লুনাবটিক্স প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের সাফল্য
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
‘মঞ্চে বসে আছেন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার প্রধান চার্লস বোল্ডন, কেপ কেনেডি স্পেস সেন্টারের প্রধান রবার্ট ডি কাবানাসহ নাসার খ্যাতিমান সব গবেষক আর নভোচারীরা। আর আমাদের মঞ্চে ডাকা হচ্ছে। সেই ডাক না শুনে পারা যায় নাকি? তাই তো নাম ধরে ডাকার সঙ্গে সঙ্গে দৌড় দিলাম মঞ্চের দিকে।’ এভাবেই নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানাচ্ছিলেন মিলিটারি ইনস্টিটিউট অব সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজির (এমআইএসটি) শিক্ষার্থী শুভেচ্ছা চক্রবর্ত্তী। গত ২০ থেকে ২৪ মে যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডায় নাসা আয়োজিত লুনাবটিক্স মাইনিং প্রতিযোগিতায় বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা তাঁদের ভিন্ন মাত্রার এক সাফল্যের গল্প রচনা করেন। এমআইএসটির ‘লুনাবটিক্স একুশ’ দলের শিক্ষার্থীরা চাঁদে যাওয়ার রোবট নির্মাণ এই প্রতিযোগিতায় আউটরিচ প্রজেক্ট রিপোর্ট বিভাগে প্রথম স্থান লাভ করেন। এই অর্জনে তাঁরা জিতে নেন ৫০০ ডলার পুরস্কার। এ ছাড়া তাঁদের রোবট ‘রোবোমিস্ট ২’ তারহীন যোগাযোগব্যবস্থা, সক্ষমতা, কাজের গতি-প্রকৃতির ওপর দ্বিতীয় সেরা হিসেবে জিতে নেয় সিস্টেমস ইঞ্জিনিয়ারিং পেপার পুরস্কার।
যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, অস্ট্রেলিয়াসহ বিভিন্ন দেশের বিশ্বসেরা ৫০টি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সমকক্ষ হিসেবে নিজেদের পরিচিতি জানান দিলেন বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরা।
দলের আট সদস্যদের মধ্যে শুভেচ্ছা চক্রবর্ত্তী, শামাউন সোবহান, তাসমিরুল জলিল গিয়েছিলেন যুক্তরাষ্ট্রে। পরীক্ষার কারণে দলের অন্য সদস্য বদিউজ্জামান, রেজওয়ানুল হক, সামির শাকির, রায়হান সিদ্দিকি ও সৈয়দ এহসানুর রহমান যুক্তরাষ্ট্রে যেতে পারেননি। এ ছাড়া এমআইএসটির এই শিক্ষার্থীদের রোবট দলটি আরও দুটি সম্মানসূচক পুরস্কার জিতেছেন, যেগুলোর নাম টিম স্পিরিট পদক এবং প্রথমবারের মতো চালু হওয়া লুনা ওয়ার্ল্ডওয়াইড ক্যাম্পেইন পুরস্কার।
তবে এসব পুরস্কার পাওয়ার পরও আক্ষেপ রয়ে গেছে দলের সদস্যদের। সামাউন বলেন, ‘প্রতিযোগিতার শীর্ষ ১০-এর মূল পর্বে অংশ নিতে পারলে আরও ভালো লাগত।’
দলের অন্য সদস্য তাসমিরুল বলেন যুক্তরাষ্ট্রে তাঁদের শুরুর দিনগুলোর কথা, ‘দুই দিনের যাত্রা শেষে আমরা গিয়ে পৌঁছালাম ফ্লোরিডায়। তারপর ১৯ মে পুরোটা দিন কেটে গেল লুনাবটটির হাত-পা জোড়া লাগাতে লাগাতে।’ ২০ তারিখে প্রথম লুনাবটটিকে পরীক্ষা করার সুযোগ পান শিক্ষার্থীরা, যদিও মূল প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল ২২ মে। বাংলাদেশ থেকে নিয়ে যাওয়া গামছা ও নাড়ু-মণ্ডা নিয়ে প্রতিযোগিতার অন্য শিক্ষার্থীদের মনোযোগ আকর্ষণ করেন তাঁরা। স্বয়ং প্রতিযোগিতার বিচারকেরা নাকি গামছা আর মিষ্টির গুণে মুগ্ধ ছিলেন। তাসমিরুল বলেন, ‘আমাদের গামছা দেখে আর মিষ্টি খেয়ে তো তাঁরা বেশ আনন্দ পেয়েছিলেন। আমাদের এই আতিথেয়তা দেখে সত্যিই তাঁরা বেশ প্রশংসা করেছিলেন।’
২২ ও ২৪ মে এমআইএসটি দলকে মাঠে নামতে হয় মূলপ্রতিযোগিতায় অংশ নিতে।
পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে হাজির হয়েছিলেন মহাকাশ জয়ের অন্যতম কারিগর নাসার প্রজেক্ট ম্যানেজার জো কসমো। সেই ষাটের দশক থেকে তিনি মহাকাশ মিশন মার্কারি, জেমিনি, চাঁদে যাওয়ার মিশন অ্যাপোলো, খেয়াযান স্কাইল্যাব, স্পেস শ্যাটলগুলোর মিশনের ম্যানেজার হিসেবে কাজ করে আলোচিত। পুরস্কার প্রদানের সময়ের কথা বলেন তাসমিরুল, ‘হঠাৎ করেই বাংলাদেশ নামটি শুনে চমকে উঠি। ফ্লোরিডার ২৮ ডিগ্রি তাপমাত্রার মধ্যেও সারা শরীরের রক্ত হিম হয়ে আসছিল। নাসার গবেষক ও বিচারকদের কাছ থেকে আমরা সম্মাননা ও পুরস্কার তুলে নিই। এর থেকে সম্মানের আর কী হতে পারে? তখন আমরা ছিলাম বাকরুদ্ধ!’
শামাউন বলেন, ‘চারটি বিষয়ে আমরা সম্মাননা ও পুরস্কার লাভ করি বলে আমাদের বারবার মঞ্চে যেতে হচ্ছিল। একটি সম্মাননা পাওয়ার আনন্দে যখন কথা বলতে পারছিলাম না, তখনই অন্য আরেকটি সম্মানসূচক পদকের জন্য আমাদের ডাকা হয়। আমাদের এমন ফলাফলে বাংলাদেশের অন্যান্য দলসহ সবাই চিৎকারে সারা মিলনায়তন কাঁপিয়ে তুলছিল।’
বাংলাদেশ থেকে এমআইএসটি ছাড়াও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট), চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও কারিগরি বিশ্ববিদ্যালয় (চুয়েট), গাজীপুরের ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি), নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তাঁদের লুনাবট নিয়ে অংশ নিয়েছিলেন মাইনিং কম্পিটিশনে।
শিক্ষার্থীদের সামগ্রিক সাফল্যে নাসার বিচারকেরাও ছিলেন অবাক। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের উচ্চ প্রত্যাশার কথা শোনা যায় তাঁদের সামাজিক যোগাযোগের সাইট ফেসবুক ও টুইটার-বার্তায়। কেনেডি স্পেস সেন্টারে প্রকৌশলী হিসেবে কর্মরত ও প্রতিযোগিতার সহযোগী বিচারক শাকিল ফেরদৌসি অনলাইনে বলেন, ‘প্রতিযোগিতার প্রেজেন্টেশন বিচারক ছিলেন আমার সহকারী। তিনি বাংলাদেশকে নিয়ে বেশ উচ্ছ্বসিত ছিলেন।’
গত কয়েক বছর বাংলাদেশের নামটি নাসার ওয়েবসাইটে (nasa.gov/ offices/ education/ centers/ kennedy/ technology/lunabotics.htm) অংশগ্রহণকারী হিসেবেই দেখতে পাওয়া যেত। কিন্তু এবার থেকে আর আক্ষেপ করতে হবে না। বিজয়ী বাংলাদেশকে দেখে আসতে ঢুঁ মারতে পারেন নাসার ওয়েবসাইটে।