জীবনজুড়ে সাফল্য
লিডারশিপ ডেস্ক
সাংবাদিকতা থেকে বিজ্ঞাপন সংস্থার পরিচালক, সাফল্য সর্বত্র। বিশ্বখ্যাত ম্যাগাজিন ফরচুনের স্বীকৃতি লাভ করেছেন তিনি। সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে নজর কেড়েছেন সবার। জীবনের প্রতিটি পদে রেখেছেন সাফল্যের পদচিহ্ন। হয়ে উঠেছেন সফল নারী উদ্যোক্তা। সেই অপরাজিতা, বিজ্ঞাপন সংস্থা ‘অ্যাডকম’-এর পরিচালক গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী ।
১১০ তেজগাঁও শিল্প এলাকা। এই ঠিকানায় কাজ করেন বাংলার ইতিহাসে বিশিষ্ট ভাষাবিজ্ঞানী ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নাতনি গীতি আরা চৌধুরী। নিজগুণে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন। মেয়ে হওয়া সত্ত্বেও অন্যসব নারীর মতো ঘরবন্দী হয়ে থাকেননি। আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে এসেও অনেকেই যা ভাবতে পারেননি তিনি তা ভেবেছিলেন বহু আগেই। আর এ ভাবনাকে শুধু ভাবনার মাঝেই সীমাবদ্ধ রাখেননি। করেছেন বাস্তবায়ন। যদিও তার স্বপ্ন যাত্রার এই পথটুকু খুব একটা সহজও ছিল না। তবুও সফলতার পরিপ্রেক্ষিতে তিনি ছাপিয়ে গিয়েছেন সমাজের তথাকথিত সবাইকে। তিনি দূরদর্শী নারী গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী। সফল নারী উদ্যোক্তা ও বিজ্ঞাপনী সংস্থা অ্যাডকম লিমিটেডের পরিচালক। সাফল্যের স্বীকৃতিস্বরূপ পেয়েছেন বহু পুরস্কার ও সম্মাননা। বিখ্যাত ফরচুন ম্যাগাজিনের স্বীকৃতি লাভ করেন।
তার শুরুটা ছিল সাংবাদিকতা দিয়ে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার সময় একমাত্র নারী সাংবাদিক হিসেবে পাকিস্তান আমলে কাজ করেন তিনি। তবে তার সেই অভিজ্ঞতা কিন্তু আজকের আট-দশজন নারী সাংবাদিকের মতো ছিল না। তার সে সময়কার সাংবাদিকতা সম্পর্কে বলেন, সে সময়ে সাংবাদিকতার মতো চ্যালেঞ্জিং পেশায় নারীদের পদচারণা ছিল না বললেই চলে। আমি তখন যে পত্রিকায় কাজ করতাম সেখানে আমাকে শিশুদের পাতা দেখার কথা বলা হলো। এরপর নারীদের পাতা দেখার এবং পরিশেষে দেওয়া হলো বিনোদন পাতা দেখার কাজ। মূলত আমি এই তিনটি পাতার সহকারী সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। এখানে থেমে থাকেননি। একদিন সাহস করে বলেন— আমি সংবাদ নিয়ে কাজ করতে চাই। সে সময় নারীদের সংবাদকর্মী হিসেবে যোগ্য ভাবা হতো না। তখন আমাকে বলা হলো, মেয়েরা সংবাদে সরাসরি কাজ করতে পারবে না। পুরো পত্রিকা অফিসে সব ছেলেদের মাঝে আমি একমাত্র মেয়ে সেখানে। গীতি আরা চৌধুরী যদিও সাংবাদিকতা পেশায় যোগ্যতার প্রমাণ রেখেছেন। এরপর জড়িয়ে পড়েন বিজ্ঞাপন সংস্থার অ্যাড কপি রাইটারের কাজে। তার সাংবাদিকতা থেকে বিজ্ঞাপনে আসার গল্পটি ছিল অন্যরকম। যদিও দুটি কাজের মাঝে তফাৎ লক্ষণীয়। সাংবাদিকতার লেখায় এক ধরনের ম আর কপি লেখায় আরেক ধরনের। এরপর থেকে তাকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। পেশা পরিবর্তনের মজার গল্পটি বলেন, সাংবাদিকতা থেকে বিজ্ঞাপন সংস্থায় পেশা পরিবর্তনের এ ঘটনাটি বেশ মজার ছিল। আমার সাথে তখন পশ্চিম পাকিস্তানের একটি মেয়ে কাজ করত। আমি পূর্ব পাকিস্তানের হওয়াতে আমার কোনো বন্ধুবান্ধব ছিল না। তবে মেয়েটির বিভিন্ন বিজ্ঞাপনী সংস্থার অনেক বন্ধুবান্ধব ছিল। ওরা নানা বিষয়ে রোজ গল্পজুড়ে দিত। কার কামিজ কত লম্বা হবে, কার লিপস্টিকের শেড কেমন হবে ইত্যাদি। আমি এসব গল্পে মজা পেতাম না। বিরক্ত লাগত বলে চুপ করে বসে থাকতাম। কথার ফাঁকে ফাঁকে মেয়েগুলো ওকে বলত, ক্লায়েন্ট তাদের লেখাগুলো পছন্দ করেনি। তখন জিজ্ঞাসা করলাম এমন কি লিখেছিলে যে পছন্দ করেনি। কিন্তু কে শোনে কার কথা! ওরা ওদের মতো শাড়ি-চুড়ির গল্পে মেতে থাকত। তবে, আমি কপি লিখে অফিসে দিয়ে আসতাম। মজার ব্যাপার হলো, হয় পরের দিন ওটা প্রিন্টে নয় তো আমি গেলে ওরা বলত, ‘আরে… তুম তো বাঙ্গাল কা জাদু কিয়া! সাব লোগ ইস কপি কো পাছান্দ কিয়া।’
মূলত এরপর থেকেই বিজ্ঞাপনের দিকে ঝুঁকে পড়েন তিনি।
গীতি আরা স্বাধীনতার পর ঢাকায় এসে একটি বিজ্ঞাপন সংস্থায় চাকরি পেয়ে যান। এখানে শুরুর দিকে কপি রাইটার হিসেবে কাজ করেন। অবশ্য কাজের দক্ষতায় এক মাসের মাথায় বস তাকে জেনারেল ম্যানেজার তারপর ভাইস প্রেসিডেন্ট বানিয়ে দেন। গীতি আরা সাফিয়া চৌধুরী বিশ্বাস করেন না মেয়েরা পিছিয়ে। তার মতে যে কোনো কাজেই মেয়েরা অনেক বেশি প্রত্যয়ী আর পরিশ্রমী। শুধু শহরের মেয়েরাই নয়, গ্রামের মেয়েরাও যে ব্যবসা করছে সেটা কিন্তু খুব কম দেখা যায়। কিন্তু গ্রামের মেয়েরা অনেক ব্যবসা করে সেটা প্রচারের অভাবে আমাদের জানা নেই। গ্রামের মেয়েরা নান্দনিক কাঁথা বানাচ্ছে, আচার বানাচ্ছে, মাটির তৈরি হস্তশিল্প তৈরি করছে, ডেইরি ফার্ম করছে, সবজি চাষ করে তা বিক্রি করছে। বিভিন্ন ব্যবসায়ের সঙ্গে এখন মেয়ের পুরুষের পাশাপাশি সমান তালে এগিয়ে যাচ্ছে। মেয়েরা অনেক সংগ্রামী আর পরিশ্রমী। এভাবেই তাদের এগিয়ে যেতে হবে। আবার এও সত্য যে মেয়েরা যে কাজটি করে খুব মনোযোগ দিয়ে করে। তার মতে, মেয়েদের ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে ওঠার জন্য রাগ আর জিদকে প্রধান্য দিলে হবে না, অনেক বেশি সতর্ক আর বিনয়ী হতে হবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগ থেকে অনার্স মাস্টার্স করেছেন গীতি আরা। মিসরের স্কুলে পড়ার সময়ই তার ভেতরে মানবিক গুণাবলীর বীজ রোপিত হয়। আধুনিক আর সভ্য জীবনযাপনের মৌলিক শিক্ষা পেয়েছিলেন পরিবারের কাছ থেকেই। মেয়েরা যে কোনো কাজেই অনেক বেশি প্রত্যয়ী আর পরিশ্রমী। ব্যক্তিজীবন, সমাজ, দেশ কিংবা গোটা বিশ্ব সবখানেই নারী যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে সেভাবেই এগিয়ে যাবে— এটাই তার বিশ্বাস।