আলো ছড়ানো নাজমুল
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
মাতৃভূমির সীমানা পেরিয়ে বিদেশের মাটিতে পরিবেশ দূষণরোধে পরিবেশবান্ধব জীবাশ্ম জ্বালানির প্রক্রিয়াকরণে অসামান্য কৃতিত্ব স্থাপন করেছেন বাংলাদেশের তরুণ বিজ্ঞানী ড. নাজমুল আবেদীন খান। তিনি বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার খিয়ংপুক ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটিতে কন্ট্রাক্ট প্রফেসর হিসেবে কর্মরত। গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছেন জ্বালানি থেকে কালো ধোঁয়া পরিশোধন করার জন্য।
তরুণ এই বিজ্ঞানী নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ পৌর শহরের কাজিহাটি গ্রামে ১৯৮৩ সালে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম মৃত মো. জয়নাল আবেদীন। ১৯৮৮ সালে মোহনগঞ্জ প্রি-ক্যাডেট স্কুলে শিক্ষাজীবন শুরু করেন নাজমুল আবেদীন। তবে তার মা সাবেকা আরজু নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলার হাজি আবদুল আজিজ খান সরকারি ডিগ্রি কলেজের বাংলা বিভাগে চাকরির সুবাদে মদনে স্থানান্তরিত হন একসময়। সেখানে জাহাঙ্গীরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ভর্তি হন এবং সেখান থেকেই পঞ্চম শ্রেণিতে সাফল্যের সঙ্গে বৃত্তি লাভ করেন। মা দুই বছর আগে ওই কলেজ থেকে অবসর নিয়ে বর্তমানে নেত্রকোনার সাতপাই প্রফেসরপাড়ায় স্থায়ীভাবে বাস করছেন। ছেলের এই সাফল্যে গর্ববোধ করে তিনি বলেন, ‘আমার ছেলে নাজমুল ছোটবেলা থেকেই মেধাবী। আমি যখন শিক্ষকতার জন্য মোহনগঞ্জ থেকে মদনে চলে যাই, তখন সেখানে একটি বিদ্যালয়ে ভর্তি করিয়ে দিই।
নাজমুলের বাবা সরকারি খাদ্য নিয়ন্ত্রক ছিলেন। নীতিগত কারণে তিনি সেই চাকরি ছেড়ে দিয়ে আমি যে কলেজে চাকরি করতাম সেখানে নিয়োগপ্রাপ্ত হন। কলেজটির প্রতিষ্ঠাতা ও অধ্যক্ষ ছিলেন আমার বাবা আবদুল মোতালিব। ১৯৯৪ সালে নাজমুলের বাবা জন্ডিসে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করার পর নাজমুল ও আমার আরেক সন্তান শিমুকে নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়ে যাই। তখন আমার বাবার সহযোগিতায় কোনো রকমে দিন চলতে থাকে। পঞ্চম শ্রেণিতে প্রথম গ্রেডে বৃত্তি পায় নাজমুল। চরম দুর্দিনের মধ্যে নাজমুলকে আমার বাবার সহায়তায় ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিই। খাবারের জন্য আমি মাঝে মধ্যে তাকে দেখতে গিয়ে চিড়া কিনে দিয়ে আসতাম। সে পড়াশোনার চাপে চিড়াগুলো ভিজিয়ে খাওয়ার মতো সময়ও পেত না।’
তিনি আরও বলেন, ‘নাজমুল এসএসসি পাসের পর ঢাকা কলেজে ভর্তি হয়। সেখানে নর্থ হোস্টেল ছাত্রাবাসে থাকত।এইচএসসিতেও কৃতিত্বের সঙ্গে পাস করে ২০০০-০১ শিক্ষাবর্ষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগে ভর্তি হয়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রসায়ন বিভাগে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করে ২০০৮ সালে সরকারি খরচে দক্ষিণ কোরিয়ার খিয়ংপুক ন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি শুরু করেন নাজমুল আবেদীন। পরে ২০১১ সালের ডিসেম্বরে মাত্র ২৮ বছর বয়সে ন্যানো পার্টিকেল ব্যবহারের মাধ্যমে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি উদ্ভাবনের ওপর তিনি পিএইচডি ডিগ্রি সম্পন্ন করেন। শিক্ষার্থী ও গবেষক হিসেবে খিয়ংপুক বিশ্ববিদ্যালয়ে যেসব বাংলাদেশি গত এক দশক ধরে বিশেষ অবদান রেখে চলেছেন, তাদের মধ্যে ড. নাজমুল আবেদীন খান অন্যতম।
তিনি জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে সালফার জাতীয় উপাদান পৃথক করার একটি ফলপ্রসূ ও সাশ্রয়ী পদ্ধতির উদ্ভাবন করেছেন। সালফার জাতীয় পদার্থগুলো পরিবেশের জন্য ভয়াবহ হুমকিস্বরূপ। এ ধরনের উপাদান মানব দেহে দেশবাসীর শ্বাস-প্রশ্বাসসহ অনেক জটিল রোগ সৃষ্টি করে। তার এই উদ্ভাবন জ্বালানি থেকে সালফার মুক্ত করার জন্য বিরাট অবদান রাখবে। এসব বিষয়ে বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক জার্নালে ড. নাজমুল আবেদীন খানের ৫১টি গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয়েছে এর মধ্যে। একই সময়ে তিনি পাঁচটি কাজের প্যাটেন্ট পেয়েছেন। এ ছাড়া তার গবেষণা নিয়ে বিভিন্ন খ্যাতিমান জার্নালে প্রচ্ছদও করা হয়েছে। দক্ষিণ কোরিয়ার ১০টিরও অধিক পত্রিকায় তার বিভিন্ন উদ্ভাবনের খবর প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে দেশটির জনপ্রিয় পত্রিকা ‘সিউল শিনমুন’ এবং ‘ওয়াইটিএন’ রয়েছে। তার এ গবেষণার স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি ২০১০ সালে বি. কে. পুরস্কার লাভ করেন। সর্বশেষ ড. নাজমুল আবেদীন খান গবেষণায় অসামান্য অবদানের জন্য গত বছরের ১৮ ডিসেম্বর বিসিকে অ্যাওয়ার্ড-২০১৬ লাভ করেন।
যোগাযোগ করা হলে দক্ষিণ কোরিয়া থেকে টেলিফোনে ড. নাজমুল আবেদীন খান বলেন, ‘জীবাশ্ম জ্বালানি নিয়ে আমি আমার গবেষণা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছি। গবেষণার বিষয়টি নির্ভর করে ফান্ডের ওপর। যদি পর্যাপ্ত পরিমাণ ফান্ড পাওয়া যায় তাহলে গবেষণা কার্যক্রমে সহায়ক হয়। বাংলাদেশ থেকে কোনো শিক্ষার্থী যদি পড়াশোনার জন্য কোরিয়া আসতে চায় তাদেরও ভর্তির জন্য সহায়তা করে থাকি। আমি খুব দ্রুত বাংলাদেশে ফিরে আসতে চাই। দেশের কাজে আমি আমার মেধাকে কাজে লাগাতে চাই।’