রোবট কারিগর রিনি ও রাকিব
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
বাংলাদেশে রোবটিক্স চর্চার চল বেশ ক’বছর আগে থেকে শুরু হয়েছে। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের প্রায়ই দেখা যায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে নজরকাড়া সাফল্য নিয়ে আসতে। একটু লক্ষ্য করলে দেখা যাবে, যেসব বিশ্ববিদ্যালয় এ ধরনের প্রতিযোগিতায় ভাল করছে তাদের অধিকাংশই ছাত্র এবং সিংহভাগ ঢাকা-কেন্দ্রিক। আরেকটু বিশ্লেষণ করলে কারণ খুঁজে পেতেও খুব বেশি কষ্ট করতে হয় না। রোবটিক্স চর্চার প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ সাধারণত ঢাকাতেই সহজলভ্য যা সংগ্রহ করতে ঢাকার বাইরে থেকে বেশ বেগ পেতে হয়।
চট্টগ্রাম প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (চুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রিনি ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) যন্ত্রকৌশল বিভাগের রাকিব ২০১০ সাল থেকে কাজ করছেন রোবট নিয়ে। এর মধ্যেই তারা গড়ে তোলেন ‘প্ল্যানেটর লিমিটেড’ নামের প্রতিষ্ঠানটি। গত দেড় বছরের প্রচেষ্টায় ‘প্ল্যানেটার লিমিটেড’-এর বাণিজ্যিকভাবে তৈরি হয়েছে ‘রিরা’ নামের এই রোবট। ২০১১ সালের আন্তঃবিশ্ববিদ্যালয় রোবটিক প্রতিযোগিতায় ২৪টি দলের মধ্যে রাকিব তৃতীয় ও রিনি চতুর্থ স্থান লাভ করেন। এরপর ২০১৩ সালে রিনি মার্কিন মহাকাশ সংস্থা নাসার রোবট তৈরির প্রতিযোগিতায় অংশ নেন।
অফিস-বাসা দুটোই সামলাবে তৈরি রোবটটি। মনে করেন, অফিসে বস এখনো পৌঁছাতে পারেননি। এদিকে কিছুক্ষণ পরেই জরুরি সভা শুরু হবে। সহকর্মীরা কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না। বস ছাড়া তো শুরুও করা যাচ্ছে না! অগত্যা অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কী! এমন সময়ে হঠাত্ ঘরে এসে ঢুকল ছোট্ট একটি রোবট। সবাইকে অবাক করে দিয়ে সময়মতো সভাও শুরু হয়ে গেল। পাঠক, ভাববেন না, রোবট আজকাল অফিস নিয়ন্ত্রণ করার কাজটি শুরু করেছে। সভায় কিন্তু বসই উপস্থিত ছিলেন। ‘রিরা’ নামের ওই রোবটের মাধ্যমে অফিস-প্রধান সামলে নিয়েছেন তার কাজকর্ম।
দূর থেকেই ব্যক্তির উপস্থিতি নিশ্চিত করবে রোবটটি। এজন্য একে বলা হচ্ছে টেলিপ্রেজেন্স রোবট। মুঠোফোনের ইন্টারনেট দিয়ে একে নিয়ন্ত্রণ করা যায় খুব সহজেই! রিরার পর্দায় আপনাকে যেমন অন্যরা দেখতে পাবেন, তেমনি আপনিও পাবেন অন্যদের দেখা। অনেকটা মুঠোফোনে ভিডিও কলের মতো। তবে এই পদ্ধতির সঙ্গে রিরার পার্থক্য হলো, এটা হাতে নিয়ে ঘুরতে হবে না। যে কেউ দেশের বাইরে থেকেও এটিকে সব জায়গায় ঘোরাতে পারবেন!
প্ল্যানেটর লিমিটেডের প্রধান নির্বাহী রিনি ঈশান জানান, যেখানে আলাদা জায়গায় সিসি ক্যামেরা লাগাতে হয়, সেখানে ‘রিরা’ সব জায়গায় চলাচল করতে পারে।
অন্যদিকে কর্মজীবী একজন মায়ের প্রায় আট-নয় ঘণ্টা কেটে যায় অফিসেই। রিরাকে ব্যবহার করে কর্মজীবী তারা বাচ্চার সঙ্গে কথা বলার পাশাপাশি, বাচ্চার দেখভালও করতে পারবেন। প্রতিষ্ঠানটির প্রধান প্রযুক্তি কর্মকর্তা রাকিব রেজা জানান, কল-কারখানা, বড় বড় শপিং মলেও ব্যবহার করা যাবে এই রোবটকে।
পশ্চিমা দেশগুলোতে এখন হরহামেশাই রিরার মতো রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। সেগুলোর দাম ২ হাজার ৫০০ মার্কিন ডলারের মতো। সেখানে রিনি ও রাকিব জানান, রোবটটিকে এখন ১ লাখ ১৫ হাজার টাকায় যে কেউ কিনতে পারবেন। এর আগেও দুইবার বাণিজ্যিকভাবে এটিকে তৈরি করেছিলেন তারা। প্রথমবার বানিয়েছিলেন দেশীয় যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে। কিন্তু সেগুলোর মান ভালো না হওয়ায় তারা রোবটের ওয়ারেন্টি দিতে পারছিলেন না। এবার দেশের বাইরে আমেরিকা, হংকং, চীন ও মালয়েশিয়া থেকে যন্ত্রপাতি আনিয়ে তৈরি করা হয়েছে রোবটটি। রোবটটি তৈরিতে তাদের সহযোগিতা করেন বন্ধু কায়সার রায়হান।
রোবট তৈরিতে যেভাবে আকৃষ্ট হলেন রিনি: রোবটিক্সে আগ্রহ হওয়ার কারণ হিসেবে রিনি জানান, একদম ছোটবেলা থেকে সায়েন্স ফিকশানের প্রচুর বই পড়তাম। আম্মুও সেরকম বই কিনে দিতেন। বইগুলো থেকেই রোবট সম্পর্কে ধারণা পাই। মনে করতাম, বড় হয়ে রোবট বানাবো, চাঁদে যাব, মহাকাশে ঘুরে বেড়াব। এসব চিন্তা-ভাবনা আমার খুব প্রিয় ছিল। আমার মা এসব কল্পনাগুলো মনোযোগ দিয়ে শুনতেন, উত্সাহ দিতেন। এছাড়াও ওই রকম কিছু করার বিভিন্ন বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর সিনেমা দেখেও আগ্রহ জন্মাতো। এক সময় চুয়েট-এর যন্ত্রকৌশল বিভাগে ভর্তি হলাম কিন্তু গতানুগতিক পড়াশোনার বাইরের কিছু করার ইচ্ছা প্রবল ছিল। এ সময় টিউশনির টাকা গুছিয়ে ঘরে একটা ল্যাব বানিয়েছিলাম। আম্মু বাসার একটা ঘর খালি করে দিলেন। এই ল্যাব থেকেই রোবট বানিয়ে অংশগ্রহণ করেছিলাম বাংলাদেশের জাতীয় পর্যায়ের রোবট প্রতিযোগিতা ‘রোবোরেস’। সে প্রতিযোগিতায় গিয়েছিলাম সেমিফাইনাল পর্যন্ত। এ ঘটনা আমাকে প্রচন্ড উৎসাহিত করেছিল।