প্রকৌশলী থেকে সফল ফ্রিল্যান্সার
- ফ্রিল্যান্সার্স ডেস্ক
বিশ্বসেরা ফ্রিল্যান্স মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্ক ডটকম থেকে লাখ ডলারের বেশি আয় করা সফল ফ্রিল্যান্সার তানবীর মোরশেদ নাদিম। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় (পবিপ্রবি) থেকে কম্পিউটার সায়েন্সে বিসএসসি সম্পন্ন করে বর্তমানে পুরোদমে ফ্রিল্যান্সিংয়ের মাধ্যমে সম্মানজনক আয় করছেন তিনি। সিএসই পাস করে ইঞ্জিনিয়ার হয়েও গতানুগতিক চাকরি পেশায় না গিয়ে ফ্রিল্যান্সিংকে একমাত্র ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নেওয়া নাদিমের গল্প বাংলাদেশের সম্ভাবনাময় ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আশাজাগানিয়া উপকরণ।
বৈরী পরিস্থিতির গল্প: সদ্য বিশ্ববিদ্যালয় থেকে গ্রাজুয়েশন সম্পন্ন করা তরুণের মন ভালো নেই। কম্পিউটার সায়েন্স থেকে পাস করে চাকরির প্রতি অমনোযোগী এই তরুণকে নিয়ে শুভাকাঙ্ক্ষীদের বিভিন্ন মন্তব্য ‘কটূক্তির’ মত করে বিঁধে তার বুকে! ‘উচ্চশিক্ষিত ছেলে কেন চাকরি করছে না’ কাছের মানুষদের এমন মন্তব্য আহত করে তার পরিবারের সদস্যদেরও। পরিবারের লোকজন সরাসরি তাকে কিছু না বললেও তরুণটি অনুভব করতে পারে সবকিছুই। কিন্তু যত কিছুই হোক, চাকরির প্রতি প্রবল অনীহা কিংবা অগাধ স্বাধীনতার প্রতি তুমুল আগ্রহের কারণেই এ তরুণকে চাকরির দিকে ধাবিত করা যায়নি কোনোভাবেই! গতানুগতিক চাকরির প্রতি অনাগ্রহী তরুণটির নাম তানবীর মোরশেদ নাদিম। বর্তমানের সফল ফ্রিল্যান্সার হিসেবে যিনি প্রতিষ্ঠিত। শুভাকাঙ্ক্ষীদের উক্তি (নাদিমের কাছে যেটি কটুক্তি হিসেবে খ্যাত!) এখন আর তাকে পীড়া দেয় না। কারণ শুভাকাঙ্ক্ষীরাও জেনে গেছেন- নাদিম যা করছে সেটাই ঠিক, বরং তাদের ধারণার পুরোটাই ভুল ছিলো। ভুল ছিলো নাদিমকে নিয়ে করা উক্তিগুলোও।
ফ্রিল্যান্সিং এ হাতেখড়ি: ২০১০ সালের শেষের দিকের ঘটনা। বিশ্বের জনপ্রিয় বর্তমান মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কের তৎকালীন নাম ছিলো- ওডেস্ক। পরিচিত এক বড় ভাইয়ের কাছ থেকে ওডেস্কের বিষয়ে কিছুটা ধারণা পেয়ে সেখানে অ্যাকাউন্ট তৈরির মাস দেড়েকের মধ্যেই জুটে যায় ২৫০ ডলারের একটি অর্ডার। ফ্রিল্যান্সিং সম্পর্কে একটু-আধটু ধারণা পাওয়া অনভিজ্ঞ একজন মানুষের কাছে যেটি ছিল ঈর্ষণীয় রকমের আনন্দময় একটি ব্যাপার। যথারীতি নির্ধারিত সময়ের মধ্যে কাজ শেষে করে পেমেন্ট অ্যাকাউন্টে জমা হলেও তুলতে গিয়ে ঘটে বিপত্তি। এরপর কিছুটা সময় কাজ বন্ধ রাখলেও একটা সময়ে পুরোদমে কাজ শুরু করে নাদিম। প্রথম অর্ডারটি ২৫০ ডলারের হলেও এরপর তাকে পঁচিশ সেন্টের কাজও করতে হয়েছে প্রতিঘণ্টা হিসেবে। পঁচিশ সেন্ট থেকে কাজ শুরু করে একটা সময়ে প্রতিঘণ্টায় ২০ ডলার পর্যন্ত কাজের সুযোগ পায় নাদিম। এছাড়া চুক্তিভিত্তিক ইউএসএ, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ড এবং ইংল্যান্ডের বায়ারদের কাজ করার অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার।
পরিচয় সংকট: ২০১৩-১৪ সাল। ফ্রিল্যান্সিংয়ে হাতেখড়ির পর মোটামুটিভাবে কাজ করে গেলেও পরিচিতজনদের বোঝানো যাচ্ছিল না যে, সে (নাদিম) কী কাজ করছে! একটা সময় পরে যখন বিভিন্ন গণমাধ্যমে ফ্রিল্যান্সিং বিষয়ক লেখালেখি শুরু হয়, তখন ভিজিটিং কার্ডে ‘ফ্রিল্যান্স সফটওয়ার ইঞ্জিনিয়ার’ লিখে পরিচয় সংকট কাটানোর কিছুটা চেষ্টা করে সে! তখনও ভিজিটিং কার্ডে শুধুমাত্র ‘ফ্রিল্যান্সার’ লেখার সাহস কিংবা দুঃসাহস কোনোটিই দেখানো সম্ভব হয়নি নাদিমের! এর কারণ, বর্তমানের মত ফ্রিল্যান্সিং শব্দটা তখনও অতটা পরিচিতি লাভ করতে সক্ষম হয়নি।
মার্কেটপ্লেসে নাদিমের কাজ: বায়ারদের চাহিদার ভিত্তিতে দীর্ঘসময় ধরে নাদিম মার্কেটপ্লেসে যে কাজগুলো করছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে- ওয়ার্ডপ্রেস থিম কাস্টোমাইজেশন, ই-কমার্স, শপিফাই ওয়েব ডিজাইন অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট, ইয়াহু স্টোর, ওপেন কার্ট, বিগ কমার্স, ইবে অ্যান্ড অ্যামাজন, এসইও ইত্যাদি।
সম্পন্নকৃত কাজ: নাদিম ইতোমধ্যে দুইশ’র বেশি কাজ মার্কেটপ্লেস থেকে সম্পন্ন করেছেন এবং এর বাইরেও চুক্তিভিত্তিক কাজের অভিজ্ঞতাও রয়েছে তার। দুইশ’র বেশি বায়ারদের ফাইভ স্টার রিভিউও পেয়েছেন তিনি।
কর্মঘণ্টা: আপওয়ার্কের দুটো অ্যাকাউন্টে সর্বমোট ১৯ হাজার ঘণ্টা কাজের পাশাপাশি ভার্চুয়াল এজেন্সির মাধ্যমেও উল্লেখযোগ্য পরিমাণ কাজের রেকর্ড রয়েছে নাদিমের।
আপওয়ার্কের টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার: কাজের ধরন অনুযায়ী বিভিন্ন স্তর রয়েছে বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় মার্কেটপ্লেস আপওয়ার্কের। সর্বোচ্চ স্তরটি হচ্ছে ‘টপ রেটেড’। শীর্ষস্থানীয় এই মার্কেটপ্লেসের বর্তমানে টপ রেটেড স্তরে তানবীর মোরশেদ নাদিমের অবস্থান।
কাজ শেখার সোর্স: শুনতে অন্যরকম মনে হলেও টপ রেটেড ফ্রিল্যান্সার হওয়া সত্ত্বেও নাদিম কোনো প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নন! নাদিমের ভাষায়, ‘যখনই সমস্যায় পড়েছি, তখনই গুগলকে প্রশ্ন করেছি। গুগলও ঠিকঠাক উত্তরই দিয়েছে। ‘গুগল ইজ দ্য বেস্ট টিচার’। গুগলের ব্যবহার সঠিকভাবে জানলে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণ কেন্দ্রে না গিয়েও সফলভাবে কাজ শেখা এবং করা সম্ভব।’
নতুনদের উদ্দেশ্যে: সফল ফ্রিল্যান্সার নাদিমের আজকের অবস্থান সফলতায় পূর্ণ হলেও এ পর্যায়ে আসতে তাকে দীর্ঘ পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। নতুনদের উদ্দেশ্যে তাই নাদিমের অভিমত হচ্ছে- মার্কেটপ্লেসে খুব সহজেই অ্যাকাউন্ট তৈরি করা গেলেও, নতুনরা যারা ফ্রিল্যান্সার হিসেবে এই মাধ্যমে আসতে চান, তারা যেন পুরোপুরিভাবে স্কিল সমৃদ্ধ করে তারপর আসে। তা না হলে হাজার হাজার ডলার আয় করার স্বপ্ন নিয়ে এ মাধ্যমে এসে এর বিপরীত আশাহত হয়ে ছিটকে পড়ার সম্ভাবনাও বেশ প্রবল। এছাড়া স্পোকেন ইংলিশে মিড লেভেল এবং রাইটিংয়ে বেসিক লেভেলের জ্ঞানটাও থাকা উচিত। তা না হলে বিভিন্ন দেশের বায়ারদের সাথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে ঘটতে পারে বিপত্তি। যাতে ক্যারিয়ার ধ্বংসের অন্যতম কারণ হওয়ারও আশঙ্কা থেকে যায়। তাই পুরোপুরি স্কিল সমৃদ্ধ এবং ইংরেজি জ্ঞানের প্রতি আগ্রহ দেখাতে না পারলে ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার হতে পারে অপ্রত্যাশিত রকমের স্বপ্নভঙ্গের কারণ।
নাদিমের পরিবার: বরগুনার আমতলী উপজেলার পশু হাসপাতাল রোডে নাদিমের বাসস্থান। বাবা মো. মজিবর রহমান আমতলী এম ইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং মা নারগিস বেগম আমতলী বন্দর মডেল সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষিকা। ছোটভাই নওশের আহমেদ মুন শেরে বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত। নাদিম ২০০২ সালে আমতলী এম ইউ মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এসএসসি পাস করেন। ২০০৫ সালে আমতলী ডিগ্রি কলেজ থেকে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি সম্পন্ন করে সিএসই বিভাগে পবিপ্রবিতে চান্স পেয়ে সেখান থেকেই ২০১০ সালে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করেন। স্ত্রী নাজনিন নীলা এবং একমাত্র সন্তান আরহাম মোরশেদকে নিয়ে নাদিমের বর্তমান পরিবার।
স্বপ্ন: ভবিষ্যতে সফটওয়্যার ফার্ম প্রতিষ্ঠা করে একটা নির্দিষ্ট সময় পরে শ’খানেক লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার স্বপ্ন নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছেন নাদিম। একটা সময়ে শুভাকাঙ্ক্ষীদের কটূক্তি হজম করে যাওয়া নাদিম বর্তমানের সফল প্রতিষ্ঠিত ফ্রিল্যান্সার।