সাফল্যের জন্য প্রয়োজন ধৈর্য এবং সময় : অজন্তা রেজওয়ানা মীর্জা
অজন্তা রেজওয়ানা মীর্জা, ফ্রিল্যান্স লেখক, প্রুফ্ররিডার ও ট্রান্সক্রাইবার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক। ২০১২ সালে দেশের প্রতিষ্ঠিত একাটি বেসরকারী সংস্থার চাকরি ছেড়ে শুরু করেন ফ্রিল্যান্সিং। দিনরাত খেটে কাজ শিখেছেন। শেষ পর্যন্ত সফল হয়েছেন। অর্জন করেছেন বেসিস আউটসরসিং এ্যাওয়ার্ড। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমি, বিলেন্সার ও ট্রান্সপে বাংলাদেশের যৌথ আয়োজনে ফ্রিল্যান্সার মিট এ্যাওয়ার্ড। বাংলাদেশের সফল এই নারী ফ্রিল্যান্সাসের সাফল্যের গল্প শুনুন তার আত্মকথনে।
- অজন্তা রেজওয়ানা মীর্জা
ফ্রিল্যান্সিং-এ আমার আসা হঠাৎ করেই। এর আগ পর্যন্ত আমি একটি এনজিওতে কাজ করতাম – জাগো ফাউন্ডেশন। ২০১১ সালের জুলাই থেকে ২০১২ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট দেড় বছর আমি এখানে চাকরি করি। জাগো ফাউন্ডেশনে আমি ছিলাম জনসংযোগ এবং প্রকাশনা বিভাগের সহকারী ব্যবস্থাপক। চাকরিটা আমার খুবই পছন্দের ছিল, কিন্তু আমার বাসা থেকে প্রতিদিন অফিসে যাতায়াত করতে ৩ ঘন্টার মতো সময় লাগত। প্রতিদিনের এই যাওয়া-আসায় আমি মোটামুটি হাঁপিয়ে উঠেছিলাম! তাছাড়া কাজের অনেক চাপও থাকতো সবসময়। ২০১২ সালের শেষে আমি তাই চাকরিটা ছেড়ে দেই কিছুদিনের জন্য। ভেবেছিলাম পরে আবার চাকরিতে ফিরে যাব। যদিও আমার মেয়ে আয়শার জন্ম ওই বছরেই।
মেয়ের জন্মের সময় কিছুদিন আমি বাড়িতেই বিশ্রাম নেই, পরে এক বন্ধু’র কাছে শুনি oDesk (বর্তমানে Upwork) এর কথা। ২০১৩ সালের নভেম্বরে একটি অ্যাকাউন্ট করি Upwork-এ। প্রথমেই উপার্জনের কথা চিন্তা না করে আমি মনোযোগ দেই আমার অ্যাকাউন্টটি সাজাতে। ইন্টারনেটে খুঁজে খুঁজে বোঝার চেষ্টা করি ইন্টারন্যাশনাল মার্কেটে কেমন কাজ গ্রহণযোগ্য। এ বিষয়ে বেশ কিছু ভালো ওয়েবসাইটের আর্টিকেল পড়ি, আর তারপর নিজের মতো করে কিছু স্যাম্পল (নমুনা) তৈরি করি। নিজের অ্যাকাউন্ট পুরোপুরি সাজিয়ে তারপর কাজে এপ্লাই করা শুরু করি।
আমার ভাগ্যটা ভালো ছিল, তাই প্রথম এপ্লিকেশন করার ৭ দিনের মাথায় একটি ছোট ট্রান্সক্রিপ্সনের-এর কাজ পাই, মাত্র ৫ ডলারের। এই ছোট্ট কাজটি করতেই আমার সারাদিন লেগে যায়। কিন্তু আমার ভাগ্য আসলেই ভালো ছিল। ক্লায়েন্ট আমার কাজে খুশি হয় আর আমাকে ভালো একটা ফিডব্যাক দেয়। শুধু তাই না, সেই ক্লায়েন্ট আমাকে আরও কিছু ছোট কাজে হায়ার (আমন্ত্রন জানায়) করে, আমাকে হাতে ধরে কাজ শিখিয়ে দেয়, কিছু ভালো সফটওয়ারের সাথে আমাকে পরিচয় করিয়ে দেয়। তারপর ধীরে ধীরে আমি আমার প্রোফাইলটা সুন্দর করে সাজাতে থাকি; আস্তে আস্তে, খুব কম টাকায় প্রথম কাজগুলো করি। আমার টার্গেট ছিল আগে আমার একাউন্টটি সাজানো, তারপর টাকার চিন্তা করা। কারন আমি জানতাম, আমার প্রোফাইল সুন্দর না হলে কাজ পাওয়া কঠিন হবে।
আমার প্রথম মাসের আয় ছিল ২৩,০০০/- টাকা, এবং তার পরের মাসে ১৫,০০০/- টাকা। প্রথমদিকে আমাকে অনেক কষ্ট করতে হতো, রাত জেগে ৫/৬ ডলারের কাজ করতাম। খুব অল্প টাকার কাজের জন্য সারা রাত জেগে কাজ করেছি।
কখনো কখনো কাজে কিছু ভুলও হয়েছে, সেগুলো বারবার সংশোধন করে দিয়েছি আলাদা কোন টাকা না নিয়েই। কিছু ক্লায়েন্টকে মাঝে মাঝে অতিরিক্ত কাজ করে দিতে হয়েছে, শুধুমাত্র ভালো ফিডব্যাকের জন্য। কখনো কখনো কাজ পছন্দ হয়নি বলে ক্লায়েন্ট টাকা দেয়নি, তাও মেনে নিয়েছি। তাদের সাথে ভালো ব্যাবহার করেছি যখন বুঝেছি আমি নতুন দেখে আমার সাথে চালাকি করছে। মোট কথা, প্রথম তিন চার মাস মোটামুটি কিছু টাকা আয় করতে আমার অনেক কষ্ট করতে হয়েছে। তবে আবারও বলব আমার ভাগ্য ভাল যে, কিছু ভালো ক্লায়েন্টের সাথে আমার পরিচয় হয়েছিলো; তারা আমাকে কষ্ট করে কাজ শিখিয়েছে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ।
পরে আমি ট্রান্সক্রিপ্সনের কাজ ছেড়ে দেই, আর লেখালেখির কাজ শুরু করি। প্রথমে কিছু ৫০০ শব্দের আর্টিকেল লিখে দেই এক ইউক্রেনিয়ান ক্লায়েন্টের জন্য, প্রতিটা আর্টিকেল ২$ করে। পরে কাজের রেট বাড়াতে থাকি। একই ক্লায়েন্ট পরে আমাকে একটা ছোট ই-বুক লেখার কাজ দেয়, ৩৫০০ শব্দের, মাত্র ২০$ এর কাজ। অবশ্য কাজটা তার পছন্দ হয় এবং সে আমাকে ১০$ বোনাসও দেয়, সেটা আমার ফ্রিলেন্সিং ক্যারিয়ারে প্রথম বোনাস ছিল।
প্রথম থেকেই আমার কাজ পেতে বেশি কষ্ট হয়নি, কিন্তু কষ্ট হয়েছে আমার কাজের জন্য ভালো রেট পেতে। একজন নেটিভ ইংলিশ রাইটার যে রেট পায়, ক্লায়েন্টরা সেটা আমাকে দিতে চাইত না। কারন আমার ফার্স্ট ল্যাঙ্গুয়েজ (মাত্রভাষা) ইংরেজি না। খুব ধীরে ধীরে আমি চেষ্টা করতে থাকি আমার কাজের রেট বাড়াতে। শুরু করেছিলাম ঘণ্টায় তিন ডলার রেটে, এখন সেটা বেড়ে হয়েছে ঘণ্টায় ৮ ডলার। আমি মূলত এখন ২,৫০০, ৩,৫০০, ৫,০০০, ৭,৫০০, ১০,০০০, ১২,৫০০ ও ১৫,০০০ শব্দের ই-বুক লিখি এবং প্রতি ১০০ শব্দের জন্য ১.৫ ডলার করে রোজগার করি।
২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে আমি বেসিস (BASIS) থেকে ‘ফিমেল ক্যাটাগরি’তে আউটসরসিং এ্যাওয়ার্ড পাই – যা আমার জীবনের অন্যতম একটি ঘটনা ছিল। এই এ্যাওয়ার্ডটি আমার সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রেরণা। তারপর ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে আমি ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল একাডেমী, বিলেন্সার ও ট্রান্সপে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে আরেকটি এ্যাওয়ার্ড পাই, এটিও ছিল ফিমেল ক্যাটাগরিতে, আউটসরসিং-এ আমার অবদানের জন্য।
আমি এখন দিনে ৩/৪ ঘণ্টার মতো কাজ করে থাকি এবং বাকি সময়টা আমার পরিবারকে দেই। তাছাড়া UpWork-এ আমার একটি প্রতিষ্ঠান আছে, যার নাম Writers-on-the-Block. এটা একদম শুরুর দিকে। আমার পরিকল্পনা, আগামি ২ বছরের মধে কমপক্ষে ১০জন লেখককে একসাথে করে কাজ করা, তাদের কাজ দেওয়া। এখন আমার প্রতিষ্ঠানে আমি ছাড়া আরও ২ জন কাজ করছে। আমি আরও লেখক খুজছি। আমার মতো আরও অনেকে, যারা কোননা কোন কারনে চাকরি ছেড়েছেন, বা ছাড়তে হয়েছে, বা যাদের যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও কোন কারনে চাকরি করতে পারছেন না, তাদের প্রতি মাসে কিছু হলেও আয় করার উপায় করে দেওয়া।
ফ্রিল্যান্সিং কোন সহজ ব্যাপার নয়। এখানে লাগবে অনেক, অনেক, অনেক ধৈর্য এবং সময়। মনে রাখবেন, ফ্রিলান্সিং-এর ক্ষেত্রটা একটি আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেস, এখানে আপনার প্রতিযোগী সারা বিশ্ব। নিজেকে যোগ্য করে তুলতে হবে, যাতে আপনি পুরো পৃথিবীর সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে পারেন। আগে ভালো করে কাজ শিখতে হবে, যে কাজটা ভালো লাগে বা ভালো পারেন সেটাই করা ভালো।