ধনীরা কেন কাজপাগল ?
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
কিথ, সিলিকন ভ্যালির এক সফল উদ্যোক্তা। তার প্রতিষ্ঠানটি যখন পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে পরিণত হয় তখন একসঙ্গে বিরাট অংকের টাকা হাতে এসে যায়। রাতারাতি ধনাঢ্য ব্যক্তিতে পরিণত হন। এরপরই ভাবতে লাগলেন, আর কাজ করতে হবে না।
নিজের বিস্তারিত পরিচয় প্রকাশে আপত্তি কিথের। তাই এই নিক নামটাই ব্যবহার করা হলো। প্রাথমিক গণপ্রস্তাব (আইপিও) থেকেই তার আয় হয়েছিল কয়েক লাখ ডলার। কিথের ভাষায়, এতো পরিমাণ টাকা ছিল জীবন পাল্টে দেয়ার মতো। এটা তাকে এতোটাই আর্থিক নিরাপত্তা দিল, যে স্বপ্নের মতো। এরপর সব কাজে ইস্তফা দিয়ে দেশে-বিদেশে ঘুরতে লাগলেন কিথ। যেখানে সেখানে টাকা উড়াতে লাগলেন। তবে এক পর্যায়ে জেঁকে বসলো বিরক্তি। কিথের ভাষায়, এভাবে জীবনকে আর উপভোগ করতে পারছিলেন না তিনি।
বেশিরভাগ লোকের মতো কিথ এক সময় ভাবতেন, তিনি কাজ করছেন শুধু টাকা কামানোর জন্য। পরে এই ধারণা পাল্টে যায়। সারা জীবন খরচ করার মতো অর্থ থাকার পরও নতুন কাজ খুঁজতে শুরু করেন। কিথ বলেন, ‘কাজহীন বিলাসী জীবন নিয়ে হতাশ হয়ে উঠলাম। জীবনের উদ্দেশ্য ঠিক বুঝে উঠতে পারছিলাম না। আমার কর্মদক্ষতা কমে যাচ্ছিল। এমনকি অন্য লোকজনের সঙ্গে বুদ্ধিবৃত্তিক যোগযোগটাও কঠিন হয়ে যাচ্ছিল।’
কিথের বয়স এখন তিরিশের কোটায়। তিনি মনে করেন, অর্থ উপার্জন ছাড়াও আমাদের জীবনের একটি উচ্চতর উদ্দেশ্য আছে। কর্মহীন জীবনের ইতি টেনে এখন আবার কাজে মনোনিবেশ করেছেন কিথ। বেকার জীবনের চেয়ে এখন নিজেকে অনেক বেশি সুখী মনে হচ্ছে।
কাজ, অর্থ ও জীবনের মানে খুঁজতে গিয়ে বিশ্লেষকরা বলছেন, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন, ধনী হওয়া মানেই অফুরন্ত স্বাধীনতার টিকিট পেয়ে যাওয়া। বাস্তবতা কিন্তু তা নয়। কাজ না থাকলে আপনার কিছুই ভালো লাগবে না। আপনি অনেক ধনীদের ক্ষেত্রেও দেখতে পাবেন, অঢেল সম্পদের মালিক হওয়ার পরও তারা কাজের মধ্যে ডুবে থাকেন। এমন অসংখ্য ধনকুবের পাবেন, যাদের কাজ না করার মতো যথেষ্ট কারণ থাকা সত্ত্বেও কর্মহীন থাকেন না। উদাহরণ হিসেবে অ্যামাজনের জেফ বেজোস বা ফেসবুকের মার্ক জাকারবার্গের কথাই ধরুন। অনবরত নিজেদের প্রতিষ্ঠানের পেছনে সময় দিচ্ছেন তারা।
তবে এর ব্যতিক্রমও পাওয়া যাবে। অনেকেই আছেন যাদের যথেষ্ট পরিমাণ অর্থও আছে আবার কাজেও নিযুক্ত হতে চাইছেন না। এর কারণ হতে পারে বেতন এবং কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্টির মধ্যকার সম্পর্ক। অনেকে কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্টিকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বেতনের দিকে তাকান না। আবার অনেকে বেতনের দিক চিন্তা করতে গিয়ে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের কথা ভাবেন না।
যুক্তরাষ্ট্রের ইউনিভার্সিটি অব ফ্লোরিডার বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক টিমোথি জাজ এবং তার সহ-গবেষকরা জানান, বেতন এবং কর্মক্ষেত্রে সন্তুষ্টির অভাবে কর্মহীন থাকেন দুই শতাংশেরও কম মানুষ। অনেকে ঘনিষ্ঠ কোনো সম্পর্ক থাকলে, বড় ধরনের কোনো প্রজেক্টে কাজের সুযোগ পেলে বা নেতৃত্ব দেয়ার মতো কাজ হলে অর্থের চেয়ে সন্তুষ্টির বিষয়টিকেই বেশি প্রাধান্য দেন।
তবে কখনো কখনো অর্থের প্রয়োজনীয়তা হয়ে পড়ে তীব্র। ইসরায়েলভিত্তিক পরামর্শক প্রতিষ্ঠান ওয়েলথ লিগেসি গ্রুপের প্রতিষ্ঠাতা জেমি ট্রায়েগার মুনি বলেন, এসব ক্ষেত্রে যতক্ষণ না আমরা সম্পদের তীব্র প্রয়োজনীয়তা অনুভব করি ততক্ষণ প্রকৃত অবস্থা বুঝে উঠতে পারি না। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশেই কাজ করে ওয়েলথ লিগেসি গ্রুপ। জেমি জানান, তার প্রতিষ্ঠান থেকে পরামর্শ গ্রহণকারী ৯৮ শতাংশই আর্থিক নিরাপত্তা নিশ্চিত হওয়ার পরই কাজে যোগ দেন।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেকার বসে থাকার আরেকটি কারণ আছে: সামাজিক মর্যাদা। কেউ তার কাজে উচ্চ দক্ষতাসম্পন্ন হওয়া সত্ত্বেও নিজেকে প্রমাণ করার সুযোগ না পেলে সেখানে মন বসাতে পারেন না।
কোপেনহেগেন বিজনেস স্কুলের অধ্যাপক ব্রুকি হ্যারিংটন বলেন, ‘আমরা যখন এমন কাজে নিয়োগ পাই যখন কর্মক্ষেত্রে অন্যরা আমাদের সামাজিক অবস্থান বুঝতে পারেন না এবং বোঝানোর সুযোগও দেন না তখনই আমাদের মর্যাদাহানি হয়।’
যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসভিত্তিক একটি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কারেন গর্ডন মনে করেন, লোকজন নিজের কাজে পূর্ণতার বিষয়টি উপভোগ করতে চায়। তারা প্রতিযোগিতা ভালোবাসে এবং জিততে চায়। কখনো কখনো হঠাৎ অর্থবিত্তের মালিক হয়ে যাওয়ার পর কিছু নেতিবাচক আবেগ কাজ করে। কেউ কেউ কাজ ছেড়ে অবসর উপভোগ করতে চায়। কিন্তু এটা কয়েক মাসেই তাদের মধ্যে হতাশা নিয়ে আসে। এসব কারণেই অনেকে কাজ থেকে বিরত থাকতে চান কিন্তু খুব অল্প সময়ের জন্যই তা পারেন।
জেমি বলেন, দীর্ঘ সময় কর্মহীন থাকা সুখ কিংবা সন্তুষ্টি কোনোটাই দিতে পারে না। আপনার উচিত দ্রুতই কাজে যোগ দেয়া। যারা অল্প বয়সে সম্পদের মালিক হয় তাদের মধ্যেই কাজ ছেড়ে দেয়ার প্রবণতা বেশি থাকে বলেও মনে করেন তিনি।
জেমির পরামর্শ, আপনি যখন দ্রুতই ধনী হয়ে যাবেন তখন এক বছরের মধ্যে নতুন টার্গেট নিয়ে কাজ শুরু করুন। এতে প্রথমবারের মতো দ্বিতীয়বারও সফলতা পাওয়ার সম্ভাবনা বেশি। এক্ষেত্রে হেরে যাওয়ার বিষয়টিও মাথায় রাখতে হবে এবং প্রয়োজনে তৃতীয়বারের মতো শুরু করতে হবে।
কিথও মনে করছেন, অব্যাহতভাবে কাজ করে যাওয়াই তার জীবনকে অর্থপূর্ণ করেছে। ভ্রমণ কিংবা বন্ধুদের সঙ্গে সময় নষ্ট করার চেয়ে কাজই মানুষকে অনেক বেশি দায়িত্বশীল রাখে। কখনো কখনো বড় ধরনের চ্যালেঞ্জ এলে অনেকে কাজ ছেড়ে দিতে চায়। তবে এটাকে কর্মক্ষেত্রে পূর্ণতাদানকারী বলেই ধারণা কিথের। বিশেষ করে অল্প বয়সে যারা অর্থ বিত্তের মালিক হয়েছেন তারা এ ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে অভ্যস্ত হলে তা ভবিষ্যতে সুফল বয়ে আনবে।