প্রথম পরীক্ষাতেই চাকরি !
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
অনেকের বারবার চেষ্টা করেও হয় না, কারো চাকরি হয় প্রথমবারেই। কী সেই টনিক, যার কারণে প্রথমবারেই বাজিমাত? নিজের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন প্রথমবার পরীক্ষা দিয়েই চাকরি হয়েছে এমন কয়েকজন তরুণ কর্মজীবী।
নাওয়া–খাওয়া বাদ দিয়ে পড়াশোনা করেছি
মোবাশশিরা হাবীব খান
সিনিয়র সহকারী কমিশনার, ডিএমপি।
বিসিএসের জন্য যখন আবেদন করি তখন অনার্স ফাইনাল চলছে। আবেদন করেছিলাম অ্যাপিয়ার্ড সার্টিফিকেট দিয়ে। এটাই প্রথম কোনো চাকরি পরীক্ষায় অংশ নেওয়া। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর মাত্র তিন মাস সময় পেয়েছিলাম প্রিলিমিনারির প্রস্তুতির জন্য।
নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে পড়াশোনা করেছি। একটা কথা সারাক্ষণ মাথায় ঘুরত, আমাকে পুলিশ ক্যাডার হতেই হবে। প্রিলিমিনারিতে টেকার পর রিটেনের জন্য তেমন প্রিপারেশন নিতে পারিনি। ততদিনে মাস্টার্সের পড়াশোনা শুরু করতে হয়েছে। লিখিত পরীক্ষাও ভালো দিয়েছিলাম। প্রিলির জন্য ভালোভাবে প্রস্তুতি নিলেই তা রিটেনের জন্যও যথেষ্ট। শুধু নতুন তথ্যগুলোর বিষয়ে আপডেটেড থাকলেই হয়।
ভাইভা বোর্ডে ছিলেন তিনজন। তার মধ্যে একজন চেয়ারম্যান স্যার আর বাকি দুজন এক্সটারনাল। জানতে চেয়েছিলেন, ‘আপনি নারী, কিন্তু পছন্দের তালিকায় পুলিশ ক্যাডার আগে কেন?’ বলেছিলাম, আমি চাই চ্যালেঞ্জিং কিছু, যেটি দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে পারব। এরপর বিভিন্ন বিষয় থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিল। সবচেয়ে বেশি প্রশ্ন করা হয়েছিল ইতিহাস থেকে।
দুজন এক্সটারনালের একজন আমাকে একটানা বেশ কিছুক্ষণ বিভিন্ন বইয়ের নাম বলেছিলেন, আর উত্তরে আমাকে সেই বইয়ের লেখকের নাম এবং জন্মস্থান বলতে বলা হয়েছিল। একটি বাদে সব কয়টি প্রশ্নের উত্তর ঠিকমতো দিয়েছিলাম। ভাইভা দিয়ে বের হওয়ার আগেই চাকরিটা হওয়ার ইঙ্গিত পেয়েছিলাম।
আমি একটা নীতিতে বিশ্বাস করি, এক কাজের জন্য দুইবার পরিশ্রম করব কেন? যা হবার একবারেই হবে। এর জন্য যত কষ্টই হোক, আমি মানতে রাজি। প্রথমবারে চাকরির ক্ষেত্রে এ বিষয়টি সাহায্য করেছে বলে আমার মনে হয়।
.
ফুয়ারা খাতুন
সহকারী পরিচালক, বাংলাদেশ ব্যাংক।
দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি করব, দেশের ব্যাংকিং সেক্টর রেগুলেট করব, এটা ছিল এক ধরনের স্বপ্নের মতো। আমার জীবনের লক্ষ্যই ছিল হয় বিসিএস, না হয় দেশের কেন্দ্রীয় ব্যাংকে চাকরি করব।
তাই বিসিএস পরীক্ষার প্রস্তুতির পাশাপাশি ব্যাংকের পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের পরীক্ষায় অংশও নিই। পরীক্ষার হলে তো রীতিমতো ঘাবড়ে যাই, এত কঠিন প্রশ্ন আমার জীবনে দেখিনি! কিন্তু মাথা ঠাণ্ডা রেখে পরীক্ষা দিই এবং সফল হই। আমাদের সময়ে প্রিলি খুব কঠিন হয়েছিল। বেশির ভাগ পরীক্ষার্থী প্রিলিতে ফেল করবে—এই চিন্তায় রিটেন ভালো করে দেয়নি। কিন্তু পরবর্তী সময়ে দেখা গেল ‘কাট মার্কস’ খুবই কম ধরা হয়েছে।
যথেষ্ট আত্মবিশ্বাস ছিল, পারব। বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষায় ২৫-৩০ হাজার প্রতিযোগীর মধ্যে যদি মেধাতালিকায় থাকতে পারি, তাহলে চাকরির পরীক্ষায় কেন নয়! আত্মবিশ্বাসই আমাকে সাহায্য করেছে। এ ছাড়া আমার ব্যাকগ্রাউন্ড স্টাডিও খুব কাজে এসেছে। বেশির ভাগ ছেলেমেয়েই কম্পিউটার ও ইংরেজি এই দুই বিষয়ে বেশ দুর্বল। এ ক্ষেত্রে বেশ সুবিধা পেয়েছি। আমার এসএসসি ও এইচএসসিতে কম্পিউটার বিষয় ছিল এবং ইংরেজিতে অনার্স মাস্টার্সে পড়াশোনা আমার ইংরেজির ভিত্তি আরো মজবুত করে দিয়েছে।
বিসিএস ও ব্যাংকের প্রিলি পরীক্ষার ধরন প্রায় একই রকম। তাই প্রিলির জন্য আমাকে আলাদাভাবে পড়াশোনা করতে হয়নি। নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলো খাতায় নোট করে রাখতাম, যা রিটেনে ভালো কাজে দিয়েছে। রিটেনের ম্যাথের জন্য পূর্ববর্তী ব্যাংক পরীক্ষায় আসা ম্যাথগুলো সমাধান করেছি প্রফেসরসসহ বিভিন্ন গাইড বই থেকে। আর নবম-দশম শ্রেণির ম্যাথ বই থেকেও অঙ্ক করতাম। ভাইভার জন্য অর্থনীতি, ব্যাংকিং প্রভৃতি বিষয়ে পড়াশোনা করেছিলাম। নিজের পঠিত বিষয় সম্পর্কে খুঁটিনাটি জেনে গিয়েছিলাম। ক্লাস সেভেন থেকেই সাধারণ জ্ঞানের মাসিক পত্রিকা পড়তাম, অভ্যাসটা আমার এখনো আছে। এটা প্রস্তুতিতে খুব সাহায্য করেছে। এ ছাড়া নিয়মিত বিবিসি নিউজ শুনতাম। বাংলাদেশ ব্যাংকে যখন আবেদন করি তখন আমি মাস্টার্সের ছাত্রী। তবে পরীক্ষা হয়েছে মাস্টার্সের পর।
বাংলার জন্য নবম-দশম শ্রেণির ব্যাকরণ ও বোর্ড বই এবং ইংরেজির জন্য বোর্ড বইসহ বেশ কয়েকটি ভালো মানের ইংরেজি গ্রামার বই অনুসরণ করতাম। এই ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতিই চাকরি পরীক্ষার প্রস্তুতির ভিত্তি হিসেবে কাজ করেছে। আত্মবিশ্বাস ছিল, তবে প্রথমবারেই যে পেয়ে যাব তা ভাবিনি। জীবনের প্রথম চাকরি পাওয়ার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করা সম্ভব না। রেজাল্টের দিন এক বান্ধবীর বাসায় ছিলাম। সন্ধ্যায় হঠাৎ আরেক বান্ধবী ফোন করে বলে যে রেজাল্ট দিয়েছে। তখন তো টেনশনে হাত-পা অবশ হয়ে আসছিল। ওয়েবসাইটে গিয়ে যে রেজাল্ট দেখব এই শক্তিটুকু পাচ্ছিলাম না। পরে আমার বান্ধবীই রেজাল্ট দেখে দেয়। সেই দিনের স্মৃতি আসলে ভোলার নয়।
আমাদের পরিবারের মধ্যে আমিই প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছিলাম। তাই আগে থেকেই আমার প্রতি আমার মা-বাবার অনেক আশা, অনেক স্বপ্ন—আমি পড়াশোনা শেষে বড় একটা চাকরি করব এবং তাঁদের মুখ উজ্জ্বল করব। তাই এই চাকরি পাওয়ায় আমার চেয়ে আমার মা-বাবাই বেশি খুশি হয়েছিলেন। তাঁদের খুশি দেখে জীবনে বড় হওয়ার স্পৃহা আরো বেড়ে গেছে আমার।
.
জানতে চেয়েছিলেন আমার কোনো প্রশ্ন আছে কি না?
আকিবুল ইসলাম
টেরিটরি ম্যানেজার, ইউনিলিভার।
ইউনিলিভারে চাকরির বাছাই বা লিখিত পরীক্ষার মুখোমুখি হতে হয়নি। আবেদনের পর ভাইভার মাধ্যমে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। জীবনের প্রথম ভাইভা দিয়ে বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান ইউনিলিভারে চাকরি পেয়েছিলাম। ভাইভা হয়েছিল ইউনিলিভারের হেড অফিসে।
যখন ভাইভা বোর্ডে প্রবেশ করি, সেখানে দুজন উপস্থিত ছিলেন। সাধারণত প্রথমেই ভাইভা বোর্ডে নিজের সম্পর্কে ‘ইন্ট্রোডিউস ইউরসেলফ’ বলে কিছু বলতে বলা হয়, এটি আমি আগে থেকেই জানতাম।
তাই প্রস্তুতি নিয়েই গিয়েছিলাম। স্যারদের হাতে আমার সিভি ছিল। সিভির বাইরের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বেশ
গুছিয়েই বলেছিলাম। এরপর একে একে বিভিন্ন ধরনের প্রশ্ন করা হয়েছিল। তবে বইয়ের ভেতরের চেয়ে ব্যবসাসম্পর্কিত প্রশ্ন বেশি করা হয়েছিল। স্যাররা বিভিন্ন প্রশ্নের মাধ্যমে বুঝতে চেষ্টা করেছিলেন, আমার নেতৃত্ব দেওয়ার গুণাবলি কেমন। প্রায় এক ঘণ্টা ভাইভা নেওয়ার পর জানতে চেয়েছিলেন, আমার কোনো প্রশ্ন আছে কি না? ইউনিলিভারের একটি টিভি বিজ্ঞাপনের ব্যাপারে কথা বলেছিলাম। এতে স্যাররা অনেক খুশি হয়েছিলেন। প্রথম ভাইভায়ই চাকরি হওয়ার ক্ষেত্রে ছাত্রাবস্থায় বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিজ্ঞতা বেশ কাজে লেগেছে।
.
শিল্প–সাহিত্য থেকে প্রশ্ন করেছিলেন
পিয়াস মজিদ
সহকারী সম্পাদক, বাংলা একাডেমি।
প্রথম পরীক্ষাতেই চাকরি হওয়া অত্যন্ত আনন্দের। এটা পুরো জীবনেই একটি দারুণ প্রভাব ফেলে। ছেলেবেলা থেকেই লেখালেখির সঙ্গে জড়িত ছিলাম বলে চেয়েছিলাম, এমন কোনো চাকরি করব, যার মাধ্যমে লেখালেখিটা চালিয়ে যেতে পারি। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পড়াশোনা শেষ করেও আমাকে বেশ কিছুদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল বাংলা একাডেমিতে চাকরির জন্য। এর মধ্যে অনেক চাকরির সুযোগ এলেও আমি যোগ দিইনি। কারণ আমি জানতাম, বাংলা একাডেমিতে চাকরি হলে সেটা আমার লেখালেখির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হবে না।
পত্রিকায় অসংখ্য নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির মধ্যে খুঁজে বাংলা একাডেমির চাকরিতে আবেদন করেছিলাম। আবেদনপত্র প্রাথমিক বাছাই শেষে প্রথমে নেওয়া হয়েছে লিখিত পরীক্ষা। চাকরির পরীক্ষা হয়েছিল বাংলা একাডেমিতেই। তবে অন্যান্য নিয়োগ পরীক্ষার মতো এখানে গত্বাধা প্রশ্ন আসেনি। সাহিত্যসম্পর্কিত প্রশ্নই বেশি এসেছে। বেশির ভাগ প্রশ্ন ছিল বিশ্লেষণধর্মী। পরীক্ষকরা মূলত প্রার্থীর চিন্তাশক্তি এবং লেখার দক্ষতা বুঝতে পারেন—এমন প্রশ্ন করেছিলেন। যেহেতু আমি লেখালেখির সঙ্গে যুক্ত, সুন্দরভাবে নিজের মতামতকে তুলে ধরতে পেরেছিলাম এবং লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছিলাম।
ভাইভা বোর্ডে বিশিষ্ট লেখক এবং শিক্ষক ছাড়াও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। ভাইভা দিতে গিয়ে ওই পরিবেশটি ভয়ংকর কিছু মনে হয়নি আমার কাছে। শিল্প-সাহিত্য থেকেই মূলত নানা ধরনের প্রশ্ন করেছিলেন। নিজেকে সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পেরেছিলাম বলেই ভাইভা দেওয়ার পর মনে হয়েছিল চাকরিটা হবে।