প্রথমত পেশাদারীত্ব…
- অজন্তা রেজওয়ানা মীর্জা
আমরা যারা ফ্রিল্যন্সার তাদের কাজের কোনো নির্দিষ্ট সময় থাকে না। আমরা যেমন রাত ১২টার পর কাজ শুরু করতে পারি, তেমন আবার ভোর ৫টায় উঠে কাজ করতে পারি। বেশির ভাগ সময় আমাদের কোনো অফিস থাকে না, তাই সকালে ঘুম থেকে উঠে আমাদের ফর্মাল পোশাক পরে কাজে যেতে হয় না। আমরা বাসায় যা পরে থাকি তাই নিয়ে, সকালে উঠে এক কাপ কফি হাতে নিয়ে ল্যাপটপের সামনে বসে যেতে পারি।
হ্যাঁ, আমাদের এই পেশাটা একটু আরামের, কিছু কিছু দিক দিয়ে অনাড়ম্বর ও ঘরোয়া, কিন্তু তার মানে এই নয় যে ফ্রিল্যান্সিংয়ে কোনো প্রফেশনালিজম বা পেশাদারীত্ব থাকবে না। ফ্রিল্যান্সিং একটা পেশা, তাই এখানে কিছুটা পেশাদারীত্ব অবশ্যই থাকতে হয়।
ফ্রিল্যান্সিংয়ে ‘পেশাদারীত্ব’ থাকা মানে আপনার কোনো ক্লায়েন্টকে ‘স্যার’ বলে ডাকা নয়, বা বইয়ের ভাষায় কথা বলা নয়। আপনি স্বাভাবিক থেকেও, বন্ধুসুলভ থেকেও একজন পেশাদার হতে পারেন। জেনে নিন, একজন আন্তর্জাতিক ক্লায়েন্ট আপনার কাছে কেমন ব্যবহার আশা করেন।
কেমন হবে সম্বোধন
- অনেকে কথা শুরু করেন ‘স্যার/ম্যাডাম’ বলে, যেটা পাশ্চাত্য দেশগুলোতে এখন উঠেই গিয়েছে প্রায়। তাহলে কীভাবে সম্বোধন করবেন একজন ক্লায়েন্টকে – কভার লেটারে, বা স্কাইপে? বন্ধুসুলভ কিন্তু ভদ্রতাসুলভ। ‘হাই’ বা ‘হ্যালো’ বলতে পারেন, “হ্যালো জন/জেন” বলতে পারেন, যদি নাম দেয়া থাকে তাহলে। আরেকটু পেশাদার হতে চাইলে “হ্যালো মি./মিস ব্রাউন (শেষের নাম)” বলতে পারেন। কিছু কিছু নাম আছে যেটা শুনে আপনি বুঝতে পারবেন না ক্লায়েন্ট ছেলে না মেয়ে। এক্ষেত্রে ঝুঁকি না নিয়ে প্রথম নাম দিয়ে সম্বোধন করাই ভালো। অথবা, আরেকটা কাজ করতে পারেন, একটু গুগলে খুজে দেখতে পারেন নামটা ছেলেদের না মেয়েদের। যেমন আমার দু’জন ক্লায়েন্ট আছে, নাম ‘Phu N…’ আর ‘Peng Z…’। আমি তাদেরকে সম্বোধন করার আগে গুগলে খুঁজেছিলাম এভাবে- What gender is Peng Z in the Philippines? Is Phu N male or female in the Philippines? আশা করি আপনি আপনার উত্তর পেয়ে যাবেন। কিন্তু সবচেয়ে ভালো হবে যদি তার প্রথম নামটা দিয়ে সম্বোধন করেন। আরেকটা কথা, বেশি বেশি বন্ধুসুলভ হতে গিয়ে আবার ‘Yo! What’s up?’ বা ‘What’s happening?’ ধরণের কথা লিখতে যাবেন না, সেটা আবার বেশি বেশি হয়ে যায়।
বেশি ব্যক্তিগত প্রশ্ন নয়
- প্রথমেই এমন কিছু প্রশ্ন করে বসবেন না যেটা আপনার ক্লায়েন্টের কাছে খারাপ লাগতে পারে। ‘তোমার প্রোফাইল পিকচারে তোমার সাথে এটা কে?’ বা ‘তুমি কী ছেলে না মেয়ে?’ এই ধরণের প্রশ্ন করবেন না। অন্ততঃ তার সাথে একটু ভালোভাবে পরিচয় না হওয়া পর্যন্ত। একটু যদি আলাপ করতে চান, কিছু সাধারণ বিষয় নিয়ে জিজ্ঞেস করুন, যেমন: I read about the blizzard in your state last month. I hope everything went all right with you? I see that you are from Arizona, Texas. It must be very hot there!
আক্রমণাত্মক ভাষা বর্জনীয়
- একটা কথা মনে রাখবেন, আমরা যখন একটা কাজের জন্য আবেদন করছি, সেই ক্লায়েন্টটি অন্য কোনো মহাদেশের, অন্য কোনো সংস্কৃতির মানুষ। তাদের অনেক কিছুই আমাদের থেকে পুরোপুরি আলাদা-তাদের ভাষা বা চেহারা শুধু নয়, তাদের ধর্মীয় বিশ্বাস, তাদের জীবনধারা, তাদের সবকিছু আলাদা। আপনার যদি ব্যক্তিগত কোনো সমস্যা থাকে কারো সাথে কাজ করতে, সেটা তাকে জানানোর দরকার নেই। বলে দিবেন, আপনি ব্যস্ত বা এখন কাজ করতে ইচ্ছুক নন, কিন্তু তাদের কোনো কিছু নিয়ে আক্রমণাত্মক কথা বলবেন না। আমরা যারা একটু পুরনো ফ্রিল্যান্সার, তারা কিছু দেশের ক্লায়েন্টের সাথে কাজ করি না, তার একমাত্র কারণ যে তারা ‘ক্লায়েন্ট’ হিসেবে ভালো হয় না। যারা সত্যি পেশাদার তারা এর মধ্যে আমাদের ইতিহাস বা অন্য কিছু আনবে না। তাছাড়া, সংস্কৃতিগত কারণে তাদের সম্পর্কগুলো আমাদের থেকে ভিন্ন হয়। এখানে আসলে আমাদের অবাক হবারও কিছু নেই, আবার রাগ করারও কিছু নেই। ক্লায়েন্টদের ব্যক্তিগত কিছু জিজ্ঞেস করবেন না, তাদের কোনো বিশ্বাসে বা অভ্যাসে মন্তব্য করবেন না।
সব প্রশ্নের উত্তর দেওয়া চাই
- মাঝে মাঝে দেখবেন ক্লায়েন্ট আপনাকে এমন কিছু প্রশ্ন করবে যার সাথে আপনার কাজের কোনো সম্পর্ক নেই। যেমন, আপনি একটা লোগো ডিজাইন করার জন্য আবেদন করলেন, যেখানে ক্লায়েন্ট আপনাকে জিগ্যেস করে বসলো, ‘বলো তো, তুমি তোমার উইকেন্ড (Weekend) কীভাবে কাটাও?’ অথবা ধরা যাক, আমি একটা ই-বুকের জন্য আবেদন করলাম, আর ক্লায়েন্ট স্কাইপে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, ‘তোমার জীবনের প্রথম ট্রেনে চড়ার অভিজ্ঞতাটা ২০০ শব্দে লিখে পাঠাও!’ ক্লায়েন্টকে পাগল ভেবে বসবেন না। সে আপনার সময় নষ্ট করছে না, সে এমন প্রশ্ন করে আপনাকে বোঝার চেষ্টা করছে; আপনার কথা বলার ধরন বোঝার চেষ্টা করছে। কাজে আবেদন করার সময় যদি এমন কোনো প্রশ্ন দেখেন, অবশ্যই তার উত্তর দেবেন, কারণ ক্লায়েন্ট দেখতে চাইছে আপনি মনোযোগ দিয়ে তার কাজের বিবরণ পড়েছেন কিনা।
রোজ রোজ কড়া নাড়া নয়
- আমরা ফ্রিল্যান্সাররা যেমন সারা সপ্তাহ কাজ করি, ক্লায়েন্টরা কিন্তু তা করে না। অনেক ক্লায়েন্ট আছেন যারা আপনাকে একটা কাজ দিয়ে সারা মাস অথবা সারা সপ্তাহ গায়েব হয়ে যাবে। আপনি যদি রোজ তাকে ম্যাসেজ দেন, তাহলে ঠিক হবে না। আপনার ক্লায়েন্ট বিরক্ত হতে পারে। কিছু ক্লায়েন্ট এমন আছে যারা সারা সপ্তাহ চাকরি করে আর উইকেন্ডে ফ্রিল্যান্সারদের সাথে কাজ করে। আপনি সারা সপ্তাহ তাকে ম্যাসেজ দিলেও সে আপনার সাথে কথা বলবে না, সে অপেক্ষা করবে ছুটির দিনের জন্য।
ক্লায়েন্টকে ওজুহাত দেবেন না
- আমরা অনেকেই ওজুহাত দিতে খুব পছন্দ করি, যা আমাদের বিদেশী ক্লায়েন্টরা একদম পছন্দ করবে না। ‘কারেন্ট চলে গিয়েছিলো, তাই কাজ করতে পারি নি’, ‘ভাইয়ের বিয়ে ছিলো’, ‘বাসার সবাই অসুস্থ’-এই টাইপের কথা ক্লায়েন্টকে বললে তারা বিরক্ত হবে। আপনার সমস্যা হতেই পারে, কিন্তু মিনমিন করে ক্লায়েন্টকে বলতে যাবেন না। জানিয়ে দিন ‘ফ্যামিলি ক্রাইসিস’ চলছে, আপনি এখন কাজ করতে পারছেন না। বেশি বিস্তারিত জানানোর প্রয়োজন নেই। যদি সামনে সমস্যা থাকে, আপনি কাজ না করতে পারেন, সোজা জানিয়ে দিয়ে কাজটা ছেড়ে দিবেন। নাহলে জানিয়ে দিবেন, আপনি সামনের ১/২ মাস বা সপ্তাহ কাজ করতে পারবেন না। তারা যদি আপনার জন্য অপেক্ষা করতে রাজি হয়, তাহলে আপনি জিতে গেলেন। আর না হলে, নাই। কিন্তু কাজ করতে পারবেন না জেনেও যদি কাজ নেন, আর পরে গড়িমসি করতে থাকেন-তাহলে আপনার জন্যই সেটা খারাপ হবে।
সীমাবদ্ধতাগুলো জানিয়ে দিন
- বাংলাদেশে আমরা শুক্রবারে কাজ করি না, কিন্তু পুরো পৃথিবীর মানুষ অফিস করে। আপনি ফ্রিল্যান্সার বলেই যে আপনাকে শুক্রবারে কাজ করতে হবে, তা না। জানিয়ে দিন আপনার ক্লায়েন্টকে যে শুক্রবার আমাদের ছুটির দিন এবং আমাদের ধর্মীয় দিন; এই দিনে আপনি কাজ না করে পরিবারকে সময় দিবেন। তারা সেটা খুব ভালোভাবেই নিবেন। তাছাড়া ঈদ/পুজো’র ১০দিন আগেও জানিয়ে দিন যে আপনার ছুটি প্রয়োজন। এটাও জানাতে পারেন যে আপনি বড়দিনের সময় কাজ করতে পারবেন, কিন্তু ডিসেম্বর মাসে তাদেরকে বার বার মেসেজ দেবেন না। তারা সবাই প্রায় পুরো ডিসেম্বর মাস ছুটি কাটায় এবং তখন কোনো কাজই করে না।
ফ্রিলান্সিং-এ আপনি হয়ত বাসায় বসে কাজ করছেন, কিন্তু তার মানে এই নয় যে আপনাকে পেশাদারিত্ব মানতে হবে না। যেহেতু আমরা আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসে কাজ করছি, আমাদের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করছে আমাদের আচরণ ও মনোভাবের ওপর। জানতে হবে আন্তর্জাতিক মার্কেটপ্লেসগুলোতে কেমন পেশাদারিত্ব ক্লায়েন্টরা আমাদের কাছে আশা করছে এবং আমাদের কী কী করতে হবে।