হেমন্ত সাদীকের হলিউড যাত্রা
- ক্যাম্পাস ডেস্ক
প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ থেকে কোনো স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হলিউডের গ্লোবাল ইউথ ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হতে যাচ্ছে! এই খবরে মুখরিত যখন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র অঙ্গন, তখন পেছন ফিরে এক টুকরো অতীত দেখেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগের শিক্ষার্থী সাদীকুর রহমান, পরিচালক হিসেবে যার নাম হেমন্ত সাদীক, যিনি নির্মাণ করেছেন ‘এ লেটার টু গড’ এবং যে চলচ্চিত্রটি আগামী ৭ অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের লস অ্যাঞ্জেলেস স্কুলে অনুষ্ঠিতব্য গ্লোবাল ইউথ ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শনের জন্য রয়েছে ‘অ্যাওয়ার্ড উইনিং’ তালিকায়। সেই পরিচালক কেন সুখের দিনে নিজের অতীতের দিকে তাকান? কারণ, সাদিক বলেন, ‘জয়পুরহাটের পাঁচবিবি থেকে যাত্রা শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের হলিউড অব্দি পৌঁছাটা অবশ্যই আনন্দের, কিন্তু এ জন্য দীর্ঘ ক্লান্তিকর এক সংগ্রামমূখর পথ পাড়ি দিতে হয়েছে আমাকে।’
একটু দম নিয়ে সাদীক আবার বলেন, পড়ালেখা করতাম রাজশাহীর এক মাদরাসায়। নাটক, সিনেমার কিছুই বুঝতাম না। তবে আবৃত্তি, সাধারণ জ্ঞান, রচনা লেখা ইত্যাদি প্রতিযোগিতায় অংশ নিতাম। একদিন পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দেখলাম ‘আমার দেখা প্রিয় চলচ্চিত্র’ শিরোনামে রচনা প্রতিযোগিতার আহ্বান জানিয়েছে আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসব কমিটি। প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে ইচ্ছে হলো। কিন্তু আমি তো কোনো চলচ্চিত্র দেখিনি!
ভাবনায় পড়লেন হেমন্ত সাদীক। কী করা যায়। হঠাৎ মনে পড়ল দীপু নাম্বার টু’র কথা। কোনো একদিন পত্রিকায় পড়েছিলেন দীপু নাম্বার টু উপন্যাস থেকে নির্মাণ করা হয়েছে চলচ্চিত্রটি। তিনি পুরনো বইয়ের দোকান থেকে কিনে ফেললেন বইটি এবং সেটা পড়েই লিখে ফেললেন একটি রচনা। কী সৌভাগ্য! সেই রচনার জন্যই ডাক পেলেন বাংলাদেশের প্রথম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে অংশ নেওয়ার।
‘সেই উৎসবে যোগ দেওয়ার পর জীবন-জগৎ সবকিছু পাল্টে গেল আমার।’ বলছিলেন হেমন্ত সাদীক। সেই যে সিনেমার পোকা মাথায় ঢুকে গেল, আজ অব্দি বের হয়নি সেটা।
উচ্চমাধ্যমিক পাশ করার পর ভর্তি হয়েছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগে। কিন্তু খুব বেশিদিন মন টেকেনি সেখানে। পরে ভর্তি হয়েছেন ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির সাংবাদিকতা ও গণযোগাযোগ বিভাগে। এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি নির্মাণ করতে থাকেন স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। এ পর্যন্ত সাতটি স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন মেধাবী এই পরিচালক। তবে সবচেয়ে বেশি সাড়া পেয়েছেন ‘এ লেটার টু গড’ নির্মাণের পর। ইতিমধ্যে মরক্কোতে অনুষ্ঠিত অওরজাজাত ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভালের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে এ লেটার টু গড এবং চীনে অনুষ্ঠিত থার্ড এশিয়া ইউথ মাইক্রো ফিল্ম এক্সিবিশনের মূল প্রতিযোগিতা বিভাগে প্রদর্শিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। এছাড়া ফিলিপাইনের সিনেমাঙ্গা ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল, মেক্সিকোর ফিফথ ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল, গ্র্যান্ড বাহামায় অনুষ্ঠিত ক্যারিবিয়ান ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভাল এবং মিশরের এ.এম ইজিপ্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি। শুধু তাই নয়, আগামী ৭-১১ নভেম্বর নরওয়েতে অনুষ্ঠিতব্য রিঙ্গেরিক ইন্টারন্যাশনাল ইউথ ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হবে এ লেটার টু গড। অপরদিকে আগামী ৯ নভেম্বর ইতালির সিত্তাদেল্লাতে অনুষ্ঠিতব্য জিয়ো ফিল্ম ফেস্টিভাল অ্যান্ড এক্সপোতে প্রদর্শনের জন্য নির্বাচিত হয়েছে চলচ্চিত্রটি।
এ লেটার টু গড-এর পরিচালক হেমন্ত সাদীক ইতিমধ্যে ১০ম আন্তর্জাতিক শিশু চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা তরুণ নির্মাতার পুরস্কার অর্জন করেছেন। এছাড়া সিলেট চলচ্চিত্র উৎসবে সেরা স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের পুরস্কার পেয়েছে মারমা ভাষা ও বাংলা ভাষায় নির্মিত এ চলচ্চিত্রটি।
এসব অর্জন নিঃসন্দেহে আনন্দের জোয়ারে ভাসায় তরুণ সাদীককে, কিন্তু যে পথ পেরিয়ে এই অর্জন সেই পথকে ভুলতে পারেন না তিনি। সাদীক জানান, ২০১২ সালে ঢাকার পাবলিক লাইব্রেরিতে হঠাৎ পেয়েছিলেন মেক্সিকান লেখক গ্রেগরিও ওয়াই ফুয়েন্তেসের লেখা গল্প ‘এ লেটার টু গড’। গল্পটি পড়ার পরই সিদ্ধান্ত নেন, এই গল্প নিয়েই সিনেমা বানাবেন তিনি। কিন্তু টাকা পাবেন কোথায়? এর ওর দুয়ারে দুয়ারে কয়েক বছর অবিশ্রান্ত ঘোরাঘুরির পর অবশেষে ২০১৬ সালে এগিয়ে এলেন এক প্রযোজক। তিনি অর্থ লগ্নি করতে রাজি, কিন্তু কিছুতেই নাম প্রকাশ করতে আগ্রহী নন। ফলে হেমন্ত সাদীকও উহ্য রাখেন তার নাম।
টাকা তো পেলেন, কিন্তু শ্যুটিং করবেন কোথায়? অভিনয়ই বা করবে কে? হেমন্ত সাদীক বলেন, সেটা আরেক সংগ্রাম। লোকেশন খুঁজতেই বাজেটের প্রায় অর্ধেক টাকা শেষ হয়ে গেল। অবশেষে বান্দরবান থেকে ১২ কিলোমিটার দূরে এক পাহাড়ের পাদদেশে পেলেন কাক্সিক্ষত লোকেশন। শুরু হলো শ্যুটিং। সিনেমাটোগ্রাফার চান ব্যাকরণসম্মতভাবে দৃশ্য ধারণ করতে, কিন্তু সাদীক তো ব্যাকরণ মানবেন না। তিনি চান ব্যাকরণ বহির্ভূতভাবেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে। এভাবে নানা ঘাত প্রতিঘাত পেরিয়ে তিনবার এডিটিং শেষে অবশেষে সমাপ্ত হয় এ লেটার টু গড। তাই বারবার পেছন ফিরে তাকান হেমন্ত সাদীক।
তবে আর অতীতের কথা নয়, এবার ভবিষ্যতের ভাবনা জানান তরুণ এ পরিচালক। বলেন, ব্যাকরণের বাইরেই চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে চান তিনি। বদলে দিতে চান ক্যামেরার ভাষা। এতদিন যে ভাষায় কথা বলেছে চলচ্চিত্রের ক্যামেরা, সেই ভাষাকে মুক্তি দিতে চান তিনি। ইচ্ছে আছে, আগামী বছরেই পূর্ণদৈর্ঘ্য বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র নির্মাণে হাত দেওয়ার। নবীন এ চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্য শুভ কামনা।