রুয়েটর ‘ক্র্যাক প্লাটুন’
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
বাংলাদেশের ছেলেরা তৈরি করবে রেসিং কার! স্বপ্নের মতো শোনালেও সেই স্বপ্নপূরণে কাজ করে যাচ্ছে রুয়েটের ২৩ শিক্ষার্থীর সংগঠন ‘ক্র্যাক প্লাটুন’। এরই মধ্যে তাদের হাতে তৈরি হয়েছে কোয়াড বাইক, বায়োমেট্রিক্স প্লাস ও মেডি কার-ই। এর মধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মিলেছে অনেক সম্মাননা। নিজেদের তৈরি ফর্মুলা রেসিং কার নিয়ে ‘ক্র্যাক প্লাটুন’ অংশ নিতে যাচ্ছে ফর্মুলা স্টুডেন্ট জাপান ২০১৭-এর মূল প্রতিযোগিতায়। ফর্মুলা স্টুডেন্ট হচ্ছে বিশ্বের সব দেশ থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ফর্মুলা কার বানানোর সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা।
গল্পের শুরুটা ২০১৫-এর শেষের দিকে। সুমিত, তাহমিদ, রানা, ফারহান, মামুন, অনিক, মমিন ও শাফিন মিলে একটি অটোমোটিভ টিম শুরু করেন যার নাম দেন ‘ক্র্যাক পল্গাটুন’। সুমিত জানান, টিমের এই নামের অনুপ্রেরণা আমাদের ‘৭১-এর মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের গেরিলা বাহিনী ‘ক্র্যাক পল্গাটুন’- এর নাম থেকে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে আমরা নেমে পড়ি কাজে। টিম ‘ক্র্যাক পল্গাটুন’ একের পর এক উদ্ভাবনী প্রযুক্তি আবিষ্কার করতে থাকে। তারা তৈরি করেন কোয়াড বাইক, বায়োমেট্রিক্স প্লাস ও মেডি কার-ই। তাদের বায়োমেট্রিক্স প্লাস একটি অটোমোটিভ সিকিউরিটি ডিভাইস যেটা স্মার্টফোনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে কাজ করে। মূলত স্মার্টফোনে ফিঙ্গার প্রিন্টের মাধ্যমে রেজিস্টার করা থাকবে মালিকের গাড়ি, মালিক যে কোনো সময় স্মার্টফোনের মাধ্যমে গাড়ির চালকের গতিবিধি ও গাড়ির ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে। গাড়িটি একটি সার্ভারের মাধ্যমে সব সময় ট্র্যাক হবে, ফলে চুরির সম্ভাবনা অনেকটাই কমে যাবে।
মেডিকার-ই একটি অটোমেটিক পাইলট, যেটা গাড়ির চালককে জরুরি মেডিকেল সাপোর্ট দেবে এবং কাছের হাসপাতালে পৌঁছে দেওয়ার ব্যবস্থা করবে। এ দুটি ইনোভেশন নিয়ে তারা ইয়ুথ ফেস্ট ২০১৬তে অংশগ্রহণ করে এবং একটি জোনাল রাউন্ড পার করে ন্যাশনাল রাউন্ডে চলে আসে।
তারা ইতিমধ্যে দেশ ও দেশের বাইরে বেশ কয়েকটি জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ের প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করেন। ২০১৬ সালের ২২ অক্টোবর, ভারতের তামিলনাড়ু রাজ্যে অনুষ্ঠিত এক ইভেন্টে তারা তাদের বানানো গাড়ি নিয়ে অংশগ্রহণ করেন এবং ইভেন্টের ‘বেস্ট প্যাশনেট টিম’ অ্যাওয়ার্ড পান। ফাইনাল রাউন্ডে ৪৩টি টিমের মধ্যে মোট ২৩টি টিম অংশ নেওয়ার জন্য উত্তীর্ণ হয়। টিম ‘ক্র্যাক পল্গাটুন’ সেই ফাইনালিস্ট টিমের মধ্যে ষষ্ঠ স্থান অর্জন করে।
এরপর বাংলাদেশের তরুণদের জন্য সারাদেশের সবচেয়ে বড় প্লাটফর্ম যেখানে শিক্ষার্থীরা অংশগ্রহণ করেন- সেই ইয়ুথ ফেস্ট ২০১৬তে তারা রাজশাহী জোনে চ্যাম্পিয়ন হন। টিম ‘ক্র্যাক পল্গাটুন’-এর সদস্য তাহমিদ বলেন, ‘অনুপ্রেরণার একটা বিশাল জায়গা হয়ে দাঁড়ায় এই ইভেন্ট আমাদের টিমের জন্য। শুরুর দিকের গল্পটা আমাদের অনেক কঠিন ছিল, যখন আমরা স্পন্সরের জন্য বিভিন্ন জায়গায় আবেদন করছিলাম, সেখান থেকে আবেদন ফিরিয়ে দেওয়ার পাশাপাশি আসছিল কাজ থামিয়ে দেওয়ার পরামর্শ। স্পন্সরের জন্য অনেক দৌড়াদৌড়ি করেছি দ্বারে দ্বারে। ফিরিয়ে দিয়েছে অনেকেই, তবে কেউ কেউ ভদ্রভাবে এড়িয়ে গিয়েছেন আমাদের সহায়তা করার ব্যাপারটা। আমরা জানতাম আমাদের দেশে এই কালচারটা একেবারেই নেই। শুরুটা আমাদের করতেই হবে যে কোনো মূল্যে। যেন সামনের দিনগুলোয় কেউ এই ধরনের কাজ শুরু করতে গিয়ে বাধার সামনে না পড়ে। আমাদের কাজটা প্রায় অসম্ভবের পর্যায়ে চলে যাচ্ছিল। আমরা থেমে যাইনি, করে দেখানোর চেষ্টা করেছি আমাদের সবটা দিয়ে। এর মধ্যে দেশি কোম্পানি ওয়ালটন আমাদের ইঞ্জিন দিয়ে সহায়তা করে। কিন্তু ইঞ্জিন ছাড়াও আমাদের আরও বিশাল একটা খরচ ছিল গাড়ি ও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের পেছনে।
বর্তমান কার্যক্রম : টিম ‘ক্র্যাক পল্গাটুন’ এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে ফর্মুলা কার নিয়ে। ফারহান বলেন, ‘আমরা এরই মধ্যে স্টুডেন্ট ফর্মুলা জাপান ২০১৭-এর প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করতে যাচ্ছি। ফর্মুলা স্টুডেন্ট হচ্ছে বিশ্বের সব দেশ থেকে আসা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের ফর্মুলা কার বানানোর সবচেয়ে বড় প্রতিযোগিতা। বিভিন্ন দেশে এটার আয়োজন হয়। এর মধ্যে জাপান, ভারত, জার্মানি, যুক্তরাজ্য, ইতালি, যুক্তরাষ্ট্র ও চেক প্রজাতন্ত্র অন্যতম। সেখানে দেশ-বিদেশের নামকরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে টিম আসে। স্টুডেন্ট ফর্মুলা কার হলো, ফর্মুলা ওয়ান কারের আদলে তৈরি করা এক সিটের প্রোটোটাইপ রেসিং কার। বিভিন্ন দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা নিজেদের ডিজাইনে নিজ হাতে বানানো গাড়ি নিয়ে আসে এসব প্রতিযোগিতায়। এ ধরনের গাড়ির অনেক বৈশিষ্ট্য থাকে, যার মধ্যে স্পিড, ব্রেকিং, স্ট্যাবিলিটি, কন্ট্রোল নিয়ে বেশি কাজ করা হয়। মূলত এ গাড়িগুলোয় যে ধরনের গবেষণা করা হয়, সেগুলো সামনের দিনের প্রডাকশন কারে ব্যবহার করা হয়। আমাদের গাড়ির ডিজাইন ও রিসার্চ শেষ হয়েছে এবং আমরা গাড়ির চেসিসের কাজও শেষ করে ফেলেছি। এ ধরনের ইঞ্জিন দেশে পাওয়া যায় না, তাই এগুলো বাইরে থেকে আনানোর প্রয়োজন পড়ে। আমরা গাড়ির ওজন কম রেখে এর পারফরম্যান্সের দিকটা উন্নত করার কাজ করে যাচ্ছি। হাজার হোক দেশের প্রথম ফর্মুলা রেসিং গাড়ি বলে কথা! এই গাড়ি চালানোর জন্য আমাদের কমপক্ষে চার থেকে ছয়জন চালক লাগবে, এটা ওই প্রতিযোগিতার নিয়ম। মোট আটটি ডাইনামিক ইভেন্টের মধ্যে একজন চালক সর্বোচ্চ দুটি ইভেন্ট কাভার করতে পারবে। আমাদের টিমে দেশের প্রথম নারী ফর্মুলা রেসারের অভিষেক ঘটতে যাচ্ছে। শুধু টেকনিক্যাল নয়, গাড়িটিকে একটি রেসিং কার হিসেবে ধরে একটি বিজনেস মডেল দাঁড় করিয়ে আমাদের লড়তে হবে পাঁচটি বিজনেস রিলেটেড ইভেন্টেও। এ ধরনের প্রতিযোগিতার টেকনিক্যালের পাশাপাশি বিজনেসের অংশটাও ভালোভাবে দেখতে হয়। তাই একটা ব্যালান্সড টিম হওয়া খুব জরুরি। আমাদের এখন টিম ২৩ জনের, এর মধ্যে ১৫ জন টেকনিক্যাল টিমের, আটজন বিজনেসের। তবে এর মধ্যে তিনজন নারী সদস্য আছেন। যদিও আমরা শুরু করেছিলাম মাত্র আটজন। আজ টিমটা অনেক বড় হয়ে গেছে, সেই সঙ্গে আমাদের স্বপ্নও।’
সুমিত বলেন, ‘আমাদের এ প্রজেক্টে আমাদের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে আছেন রুয়েটের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. সিরাজুল করিম চৌধুরী, বর্তমান ভাইস চ্যান্সেলর ড. মো. রফিকুল আলম বেগ, যন্ত্রকৌশল বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. মো. রোকনুজ্জামান ও মেকাট্রনিক্স বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ড. এমদাদুল হক।’ কথা হয় রুয়েটের সাবেক ভাইস চ্যান্সেলর ড. সিরাজুল করিম চৌধুরীর সঙ্গে। তিনি টিম ‘ক্র্যাক পল্গাটুন’-এর এই উদ্ভাবন ও তাদের কর্মকাণ্ডে সার্বিকভাবে পরামর্শ সহায়তা দিয়েছেন। তিনি জানান, ‘নিঃসন্দেহে আমাদের জন্য এক গৌরবের বিষয় এই প্রথম বাংলাদেশে তৈরি রেসিং কার সারাবিশ্বের মাঝে বাংলাদেশকে তুলে ধরার সুযোগ পাচ্ছে। তিনি আরও জানান, টিম ‘ক্র্যাক পল্গাটুনের প্রতিটি সদস্য অনেক বেশি উদ্যমী ও মেধাবী। তারা গৌরবের সঙ্গে তাদের মেধা আর পরিশ্রমের স্বাক্ষর রাখবেন বলে আমি বিশ্বাস করি।’
টিমের আরেক সদস্য ফারহান বলেন, ‘আমাদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ ফান্ডিং, এটা সবার আগে প্রয়োজন। তবে দেশে এ ধরনের কাজের সংস্কৃতি না থাকায় ফান্ডিং পেতে আমরা হিমশিম খাচ্ছি। এখনও আমাদের প্রায় ৭১ লাখ টাকার প্রয়োজন পুরো ইভেন্ট কাভার করে আসতে হলে। আমরা চাচ্ছি দেশকে প্রথমবারের মতো এ রকম একটা প্রতিযোগিতায় নিয়ে যেতে। লাল-সবুজের দলের হাত ধরে জাপানের ট্র্যাকে ছুটে চলবে বাংলাদেশের তৈরি গাড়ি, এই স্বপ্নে বিভোর সারাদেশ। এ জন্য আমাদের পৃষ্ঠোপোষক প্রতিষ্ঠানের সহায়তা প্রয়োজন। আমরা বাংলাদেশের সব বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও বাংলাদেশ সরকারের সদয় দৃষ্টি প্রার্থনা করছি। আমরা চাই দেশে এমন কাজ আরও হোক। আমাদের দেশের মানুষের মেধার অভাব নেই, আছে সঠিক পরিচর্যা ও পৃষ্ঠপোষকতার অভাব। দরকার একটু সুযোগ। তাহলে এই দেশের ছেলেরা দেখিয়ে দিতে পারবে তারাও পারে।’