অন্য এক বিতার্কিকের গল্প
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
শেখ রিফায়েত দাইয়ানের শুরুটা হয়েছিল ছবি আঁকা দিয়ে। তারপর ক্রিকেট খেলা। এরপর দাবা। এগুলোর বদৌলতে অসংখ্য পুরস্কারও ঘরে তুলেছেন। কিন্তু মন টিকছিল না কোনো কিছুতেই। একদিন হঠাৎ কী মনে করে স্কুলের বিতর্কের একটা সেশনে ঢুকে বসলেন। তন্ময় হয়ে শুনছিলেন বিতর্ক নিয়ে বড় ভাইয়াদের কথা। তখন সেন্ট যোসেফ স্কুলের ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়তেন শেখ রিফায়েত দাইয়ান সৃজন। সেই দিনটি আজ বদলে দিয়েছে তাঁর জীবন। কীভাবে, সেই গল্প বললেন নিজের মুখেই।
সেদিন মুগ্ধ হয়ে বিতর্কের ভাষা শোনার পর থেকে এটার প্রতি আগ্রহ তৈরি হয় সৃজনের। যোগ দেন স্কুলের বিতর্ক দলে। এখানে-সেখানে বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে নিতে একটা সময় বনে যান বাংলাদেশ জাতীয় বিতর্ক দলের সদস্য। বড় সুযোগটা আসে তখনই। অষ্টম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় শুরু করেন ইংরেজি বিতর্ক। হঠাৎ বাংলা থেকে ইংরেজি বিতর্ক করতে গিয়ে প্রথমে কিছুটা হিমশিম খেলেও নিজেকে সামলে নিয়েছেন সৃজন। অনেক বেশি ইংরেজি বই পড়েছেন, চলচ্চিত্র দেখেছেন, কথা শুনেছেন। চর্চা করেছেন ইংরেজি বলার।
ইংরেজি ভাষাটা যখন মোটামুটি দখলে এসে গেছে, তখন পেয়ে গেলেন বিশ্বের সবচেয়ে বড় বিতর্ক প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের সুযোগ। ‘ওয়ার্ল্ড স্কুল ডিবেটিং চ্যাম্পিয়নশিপ’-এ বাংলাদেশ জাতীয় দলের সদস্য হয়ে লড়াই করেছেন দুবার। ২০১৪ সালে থাইল্যান্ডে এবং ২০১৫ সালে সিঙ্গাপুরে অনুষ্ঠিত চূড়ান্ত পর্বে অংশগ্রহণ করেছেন তিনি। শেষ পর্যন্ত বিজয়ী হতে না পারলেও গর্বভরে বলছিলেন, ‘আমাদের বাংলাদেশ খুব ভালো করেছে।’ সৃজনের মা-বাবা দুজনই বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনের পরিচিত মুখ। শেখ আবুল হাশেম ও কামরুন নাহার ডানা—দুজনই ব্যাডমিন্টনে জাতীয় পুরস্কার পেয়েছিলেন। দেশের প্রতিনিধিত্ব করার অনুপ্রেরণা খুঁজতে তাই সৃজনকে খুব বেশি দূরে যেতে হয় না!
সৃজন বলছিলেন, ‘আমি গবেষণা করতে ভালোবাসি। সে জন্য প্রচুর পড়াশোনা করতে হয়। এটাই আমার ভালো লাগে।’ বিতর্ক করতে গিয়েই পড়ার প্রতি আগ্রহটা বেড়েছে। আর এই আগ্রহের সুফল পেয়েছেন শিক্ষাজীবনে। ২০১৫ সালে সেন্ট যোসেফ উচ্চমাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এসএসসি উতরানোর পর সম্পূর্ণ বৃত্তিতে পড়ালেখার সুযোগ পান যুক্তরাজ্যের ওয়েলসে অবস্থিত আটলান্টিক কলেজে। ইউনাইটেড ওয়ার্ল্ড কলেজের আওতাধীন এই কলেজ থেকে ইন্টারন্যাশনাল ব্যাকেলরিয়েট পাস করবেন ২০১৮ সালে। সৃজন জানালেন, এই ডিগ্রি আমাদের দেশের উচ্চমাধ্যমিকের সমমানের।
যাহোক, সেখানে গিয়ে সৃজন পেলেন আরও একটি চমৎকার সুযোগ। যোগ দিলেন ওয়েলসের জাতীয় বিতর্ক দলে। আরও বড় সুযোগ, এ বছর বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে ওয়েলস জাতীয় দলের চূড়ান্ত সদস্য হয়ে লড়বেন তিনি। ঈদের ছুটিতে দেশে এসেছেন সৃজন। শিগগিরই ফিরে গিয়ে প্রস্তুতি নেবেন চ্যাম্পিয়নশিপের। আগস্টের ১ তারিখ থেকে শুরু হবে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপ, ইন্দোনেশিয়ার বালি দ্বীপে। এর আরও আগে থেকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে ওয়েলস দলকে। অক্সব্রিজ অর্থাৎ অক্সফোর্ড ও ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আসা অগ্রজেরা প্রশিক্ষণ দেবেন তাঁদের।
একটা ব্যাপারে কিছুটা আক্ষেপ আছে তরুণ এই বিতার্কিকের। তিনি জানালেন, বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশগ্রহণ করার জন্য বাংলাদেশের বিতার্কিকদের মেধার পাশাপাশি আর্থিক সচ্ছলতাও লাগে। ভিনদেশে গিয়ে বিতর্ক করার খরচটা নিজেদেরই দিতে হয়। এমনকি চূড়ান্ত দলের সঙ্গে যেতে হয় অভিভাবকদের। তাঁদের সঙ্গে থাকেন না কোনো কোচ কিংবা ব্যবস্থাপক। সৃজন বলেন, ‘বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিতে গণিত অলিম্পিয়াডের মতো আমাদের বাংলাদেশ জাতীয় বিতর্ক দলের জন্যও পৃষ্ঠপোষক বা স্পনসরের খুব প্রয়োজন।’
শিক্ষাজীবন শেষ করেও সৃজন থাকতে চান বিতর্কের মঞ্চে। অংশ নিতে চান উন্মুক্ত বিতর্কে। জানালেন, উন্মুক্ত বিতর্কে শিক্ষার্থীরা ছাড়াও যেকোনো বয়সের মানুষ অংশ নিতে পারেন।
ছোট্ট করে সৃজনের আরও দুইটা অর্জনের কথা বলতে হয়। ২০১৩ সালে পেয়েছেন ইউনিসেফের ‘মিনা অ্যাওয়ার্ড’। শিশু নির্যাতনের ওপর একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ছবি বানিয়ে পেয়েছেন সেই পুরস্কার। আর ২০১৫ সালে ‘স্টকহোম জুনিয়র ওয়াটার প্রাইজ’ প্রতিযোগিতার চূড়ান্ত দলে ছিলেন তিনি। হাত ধোয়া ও গোসলে ব্যবহৃত পানি অপচয় না করে পুনরায় কীভাবে কৃষিতে কাজে লাগানো যায়, সেই প্রকল্প নিয়ে সৃজনের দল গিয়েছিল স্টকহোমে। এবার ‘এমআইটি ওয়াটার ইনোভেশন অ্যাওয়ার্ড’ প্রতিযোগিতায় তাঁর দলের ২০১৭ সংস্করণের এই ‘ওয়াটার প্রজেক্ট’ ছিল শীর্ষ ৩০-এ। সৃজন বিশ্বাস করেন, সব সময় জয়ী হওয়াটাই শেষ কথা নয়। অংশগ্রহণ করাই কখনো কখনো বড় জয়।