আমার কানাডার অভিজ্ঞতা
- রেহনুমা ইসলাম মীম
একজন উচ্চ-আশাবাদী মানুষ হিসেবে জ্ঞান ও দক্ষা অর্জনের জন্য পৃথিবীব্যাপী ঘুরে বেড়ানোই আমার স্বপ্ন। সেই স্বপ্ন পূরনের প্রথম ধাপ ফেলি এ বছরের সেপ্টেম্বরে। ওহ! বলাই হয়নি তো আমার নাম। আমি রেহনুমা মিম। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে লেকচারার হিসেবে কাজ করছি। যা বলছিলাম, ওই সেপ্টেম্বরে আমি কানাডার মন্ট্রিলে যাই ‘ট্রেনিং দ্য ট্রেইনার্স’ নামের একটি কর্মসূচিতে অংশ নিতে; যার আয়োজক ছিল বিশ্বের অন্যতম মর্যাদাপূর্ণ বিজনেস স্কুল ‘এইচইসি মন্ট্রিল’।
ছাত্র বয়স থেকেই আমি আমার প্রাতিষ্ঠানিক পড়াশোনার বাইরেও বিভিন্ন সেক্টরে কাজ করতাম। কারণ আমার ছিল জ্ঞানার্জনের অসম্ভব উচ্চাশা। এরকম সময়ে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির পক্ষ থেকে আমাকে বলা হয় কানাডার এই কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ করতে। প্রশিক্ষণটা ছিল সোস্যাল বিজনেস ক্রিয়েশন (এসবিসি) প্রতিযোগিতার একটি অংশ। প্রতিযোগিতাটি চলত ছয় মাস ধরে এবং এই প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারীদেরকে শেখানো হয় কীভাবে ব্যবসায় পরিকল্পনা করতে হয়। বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে ৫৩টি দল এ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছিল, যার মধ্যে ছিল ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ‘মেডিশিউর’ দল। বলা প্রয়োজন, ওই দলের মেনটরিংয়ের দায়িত্বে ছিলাম আমি।
এরপর এক রৌদ্রজ্জ্বল দিনে ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির ইন্টারন্যাশনাল অ্যাফেয়ার্স অফিস থেকে আমাকে জানানো হলো যে তারা আমাকে মন্ট্রিলের এই ট্রেনিংয়ে পাঠাতে চান। খবরটি শোনার পর আমার চোখে আনন্দে পানি চলে এসেছিল। নতুন দেশ, নতুন সংস্কৃতি, নতুন জ্ঞান ও অভিজ্ঞা অর্জন করতে পারব। এমন সুযোগ আর ক’জনের ভাগ্যে জোটে!
মন্ট্রিলের এই ভ্রমন ছিল আমার জীবনের প্রথম ‘একাকী ভ্রমন’। স্বাভাবিকভাবেই আমি একটু নার্ভাাস ছিলাম। কিন্তু যখন প্লেনে উঠলাম, তখন সমস্ত উদ্বেগ এক মুহূর্তে উত্তেজনায় পরিণত হয়ে গেল। মন্ট্রিলে পৌঁছার পর এসবিসির প্রধান এবং সহযোগী অধ্যাপক মিস মাই থাই থান থাই আমাকে উষ্ণ অভ্যর্থনা জানান।
কানাডায় প্রথম যে সমস্যার মুখোমুখি হলাম সেটার নাম সড়ক নির্দেশনা। কারণ বেশির ভাগ নির্দেশনা ছিল ফরাসি ভাষায় লেখা। নির্দেশনা না বুঝতে পেরে একবার তো হারিয়েই গিয়েছিলাম! পরে এক ভদ্রমহিলা আমাকে বিপদ থেকে উদ্ধার করেন। আমি ভীষণ আশ্চর্য হয়েছিলাম, কারণ আমি তার কাছে কোনো সাহায্য চাইনি। তিনি আমাকে দেখেই হয়ত বুঝতে পেরেছিলেন যে আমি পথ হারিয়ে ফেলেছি। তাই কোনোকিছু জিজ্ঞেস না করেই আমাকে সঠিক রাস্তা দেখিয়ে দিয়েছিলেন।
এরমধ্যে আমার প্রশিক্ষণ শুরু হয়ে যায়। এটা ছিল সম্পূর্ণ ভিন্ন এক অভিজ্ঞতা। ক্লাস, প্রশিক্ষণ সবকিছুই ছিল অতিমাত্রায় পরিকল্পিত। শিক্ষকরা ছিলেন সময়ের ব্যাপারে খুবই সচেতন এবং অসম্ভব রকমের সহযোগিতাপরায়ন।
প্রশিক্ষণের অংশ হিসেবে আমি বেশ কটি শিল্প প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনের সুযোগ পেয়েছিলাম। আমাদেরকে ‘ইয়ং প্রজেক্ট’, ‘পপাপ ক্যাম্প’, ‘লা স্টেশন এফ-এমআর’ ইত্যাদি ঘুরে দেখানো হয়। সবচেয়ে বেশি মুগ্ধ হয়েছি ‘কোয়া ভাদিস’ দেখে। এটি একটি আবাসন ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান এবং প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক ব্যবসায়ারের নীতিমালা অনুসরণ করে থাকে। আমি কখনো কল্পনাও করিনি যে একটি রিয়েল এস্টেট কোম্পানি সামাজিক ব্যবসায় পরিণত হতে পারে। এরপর আমাকে বিস্মিত করেছে যে বিষয়টি সেটি হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানটির মালিক একজন নারী। তাঁর নাম নাটালি ভোল্যান্ড। এসব জানার ও দেখার পর আমার আত্মবিশ্বাস বহুগুণ বেড়ে গেছে।
আমি সত্যিই খুব সৌভাগ্যবান যে মেক্সিকান অধ্যাপক জর্জ, গ্রেসিলা, ক্লাউডিয়া, ভেরনিক ও এস্তারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে পেরেছিলাম এবং তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিতে পেরেছিলাম।
প্রশিক্ষণের ব্যস্ত কর্মসূচির মাঝেও আমি কিছু সময় বের করে নায়াগ্রা জলপ্রপাত দেখতে গিয়েছিলাম। সে এক অসম্ভব সুন্দর দৃশ্য। ভাষায় প্রকাশ করার সাধ্য নেই। যদি কেউ কানাডা যায়, আমি বলব সে যেন নায়াগ্রা জলপ্রপাত না দেখে ফিরে না আসে। আমি আরও বলব, নায়াগ্রা জলপ্রপাতের নিচে ‘হর্নবেস্নায়ার’ নামের ফেরিতে ভ্রমন করতে। নিঃসন্দেহে এটি এক অবিস্মরণীয় স্মৃতি হয়ে থাকবে।
আমি যেহেতু গিয়েছিলাম মধ্য সেপ্টম্ববরে, সুতরাং আবহাওয়া ছিল নাতিশীতোষ্ণ। চমৎকার প্রাকৃতিক পরিবেশ। খাবারগুলোও ছিল চমৎকার। ‘পৌতিন’ তাদের এক ঐতিহ্যবাহী খাবারের নাম। স্বাদটা এখনো জিভে লেগে আছে।
কানাডার এই ভ্রমনের প্রতিটি পর্যায়, প্রতিটি ধাপ ছিল ভীষণ রোমাঞ্চকর। অনেক অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করতে পেরেছি। আমি বলব এ আমার জীবনের এক অমূল্য অভিজ্ঞতা। এখন আমি আগের তুলনায় অনেক বেশি কাজ করতে পারি। ভবিষ্যতের দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করতে পারি এবং নতুন কিছু শেখার সুযোগের সন্ধানে থাকি। এখন আমি বুঝতে পারি, সুযোগ খুব বেশি দূরে থাকে না।