দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু : ওরা মনের আলো ছড়াতে চায় !
সোহানা। পুরো নাম ফারহিম আনজুম সোহানা। বয়স তার সতেরোর কোটায়। মিরপুর আইডিয়াল গার্লস কলেজের একাদশ শ্রেণীর ছাত্রী। ও যখন গান ধরে, ‘আমার চোখের আলো ফিরিয়ে দাও/ আমি এই সুন্দর পৃথিবী দেখতে চাই’, তখন মা হয়ে নিজেকে খুব বেশি অসহায় মনে হয়— এ কথা শেষ না করতেই পদ্মার ভাঙন আসে সোহানার মায়ের অসহায় চোখের কিনারে! কারণ তার সোহানা যে জন্মগতভাবে একজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী।
আর ১০টা শিশুর মতো ওরও ইচ্ছে করে দেখতে এ ধরিত্রীর মোহময়ী রূপ। ইচ্ছে করে হেমন্তের পড়ন্ত বিকেলে বাড়ির নিকানো উঠোনজুড়ে দুরন্তপনা কিংবা খেলার মাঠ আর সবুজমাখা ফসলের তরে ঘাসফড়িং হয়ে ছোটাছুটি করতে। কিন্তু সোহানার জীবন আজ বৃত্তাবদ্ধ এক অমোঘ নিয়তির ছকে। তবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী সোহানাদের দু’চোখের আলো না থাকলেও তারা শিক্ষার আলোয় ছড়াতে পারে মনের আলো। এজন্য প্রয়োজন পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রের নিবিড় সহযোগিতা। তাহলেই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুরা সমাজে অবহেলা আর করুণার পাত্র নয়, হয়ে উঠবে মর্যাদার প্রতীক। ১৫ অক্টোবর বিশ্ব সাদাছড়ি নিরাপত্তা দিবসের প্রতিপাদ্য বিষয়ও ছিল তাই— সাদাছড়ি হোক আত্মমর্যাদার প্রতীক।
২. ‘সাদাছড়ি’ হচ্ছে একটি লাঠি বা ডাণ্ডা, যেটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের নিরাপত্তা ও মর্যাদার প্রতীক। আজকাল ভাঁজ করা সাদাছড়ির পাশাপাশি ভার্চুয়াল সাদাছড়িও ব্যবহার করছে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষজন। ভার্চুয়াল সাদাছড়ির টেকনিক্যাল নাম লেজার বেজড রেঞ্জ সেন্সিং ডিভাইস। এতে একটি ক্যামেরা, লেজার টর্চ ও মাইক্রোপ্রসেসর থাকে। এটি ছোট্ট হওয়ায় অনায়াসে পকেটে রাখা যায়। হাতের মুঠোয় রেখেই এটি দিয়ে পথের উঁচু-নিচু, দূরত্ব, বাধা বিষয়ে ধারণা পাওয়া যায় এবং অন্যের সহযোগিতা ব্যতীত এটি দিয়ে তারা স্বাধীনভাবে চলাফেরা করতে পারে। তাই সাদাছড়ি অন্ধত্বের প্রতীক নয়, বরং দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের সাদাছড়ি আজ মর্যাদা আর ক্ষমতায়নের প্রতীক। আধুনিক তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আর জ্ঞান-বিজ্ঞানের যুগে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সমাজের বোঝা নয়, বরং ওরা সমাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, কর্মসংস্থান ও পুনর্বাসনের মাধ্যমে স্বাবলম্বী তথা আত্মনির্ভরশীল হিসেবে গড়ে তোলার লক্ষ্যে স্বাধীনভাবে চলাচলের নিরাপত্তা বিধানের স্বার্থে সাদাছড়ি আজ মূর্তপ্রতীক, যেটার দ্বারা তাদের চলাচলের পথ হয় সহজ। ১৯৬৪ সাল থেকে দিবসটি সারা বিশ্বে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের মর্যাদার প্রতীক এবং বাংলাদেশে সত্তরের দশক থেকে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের স্বাধীনতার প্রতীকস্বরূপ পালিত হয়ে আসছে। কিন্তু দেশে বসবাসরত ৩০ লাখ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে এখনো কাঙ্ক্ষিত পরিবর্তন, আত্মবিশ্বাস আর মুক্তভাবে নির্বিঘ্নে চলাচলের স্বাধীনতা নিশ্চিত করা যায়নি। এখনো রাষ্ট্র অধিকাংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুকে মনের আলো ছড়ানোর মূল আধার ‘শিক্ষা’র সংস্পর্শে নিয়ে আসতে পারেনি। যদিও পৃথিবীর অন্যান্য কল্যাণ রাষ্ট্রের ন্যায় বর্তমান সরকার সামাজিক নিরাপত্তাবেষ্টনীর সুদৃঢ়করণের লক্ষ্যে দেশের দুস্থ, অবহেলিত, পশ্চাত্পদ, দরিদ্র, এতিম, প্রতিবন্ধী ও অনগ্রসর মানুষের কল্যাণ ও উন্নয়নের লক্ষ্যে বহুমুখী কার্যক্রম বাস্তবায়ন করছে।
৩. অনেকেই আমাকে প্রশ্ন করেন, ‘আমার শিশুটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিনা প্রাথমিক অবস্থায় কীভাবে নির্ণয় করব?’ এখানে প্রাথমিক পর্যায়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা চিহ্নিতকরণে দুটি লক্ষণের অবতারণা করতে চাই। প্রথমটি হলো দর্শনীয় এবং দ্বিতীয়টি হলো আচরণগত। এ দুটি লক্ষণই বলে দেবে আপনার শিশু প্রাথমিকভাবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কিনা বা হলে কী ধরনের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী। যেমন— দর্শনীয় লক্ষণগুলো হলো— চোখের পাতা লাল হওয়া, চোখের পাতার কিনারে শুষ্ক আস্তরণ, প্রায়ই চোখ ফুলে যাওয়া, বক্রদৃষ্টি, চোখের মণি যথেষ্ট নড়াচড়া, চোখ থেকে প্রায়ই তরল পদার্থ নিঃসরণ হওয়া কিংবা চোখের পাতা ঝুলে পড়া। আর আচরণগত লক্ষণগুলো হলো— ঘন ঘন চোখ রগড়ানো, কোনো একটি চোখ বন্ধ বা ঢেকে রাখা, আলোর প্রতি অতিরিক্ত সংবেদনশীলতা, পড়া বা অন্য কাজে সমস্যা এবং চোখের কাছে নিয়ে দেখা, চোখব্যথা, মাথাব্যথা, চোখে ঝাপসা দেখা, দূরের জিনিস দেখতে সমস্যা হওয়া, কোনো বর্ণ বা শব্দ উল্টো দেখা, বর্ণ চিনতে ভুল করা, পড়ার সময় বাক্য বা শব্দ হারিয়ে ফেলা বা লেখার মধ্যে অসম ফাঁক দেয়া এবং সারি সোজা রাখতে না পারার লক্ষণগুলো বলে দেয় সে কোনো না কোনো ধরনের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার শিকার (সূত্র: রুমিজ উদ্দীন আহমেদের প্রতিবন্ধী বিশেষ শিক্ষার চাহিদাসম্পন্ন শিশু বইয়ের পৃষ্ঠা নং ৩৪)। প্রাথমিক অবস্থায় শিশুর দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা নির্ণয় করতে পারলে প্রতিবন্ধিতার মাত্রা অনেকাংশে সহনশীল পর্যায়ে রাখা সম্ভব হয়। এজন্য প্রয়োজন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা বিষয়ে সমাজে ব্যাপক সচেতনতা।
৪. সরকার দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য ১৯৭৪ সাল থেকে প্রতিটি জেলায় পর্যায়ক্রমে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম চালু করেছে, যেখানে প্রতি জেলায় বিশেষ প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রিসোর্স শিক্ষক দ্বারা ব্রেইল পদ্ধতিতে ১০ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুকে শিক্ষা প্রদান করা হয়। তাদের আবাসনসহ পড়াশোনার যাবতীয় খরচ সরকার বহন করে। তাছাড়া সরকারিভাবে চারটি বিভাগীয় শহর যেমন— ঢাকা, রাজশাহী, বরিশাল ও খুলনায় পৃথক চারটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুল রয়েছে, রয়েছে বেসরকারিভাবে বেশ কয়েকটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের স্কুল। এসব বিশেষায়িত স্কুল ও সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী কার্যক্রমের আওতায় সম্ভাব্য মোট এক হাজারের অধিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু প্রাথমিক পাঠ সমাপনের সুযোগ পায়। কিন্তু দেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুর সংখ্যা প্রায় সাত লাখ; যা দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষার চাহিদার তুলনায় মোটেও উল্লেখযোগ্য নয়। তাছাড়া প্রতিবন্ধিতার ধরন অনুযায়ী চলমান দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী স্কুলগুলো কতটুকু দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীবান্ধব, সেটাও একটি প্রশ্ন। কারণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের শিক্ষা উপকরণ হতে হবে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীবান্ধব। নচেত্ এ মহত্ উদ্যোগগুলো অনেকাংশে সফল নাও হতে পারে। যেমন— পুরোমাত্রায় দৃষ্টিহীন শিশুর শিক্ষা কার্যক্রমে পঠন ও উপকরণ ধরন আর আংশিক দৃষ্টিহীন শিশুর পঠন ও উপকরণে যেমন পার্থক্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্য রয়েছে আংশিক ও ক্ষীণদৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুর পঠন ও উপকরণের মধ্যেও। এক্ষেত্রে রিসোর্স পারসনের পাঠদান পদ্ধতিতেও বিভিন্নতার প্রয়োজন রয়েছে। তা না হলে বিশেষ করে সমন্বিত দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম অনেকাংশে ফলপ্রসূ হবে না। এখানে পাঠকদের দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের প্রকার বা ধরন বিষয়ে একটু ধারণা দিতে চাই। প্রতিবন্ধী ব্যক্তির অধিকার ও সুরক্ষা আইন-২০১৩-এর সংজ্ঞামতে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতা তিন ধরনের যথা— সম্পূর্ণ দৃষ্টিহীনতা, আংশিক দৃষ্টিহীনতা ও ক্ষীণদৃষ্টি। যেসব শিশু উভয় চোখে একেবারে দেখতে পারে না বা যথাযথ লেন্স ব্যাবহারের পরও দৃষ্টি তীক্ষতা ২০/২০০-এর কম এবং দৃষ্টিক্ষেত্র ২০ ডিগ্রি বা এর চেয়ে কম, এ ধরনের শিশুকে সম্পূর্ণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী বলা হয়। যেসব শিশু এক চোখে একেবারেই দেখতে পারে না, তাদের আংশিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশু বলা হয়। তাছাড়া যেসব শিশু উভয় চোখে আংশিক বা কম দেখতে পারে বা যথাযথ লেন্স ব্যবহারের পরও দৃষ্টি তীক্ষতা ২০/৬০ ও ৬/৬০ বা ২০/২০০-এর মধ্যে এবং দৃষ্টিক্ষেত্র ২০ থেকে ৪০ ডিগ্রির মধ্যে, এদের ক্ষীণদৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশু বলা হয়। এখানে সহজেই বোধগম্য যে, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধিতার মাত্রা অনুযায়ী সহায়ক উপকরণ যেমন— ব্রেইল পদ্ধতির লিখন যন্ত্র ও ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখা পুস্তক, গণনার যন্ত্র অ্যাবাকাস কিংবা সাধারণ লেখাকে স্পর্শ সংবেদনশীল রূপান্তর করার যন্ত্র অপটাকন ও অন্যান্য ইলেকট্রনিক যন্ত্র সম্পূর্ণ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুর শিক্ষা কার্যক্রমে থাকা বাধ্যতামূলক হলেও অনেকাংশে আংশিক ও ক্ষীণদৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুর প্রয়োজন নাও হতে পারে। আবার ক্ষীণদৃষ্টি প্রতিবন্ধী শিশুর জন্য ম্যাগনিফাইং গ্লাস কিংবা বড় অক্ষরে ছাপা বই বাধ্যতামূলক হলেও আংশিক দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুর এগুলো ছাড়াও চলতে পারে। তাই দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিক্ষা কার্যক্রম ফলপ্রসূকরণে বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনার দাবি রাখে।
৫. বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী শিশু রয়েছে প্রায় ৩৫ লাখ, যার একটি নির্দিষ্ট অংশ দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী; যাদের শিক্ষার আলোয় আলোকিত করার কোনো বিকল্প নেই। পাশাপাশি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুদের ব্যক্তিগত স্বাস্থ্য পরিচর্যা, সামাজিক আচরণ, বিনোদন, অর্থের ব্যবহার, সাংসারিক কাজ ইত্যাদি বিষয়ে পরিবারের সদস্যদের বিশেষ গুরুত্ব দিয়ে শেখানো প্রয়োজন। তাছাড়া সামাজিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণ, কেনাকাটা করতে শেখানো, এমনকি সিদ্ধান্ত গ্রহণমূলক দক্ষতাসহ তাদের দিতে হবে বিবিধ স্থান ও চলনদক্ষতা বিষয়ে বিশেষ প্রশিক্ষণ। তবেই ওরা হয়ে উঠবে সমাজের বোঝা না হয়ে আশীর্বাদ। ওরা করুণা নয়, ওরা চায় সুযোগ। সুযোগ পেলে ওরাও পরিবার, সমাজ কিংবা রাষ্ট্রে ছড়াতে চায় মনের আলো!