বিশ্বনেতাদের সঙ্গে এক মঞ্চে
- তাসনীম ওমর
২০১৬ সালে এই স্বপ্ন নিয়ে পাতাতেই একটা খবরে আমার চোখ আটকে গিয়েছিল। যুক্তরাজ্যের রানি এলিজাবেথের হাত থেকে পুরস্কার নিয়েছেন এক বাংলাদেশি তরুণ, তাঁর নাম ওসামা বিন নূর। জানলাম, ‘ইয়ুথ অপরচুনিটিজ’ নামে অনলাইনে তরুণদের জন্য একটা ‘প্ল্যাটফর্ম’ তৈরি করে এই সম্মাননা পেয়েছেন ওসামা। যার মাধ্যমে বিশ্বের নানা প্রান্তে তরুণদের জন্য যেসব সুযোগ তৈরি হচ্ছে, তার খবর পাওয়া যায়। গত বছর হাল্ট প্রাইজ প্রতিযোগিতায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আমরা চারজন অংশ নিয়েছিলাম। শেষ পর্যন্ত সেরা পাঁচে জায়গা পেয়েছিল আমাদের উপস্থাপিত ‘স্টার্টআপ’। তাই ইয়ুথ অপরচুনিটিজের মাধ্যমে খোঁজ রাখতে শুরু করলাম, কীভাবে আমার ‘হাল্ট প্রাইজ’-এর অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে আরও বড় কিছুর অংশ হওয়া যায়।
এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসে পেয়ে গেলাম একটা সুযোগের খোঁজ। ‘ইউরোপিয়ান ডেভেলপমেন্ট ডেইজ’ (ইডিডি) নামের একটি সম্মেলন আয়োজন করে ইউরোপিয়ান ইউনিয়ন (ইইউ)। সেখানে জাতিসংঘ ঘোষিত ‘টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা ২০৩০’ প্রকল্পে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের দেশগুলোর ভূমিকা মূল্যায়ন করা হয়। ইইউর অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোর প্রধানমন্ত্রী, প্রেসিডেন্ট, রাজপরিবারের সদস্য, সরকারি কর্মকর্তাসহ বিশিষ্টজনেরা এই সম্মেলনে অংশ নেন। শুধু তা-ই নয়, তাঁদের সঙ্গে ভাবনা ভাগাভাগি করে নিতে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয় ১৬ জন তরুণকে। এই ১৬ জনের তালিকায় জায়গা পাওয়ার পূর্বশর্ত হলো, থাকতে হবে নেতৃত্বগুণ আর অনন্য কিছু অর্জন। ভেবে দেখলাম, এমন একটা সুযোগের জন্যই তো আমি মুখিয়ে ছিলাম!
বেলজিয়ামের ব্রাসেলসে ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রধান কার্যালয়। জানলাম, সেখানেই সম্মেলনটির আয়োজন হবে। ভিসার বন্দোবস্ত থেকে শুরু করে সব খরচ বহন করবে ইইউ। সুযোগটা যতটা আকর্ষণীয়, আবেদনপ্রক্রিয়া ততটাই জটিল। ধৈর্য ধরে একেকটা নির্দেশনা অনুসরণ করলাম। আমার কার্যক্রমের প্রমাণস্বরূপ কাগজপত্র সব প্রস্তুত করলাম। সব শেষে আমার পরিচয়, আমি কেন এই সম্মেলনে যোগ দেওয়ার যোগ্য—এসব উপস্থাপন করে দুই মিনিটের একটা ভিডিওচিত্রও তৈরি করতে হলো। আবেদনপত্র জমা দিলাম একদম শেষ দিন, ৯ মার্চ।
এর প্রায় এক মাস পর, এ বছর পয়লা বৈশাখের দিনে নববর্ষটা আমার জন্য সত্যিই ‘শুভ’ হয়ে এল। ১৪ এপ্রিল ই-মেইলের মাধ্যমে জানলাম, ১৬ জন তরুণ নেতার মধ্যে অন্যতম হিসেবে আমি নির্বাচিত হয়েছি! বাংলাদেশ থেকে আমিই প্রথম এই সুযোগ পেলাম। অন্য তরুণেরা এসেছিলেন আফ্রিকা, দক্ষিণ আফ্রিকা, ইউরোপ, নেপাল, মঙ্গোলিয়া ও ফিলিপিন থেকে। ৩১ মে আমরা সবাই ব্রাসেলসে জড়ো হলাম।
অবশেষে ৭-৮ জুন অনুষ্ঠিত হলো ইউরোপিয়ান ডেভেলপমেন্ট ডেইজ। যদিও ১ জুন থেকেই আমরা প্রস্তুতি নিতে শুরু করেছিলাম। বিশ্বনেতাদের সঙ্গে একই কাতারে বসে মতবিনিময় করতে হবে, সে তো চাট্টিখানি কথা নয়! তাই প্রায় এক সপ্তাহ ধরে ইউরোপিয়ান কমিশনের সেরা বক্তারা আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন। আমি খুবই সৌভাগ্যবান, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট জিন-ক্লড জাকার, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও উন্নয়ন কমিশনার নেভেন মিমিকা, বৈদেশিক সম্পর্ক ও নিরাপত্তাব্যবস্থার দায়িত্বে থাকা ফেডেরিকা মোঘরিনি, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের উপমহাসচিব আমিনা মোহাম্মদের মতো মানুষদের সঙ্গে আমরা অভিজ্ঞতা ও ভাবনা ভাগাভাগি করে নেওয়ার সুযোগ পেয়েছি। খুব অবাক হয়ে লক্ষ্য করলাম, ইইউর সদস্য দেশগুলোর নেতাদের কথা তাঁরা যতটা গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করেন, একই রকম গুরুত্ব দিয়ে তাঁরা আমার কথাও শুনলেন!
৬ জুন আমাদের সম্মানে নৈশভোজের আয়োজন করেছিলেন বেলজিয়ামের রানি মাটিলডে ম্যারি ক্রিস্টিয়ান গিসলেন। নৈশভোজের সঙ্গে ছিল কনসার্টও। ৭ জুন বেলজিয়ামের রানি, নরওয়ের প্রধানমন্ত্রীসহ বেশ কয়েকটি দেশের নেতৃত্বে থাকা বিশিষ্টজনেরা উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখার জন্য সম্মিলিত চুক্তি স্বাক্ষর করলেন। আমরাও সেদিন উপস্থিত ছিলাম।
তবে আমার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ দিনটি ছিল ৮ জুন। নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূস, কলম্বিয়া ইউনিভার্সিটির আর্থ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক জেফরি স্যাকস, ইউএন ব্রাসেলস রিপ্রেজেন্টেশন অফিসের পরিচালক বারবারা পেসকের মতো বিশিষ্টজনদের সঙ্গে একই মঞ্চে বসে দর্শকদের সামনে আমি বাংলাদেশের তরুণদের প্রতিনিধিত্ব করেছি। শুনেছি ইউরোপিয়ান ডেভেলপমেন্ট ডেইজের ইতিহাসে এই প্রথম একই দেশের দুজন মানুষ একসঙ্গে একই সভায় নেতৃত্ব দিলেন—আমি আর ড. মুহাম্মদ ইউনূস! মঞ্চে আমরা দুজন পাশাপাশি বসেছিলাম।
কীভাবে বেসরকারি খাতের ছোট ছোট স্টার্টআপও জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে ভূমিকা রাখছে, এ নিয়েই কথা হচ্ছিল আমাদের সভায়। আমি কথা বলেছি আমাদের দেশের পোশাকশিল্প নিয়ে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ তৈরি কাপড়ের বাজার হওয়া সত্ত্বেও, এখনো আমাদের এখানের শ্রমের মূল্য খুব ‘সস্তা’ ধরা হয়। জোর গলায় বলেছি, যত সস্তায় বাইরের বিশ্ব আমাদের শ্রমিকদের শ্রম কিনে নিচ্ছেন, তাঁদের শ্রমের মূল এতটাও সস্তা নয়। দর্শক যখন তুমুল করতালিতে আমার কথায় সমর্থন জানালেন; মনে হলো এত বড় সভায় আমি বাংলাদেশের একটা ২৩ বছর বয়সী একলা মেয়ে নই, আমার সঙ্গে বাংলাদেশের ৩২ লাখ ‘সস্তা’ শ্রমিকও আছেন।