বিপিও শিল্প নিয়ে দু-চার কথা
- সায়মা শওকত
বর্তমান প্রতিযোগিতামূলক বিশ্বে প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসায়িক নীতি হলো কার্যকর ও ফলপ্রসূ সেবা দিয়ে গ্রাহকদের সন্তুষ্টি বাড়ানো। এই লক্ষ্য পূরণে প্রতিষ্ঠানগুলো ক্রেতাদের কাছে পৌঁছানোর সর্বোচ্চ চেষ্টা চালিয়ে থাকে। আর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর এই প্রয়োজন মেটাতে বৈশ্বিক কল সেন্টার শিল্প/প্রতিষ্ঠান গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে। এক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলো তাদের লক্ষ্য পূরণে অন্য ব্যক্তি বা কোম্পানিকে অর্থের বিনিময়ে কাজে লাগিয়ে থাকে যাকে বলা হয় বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং (বিপিও)। এটা হতে পারে দেশের অভ্যন্তরীণভাবে, আবার আন্তর্জাতিকভাবেও। যারা ওই নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠানের স্বার্থ রক্ষায় ভোক্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ বজায় রাখে। উচ্চ কর-হার, শ্রম খরচ, সরকারি কড়া বিধি-নিষেধসহ নির্দিষ্ট কিছু ক্ষেত্রে খরচ কমাতে ছোট, মাঝারি আকারের ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের জন্য এই প্রক্রিয়া খুবই গতানুগতিক হয়ে দাঁড়িয়েছে। খরচ, ভৌগোলিক অবস্থান এবং জনবলের দিক বিবেচনায় বিপিও হতে পারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান সম্ভাবনাময় একটি শিল্প। কারণ বর্তমানে বাংলাদেশে একটি শিক্ষিত, পরিশ্রমী এবং তরুণ প্রজন্ম রয়েছে যারা চাকরির খোঁজ করছে। এই তরুণ প্রজন্মই বৈশ্বিক মাল্টিবিলিয়ন ডলারের আউটসোর্সিং বিপিও’র প্রতিযোগিতামূলক বাজারের সুবিধা নিতে পারে এবং বাংলাদেশের জন্য বড় আয়ের খাত সৃষ্টি করতে পারে।
বাংলাদেশে ২০০৮ সালের ফ্রেব্রুয়ারিতে প্রথমবারের মতো টেলিফোনভিত্তিক কল সেন্টারের লাইসেন্স দেয় বিটিআরসি। তবে এই অনুমোদন দেওয়ার পরও প্রথম কয়েক বছরে এই খাতের তেমন কোনো লক্ষণীয় অগ্রগতি হয়নি। এমনকি সরকারের তরফ থেকেও তেমন কোনো উদ্যোগও আসেনি এই শিল্পের বিকাশে। তবে বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে সাম্প্রতিককালে বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় বাংলাদেশের জন্য এই খাতে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। ডিজিটাল বাংলাদেশের লক্ষ্য পূরণে একটি দেশ হিসেবে প্রযুক্তিগত অগ্রগতির সকল সূচকে বাংলাদেশ দ্রুততার সঙ্গে উন্নতি অব্যাহত রেখেছে। বাংলাদেশের আইসিটি ডিভিশন এবং এর তরুণ প্রতিমন্ত্রী জুনায়েদ আহমেদ পলককে সঙ্গে নিয়ে ডিজিটাল বাংলাদেশের প্রধান স্বপ্নদ্রষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় ২০২১ সালের মধ্যে বিপিওকে বিলিয়ন ডলার ব্যবসা শিল্প হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছেন।
২০২৪ সাল পর্যন্ত আইটি ও আইটিইএস কোম্পানির জন্য কর অব্যাহতি, ইন্টারনেট ‘ব্যাকবোন’ এবং ব্যান্ডউইথ খরচ ২৭ হাজার থেকে ৬২৫ টাকা/এমবিপিএস-এ কমিয়ে আনা, দেশব্যাপী দুই হাজারের বেশি ডিজিটাল ল্যাব স্থাপন ও ১২টি সফটওয়্যার পার্ক প্রতিষ্ঠার মতো আরো অনেক প্রতিষ্ঠান স্থাপনের মতো যুগান্তকারী বেশ কিছু পদক্ষেপ ইতিমধ্যে নেয়া হয়েছে। বিপিও খাতে লাখ লাখ শিক্ষিত নারীকে সম্পৃক্ত করার প্রক্রিয়াও অব্যাহত আছে। গ্রামীণ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে আসা নারী জনগোষ্ঠীর দক্ষতা বাড়াতে বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মসূচির ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। ‘স্কিল অ্যান্ড এমপ্লয়মেন্ট’ কর্মসূচির আওতায় ২০ লাখ তরুণকে প্রশিক্ষণ ও কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে বিশেষ স্কিম হাতে নিয়েছে সরকার। কল সেন্টারের কাজ পরিচালনায় প্রশিক্ষণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি দিক। ভাষাগত ও কারিগরি প্রশিক্ষণ ছাড়া এই খাতের বিকাশ কিংবা এই খাতকে টিকিয়ে রাখা সম্ভব নয়। ‘কাস্টমার সার্ভিস রিপ্রেজেনটেটিভস’ বা সিএসআর’দেরকে কায়েন্টদের সঙ্গে অবশ্যই সময়মতো, ভদ্রভাবে এবং পেশাদারি আচরণ করতে হয়। কল সেন্টারের জনবলের দক্ষতা ও সমতা তৈরিতে এসইআইপি (স্কিলস ফর এমপ্লয়মেন্ট ইনভেস্টমেন্ট প্রোগ্রাম) একটি প্রথমসারির প্রাতিষ্ঠানিক কর্মকাঠামো বা ফ্রেমওয়ার্ক। যেসব ডিগ্রিধারী তরুণ এখন চাকরির খোঁজ করছে তাদের জন্য এসইআইপি খুবই উন্নত কল সেন্টার প্রশিক্ষণ সেবা দিয়ে চলেছে। বিশ্বায়নের এই যুগে ইংরেজি ভাষা এক গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেশিরভাগ ক্লায়েন্ট বা মক্কেল ইংরেজিতে কথা বলার কারণে এই আন্তর্জাতিক ভাষাকে এড়িয়ে যাওয়ার কোনো সুযোগ নেই। এ কারণে তরুণদের জন্য ভাষাগত প্রশিক্ষণ প্রদানে আরো উদ্যোগ প্রয়োজন। এসইআইপি কর্মসূচির ক্ষেত্রে ইংরেজিতে কথা বলা কিংবা যোগাযোগ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। অর্থ মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব এসইআইপি’র নির্বাহী পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি এসইআইপি কল সেন্টার ট্রেনিংয়ের মূল ফ্রেমওয়ার্কে বাধ্যতামূলকভাবে ২০ ঘণ্টার ইংরেজি ভাষা শিক্ষার সেশন যুক্ত করেছেন। এই অগ্রসরমান ধারণা যুক্ত করার পর প্রথম বছরের প্রশিক্ষণের জন্য অতিরিক্ত তহবিলও জোগাড় করতে হয়। এটা সরাসরি বিপিও শিল্পের সঙ্গে সম্পর্কিত না হলেও এ পরিকল্পনা এগিয়ে চলেছে। এ ধরনের ভবিষ্যত্মুখী চিন্তা ও ইচ্ছাশক্তি এবং লক্ষ্য পূরণের ধারা আমাদেরকে এই শিল্পের আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতামূলক ক্ষেত্রে জায়গা করে নিতে সহায়তা করবে। এরকম আরো অনেকেই আছেন যারা বাংলাদেশে কল সেন্টারের বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছেন।
বিশ্বের বড় বড় কোম্পানির কাছে বিপিও’র জন্য ভারত ও ফিলিপাইন এখন পর্যন্ত জনপ্রিয় গন্তব্যস্থল হিসেবে পরিচিত। এ খাতে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের আয় ১০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। ফিলিপাইনের আয় ২৫ বিলিয়ন, ভিয়েতনাম পাঁচ বিলিয়ন এবং শ্রীলঙ্কা ইতিমধ্যে এক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় করছে। সেখানে বাংলাদেশ এসব দেশের চেয়ে অনেক পিছিয়ে রয়েছে। বাংলাদেশকে পরবর্তী আইটি গন্তব্যস্থল হিসেবে গড়ে তুলতে হলে শ্রমঘন অর্থনীতিকে আমাদের জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতিতে রূপান্তরিত করতে হবে। বিপিও শিল্পের বিকাশে যেসব চ্যালেঞ্জ রয়েছে সেগুলো আমাদের চিহ্নিত করে সমাধান করতে হবে এবং ডিজিটাল বাংলাদেশের রোডম্যাপ অনুসরণ করতে হবে।
বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আয়ের পোশাক শিল্পখাত একদিনে গড়ে ওঠেনি। কিছু সাহসী ও ঝুঁকি গ্রহণকারী উদ্যোক্তা এই খাতের বিকাশে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন এবং যাদের দেখে শত শত মানুষ উদ্বুব্ধ হয়েছিলেন। একইভাবে বাংলাদেশে কল সেন্টার শিল্পের বিকাশে এবং আমাদের তরুণদের কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দিতে বিপিও শিল্পেও আরো শত শত উদ্যোক্তার যুক্ত হওয়া প্রয়োজন। এটা সম্ভব হলে পোশাক শিল্পের সাথে সমানভাবে বিদেশি মুদ্রা আয়ের পরবর্তী খাত হবে বিপিও শিল্প। একইসঙ্গে আমাদের শিক্ষিত তরুণদের জন্য কর্মসংস্থানের সুযোগ সৃষ্টি করা সম্ভব হবে। এছাড়া দক্ষ প্রতিযোগিতামূলক কর্মী দিয়ে আমাদের বৃহত্ কার্যকরী শিল্পের বিকাশ ঘটানো জরুরি। যাতে করে ভারত ও ফিলিপাইনের তুলনায় আইটি আউটসোর্সিংয়ের অন্যতম কেন্দ্র হিসেবে বাংলাদেশ বিশ্বের নজরে আসে।
লেখক : শিল্প উদ্যোক্তা