ফ্রিল্যান্সার হওয়ার পূর্বপাঠ
- অজন্তা রেজওয়ানা মীর্জা
‘আমি ফ্রিল্যান্সিং করতে চাই’ অথবা ‘ফ্রিল্যান্সিং শিখতে হলে আমাকে কী করতে হবে’-এই প্রশ্নগুলো প্রায়ই শুনি। একেক জনকে এককভাবে উত্তর দিতে হয়। কাউকে বলি, ‘আপনার প্রশ্নটাই আসলে ঠিক নয়। ফ্রিল্যান্সিং শিখবো বা ফ্রিল্যান্সিং করবো বলে আসলে কিছু নেই।’
তাহলে? ব্যাপারটা আসলে কী। ফ্রিল্যান্সিং কোনো বিশেষ কাজ নয় যা আপনি শিখতে পারবেন, অথবা কম্পিউটারের সামনে বসে করতে পারবেন। আপনি যে কাজ পারেন, বা করতে চান, সেটাই আপনি একজন ফ্রিল্যান্সার হিসেবে করতে পারেন।
এবার আপনি প্রশ্ন করতে পারেন, ফ্রিল্যান্সার তাহলে কে? যিনি বাসায় বসে কাজ করেন? যিনি রাত জেগে কাজ করেন? যিনি বাসায় বসে হাজার হাজার ডলার কামাই করতে পারেন? ঠিক তা নয়! একজন ফ্রিল্যান্সার নিজের মতো করে কাজ করতে পারেন, নিজের মতো নিজের কাজ পছন্দ করে নিতে পারেন। যিনি কোনো অফিসের বা নির্দিষ্ট কোনো কর্তার অধীনে কাজ করেন না। সেটা তিনি বাসায় বসেই কাজ করুক কিংবা অফিসে বসেই করুন। আমি বসে আছি বাংলাদেশে, আমার গ্রাহক বসে আছেন অস্ট্রেলিয়াতে, আর আমি তার হয়ে একটা কাজ করে দিচ্ছি। সব যোগাযোগ হচ্ছে ইন্টেরনেটে, ফোনে; কাজ শেষ হলে তিনি আমাকে আমার প্রাপ্য বুঝিয়ে দিচ্ছেন-আমি হলাম তার কাছে একজন ফ্রিল্যান্স কর্মী। আমি কি কাজ করছি? আমি তার ওয়েবসাইটের জন্য একটা লেখা লিখে দিচ্ছি, বা তার ওয়েবসাইটটা বানিয়ে দিচ্ছি, বা তার ব্যবসার হিসেব রাখছি, বা তার যা যা রিসার্চ দরকার তা করে দিচ্ছি। আমি নিজে যা পারি তাই করে দিচ্ছি আমার বিদেশি গ্রাহকের জন্য।
তাহলে আপনি কী শিখতে পারেন? আপনি একটা কাজ শিখতে পারেন, বা যে কাজ আপনি আগে থেকেই জানেন, সেটা আরও ভালো করে শিখতে পারেন, অথবা যেই কাজে আপনার আগ্রহ আছে তা শিখতে পারেন। যেমন, ওয়েবসাইট ডেভেলপমেন্ট, ওয়েব ডিজাইন, এসইও, গ্রাফিক ডিজাইন, লেখালেখি বা অন্যকিছু।
এছাড়া শিখতে পারেন আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসগুলোতে কীভাবে আবেদন করবেন সেটা। আন্তর্জাতিক বেশ কিছু মার্কেটপ্লেস আছে যেগুলোতে আপনি কাজ খুঁজতে পারেন । যেমন, Upwork (যেটা আগে oDesk ও Elance ছিলো), Freelancer, Fiverr, PeoplePerHour, 99Design, iFreelance, ProjectForHire, ইত্যাদি। এদের মধ্যে Upwork ও Freelancer সবচেয়ে পরিচিত। গ্রাফিক ডিজাইনারদের পছন্দ 99Design ও Fiverr, আর ওয়েব ডেভেলপারদের জন্য আছে Toptal ও Envato। যারা লিখতে পছন্দ করেন তাদের জন্য আছে Constant-Content ও Make A Living Writing। এভাবেই আপনি খুঁজে নিতে পারেন আপনার পছন্দের প্ল্যাটফর্ম।
কেমন হয় এই অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলো? ঠিক যেমন চাকরীর খোঁজ দেয়া ওয়েবসাইটগুলো এই প্ল্যাটফর্মগুলোও ঠিক তেমন। এখানে গ্রাহকরা অপেক্ষা করে আছে তাদের কাজ নিয়ে, তাদের সাধ্যমত বাজেটসহ। আপনি যদি এমন কোনো কাজ পান যেটা আপনি ভালো পারবেন, যেটার বাজেট আপনার সাথে মিলে, এবং যে কাজ করতে আপনি আগ্রহী, আপনি সেখানে আবেদন করতে পারবেন। যদি গ্রাহক আপনাকে পছন্দ করে, যদি তিনি মনে করেন আপনি কাজটা পারবেন, তাহলে এই কাজে আপনাকে সুযোগ দিতে পারেন।
এতই সহজ? না ঠিক তা নয়। এজন্য আপনার দরকার খুব ভালো একটা প্রোফাইল, যেটা আপনাকে নিজেকেই তৈরি করতে হবে। আপনার প্রোফাইলে থাকবে আপনার পরিচয়-আপনি কী কাজ পারেন, এই কাজে আপনার আগে কোনো অভিজ্ঞতা আছে কিনা, অথবা আপনি এই কাজটা শিখেছেন কিনা বা এই নিয়ে পড়াশোনা করেছেন কিনা। অন্য একটা মহাদেশে, অন্য একটা দেশে বসে একজন গ্রাহক আপনাকে কাজ দিবে শুধুমাত্র আপনার প্রোফাইল দেখে, তাই অনলাইন মার্কেটপ্লেসে আপনার প্রোফাইলই হবে আপনার পরিচয়।
কি থাকতে হবে আপনার প্রোফাইলে? আপনার পরিচয়, আপনি কী কাজ শিখেছেন বা কী পড়েছেন, তার বিবরণ। আপনি কী কী কাজ পারেন, সেটা। এবং সবচেয়ে দরকারি – আপনার কাজের কিছু নমুনা। আপনি ক্লায়েন্টকে বললেন যে আপনি খুব ভালো লিখতে পারেন; সে বিশ্বাস করবে কেন? আপনাকে দেখাতে হবে যে আপনি কী কী লিখেছেন, এবং কত ভালো লিখেছেন। এজন্য আপনার ইংরেজি সাহিত্যে অনারস/মাস্টার্স থাকতে হবে না। আপনি যদি ছোট একটা লোগো ডিজাইনের কাজে এপ্লাই করেন, আপনাকে নিজের করা কিছু লোগোর নমুনা দেখাতে হবে, আপনার করা কোনো কোর্সের সার্টিফিকেট নয়।
একটা কথা মনে রাখবেন, এই মার্কেটপ্লেসে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে কাজ জানতে হবে। একজন ক্লায়েন্ট আপনাকে কাজ দিবে এবং ভালো প্রতিক্রিয়া দিবে, আপনি কাজ পারেন বলে। আপনি কোথায় পড়েছেন, কী পড়েছেন, কেমন ফল করেছেন, আপনার সাধারণ জ্ঞান কেমন, আপনি গণিতে কেমন, আপনি নিউজিল্যান্ডের রাজধানীর নাম জানেন কিনা-এইসব দেখে নয়। নিজেকে দক্ষ করে তারপর এই মার্কেটে আসুন, কারণ আপনার দক্ষতাই এখানে আসল, আর তেমন কিছু নয়। মনে রাখবেন, এটা আন্তর্জাতিক একটা চাকরির বাজার, এখানে আপনার প্রতিযোগী পুরো বিশ্ব, আপনাকে বিশ্বমানের হয়েই এখানে আসতে হবে, নাহলে এখানে আপনি সফল হতে পারবেন না।