পড়তে বসি তখন শুধুই পড়ি। এ সময়টায় প্রগ্রামিং বা অন্য কোনো চিন্তাভাবনা থাকে না। আবার যখন প্রগ্রামিং নিয়ে বসি, তখন শুধু প্রগ্রামিংয়ে মনোযোগ দিই। তখন পড়ালেখার চিন্তাভাবনা মাথা থেকে একদমই বের করে দিই। যেহেতু প্রগ্রামিং একটু সময় নিয়ে করতে হয়, তাই একটু সমস্যায় পড়তে হয়। তবে এখন অভ্যাস হয়ে গেছে। তার এতদূর আসার পেছনে মা-বাবার অবদানটাই বেশি, তারা সব সময় সাপোর্ট দিয়েছেন। বড় হয়েও প্রগ্রামিং নিয়ে থাকতে চায় সে, গুগল বা মাইক্রোসফটের মতো এ রকম বিশ্বমানের আইটি ফার্ম বানানোর স্বপ্ন তার। এ ছাড়া ইমামুন নূর চিলড্রেন সায়েন্স কংগ্রেস ২০১৬-এর সায়েন্টিফিক পেপার বিভাগে জাতীয় চ্যাম্পিয়ন, গণিত অলিম্পিয়াডে সেকেন্ডারি গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন এবং ইন্টারনেটভিত্তিক প্রতিযোগিতা আইজেন ২০১৫-এর ফাইনালিস্ট।

.

4মুহাইমিনুল ইসলাম, দশম শ্রেণি

‘খুলনার যে আঞ্চলিক প্রতিযোগিতা হয়েছিল, সেখানে কোনো রকম প্রস্তুতি ছাড়াই অংশগ্রহণ করি এবং চতুর্থ হই। পরে মোটামুটি ভালো প্রস্তুতি নিলেও ট্রেন সমস্যার কারণে প্রায় ১৭ ঘণ্টা পর ঢাকায় জাতীয় পর্বে যাওয়ার পর আমি অসুস্থ হয়ে পড়ি এবং ওই অবস্থায় অংশ নিতে হয়। কুইজে সেকেন্ডারি গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হই এবং তিনটি ক্যাটাগরির মধ্যে সর্বোচ্চ ১৮ নম্বর পাই। যখন স্যার সবার নাম ঘোষণা করলেন কিন্তু আমার নামটা ঘোষণা করলেন না, তখন খুব খারাপ লাগছিল। কিন্তু পরে স্যার বললেন চ্যাম্পিয়নদের নাম এখনো ঘোষণা করা হয়নি। শেষেরজনের আগে সেকেন্ডারি গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হিসেবে যখন আমার নাম ঘোষণা করেন, তখন আমি আনন্দে ফেটে পড়ি এবং পুরস্কার হাতে নিই। ’—এভাবেই কুইজ কন্টেস্টে সেকেন্ডারি গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হওয়ার গল্প বলছিল মুহাইমিনুল ইসলাম। সে খুলনা জিলা স্কুলে দশম শ্রেণিতে পড়ছে। অংশ নিয়েছে অনেক প্রতিযোগিতায়। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ২০১৫-এ গণিত ও কম্পিউটার বিষয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম এবং সৃজনশীল মেধা অন্বেষণ প্রতিযোগিতা ২০১৬-এ বিজ্ঞান বিষয়ে বিভাগীয় পর্যায়ে প্রথম; ২০১৬ সালে ডিজিটাল উদ্ভাবনী মেলায় জেলা পর্যায়ে প্রথম, ৩৬তম জাতীয় বিজ্ঞান মেলা ও প্রযুক্তি সপ্তাহ ২০১৫-তে প্রথম, ৩৭তম জাতীয় বিজ্ঞান মেলা ও প্রযুক্তি সপ্তাহ ২০১৬-তে দ্বিতীয় ও বাংলা উৎসব ২০১৭-এ চতুর্থ। তা ছাড়া ২০১৫ সালে ন্যাশনাল হাই স্কুল প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতায় আঞ্চলিক পর্যায়ে চ্যাম্পিয়ন হয়। মুহাইমিনুলের বাবা শহীদুল ইসলাম বাংলাদেশ বন বিভাগের কর্মকর্তা এবং তিনি একজন ফরেস্ট রেঞ্জার। মা মিসেস শামসুন নাহার। তাঁদের দুজন থেকে ভালোই উৎসাহ পায় সে। পড়াশোনা ও খেলাধুলার ফাঁকে ফাঁকে যখনই সময় পায় সে প্রগ্রামিং করে। তার এক শিক্ষক বলেছেন, ‘চ্যাম্পিয়ন হয়ে মুহাইমিনুল আমাদের সম্মান রক্ষা করেছে, তার এই সাফল্যে আমি খুবই খুশি। ’ বড় হয়ে সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হতে চায় মুহাইমিনুল।

মুহাম্মদ মাশরাফুল হক, অষ্টম শ্রেণি

5প্রথম অংশগ্রহণ করেছে জাতীয় হাই স্কুল প্রগ্রামিং প্রতিযোগিতায়। প্রথম অংশগ্রহণেই বাজিমাত! কুইজ কন্টেস্টে জুনিয়র গ্রুপে চ্যাম্পিয়ন হয় সে। পড়াশোনা করছে সিলেট ক্যাডেট কলেজের অষ্টম শ্রেণিতে। পঞ্চম শ্রেণিতে গোল্ডেন জিপিএ ৫ এবং ট্যালেন্টপুল স্কলারশিপ পায়। তার বাবা মুহাম্মদ মাজহারুল হক ব্যাংক কর্মকর্তা এবং মা সুরাইয়া খানম প্রাইমারি শিক্ষক। মাশরাফুল যেহেতু ক্যাডেটে পড়ে, সে জন্য তাকে সর্বক্ষণই নানা কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। যেটুকু এখন ফ্রি সময় পায়, সেটুকু প্রগ্রামিংয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। ক্যাডেটে পড়াশোনার নির্দিষ্ট সময় থাকায় তার পড়ালেখায় কোনো সমস্যা হয় না এবং পরীক্ষার সময়ও অতিরিক্ত চাপে পড়ে না। পারিবারিকভাবে সবাই তাকে সহযোগিতা করে এবং অনুপ্রেরণা জোগায়। মা-বাবা ছাড়াও তার অনেক কাজিন তাকে সহযোগিতা করে। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ ও আত্মবিশ্বাস বাড়াতে তাদের অবদানই বেশি। মাশরাফুল সময় পেলে ক্যাম্পাসের বন্ধুদের কাছে প্রগ্রামিং শিখতে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। সিলেট ক্যাডেট কলেজের আইসিটি শিক্ষক তইমুর রহমান তামিম বলেন, মাশরাফুলের প্রতি আমার আত্মবিশ্বাস ছিল, সে চ্যাম্পিয়ন হতে পারবে। এ জন্য তাকে আমি কিছু তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছি। মাশরাফুল চ্যাম্পিয়ন হতে পেরেছে বলে আমিসহ সিলেট ক্যাডেট কলেজের সবাই আনন্দিত। মাশরাফুলের চ্যাম্পিয়ন হওয়ায় তার মা-বাবাও প্রচণ্ড খুশি। সন্তানের এই সাফল্য দেখা সৌভাগ্যও মনে করছেন তাঁরা। মাশরাফুল ইন্টারমিডিয়েট পাস করার পর বুয়েট থেকে সিএসই পাস করে গুগল বা মাইক্রোসফটে কাজ করার স্বপ্ন বুনে।

সূত্র: কালের কণ্ঠfavicon59-4

Sharing is caring!

Leave a Comment