বিকশিত করি নেতৃত্ব গুণ
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
নেতৃত্ব একটি শিল্প। পৃথিবীতে এই শিল্পের কুশলীর অভাব প্রচণ্ড। নেতৃত্বের সংকটে একটি জাতি ধ্বংসের মুখোমুখি হয়। প্রকৃত নেতৃত্ব তখনই গড়ে ওঠে যখন কতগুলো নির্দিষ্ট বিষয় একযোগে কাজ করে এবং সফলতা অর্জিত হয়। নেতা ভুল করে বসলে সবই পণ্ড হয়। আমরা স্বভাবতই কিছু কর্মকাণ্ডকে নেতৃত্ব বলে থাকি যেমন- একক আধিপত্য, ভালো বক্তা, যেকোনো ধরনের পরামর্শদানে সক্ষমতা অথবা কোনো সিদ্ধান্তকে প্রভাবিত করার সক্ষমতা। কিন্তু সত্যিই কি তাই? নেতা কখনোই মানুষকে উপেক্ষা করে সিদ্ধান্ত দেন না। নেতৃত্ব কখনোই জনবিচ্ছিন্নতা নয়। নেতৃত্ব কখনোই জনশূন্য জায়গায় বেঁচে থাকতে পারে না। নেতৃত্ব কখনোই দাম্ভিকতা নয়। নেতৃত্ব কখনোই নেতা সম্পর্কিত বিষয় নয়।
কিন্তু সম্প্রতি আমরা কি দেখছি, নেতা বলতে আমরা বুঝি এমন মানুষকে যারা সব সময় ইগোসেন্ট্রিক কথা-বার্তা বলেন। তাদেরকে আমরা দেখি দেয়ালের ওপারে। তাদেরকে আমরা শুনি নির্দিষ্ট দূরত্ব থেকে। প্রকৃতপক্ষে তাদের কাজ মানুষের সমস্যা সমাধান করা, খারাপের দিকে ঠেলে দেওয়া নয়; এই সত্যিটিই অনেক নেতার অভিধানে নেই। ইতিহাসের পাতায় যে নেতারা স্বর্ণাক্ষরে লিখিত আছেন, তারা নিবিড়ভাবে মানুষের জন্য কাজ করেছেন। তারা তাদের কাজের ক্ষেত্রে যত্নশীল ছিলেন। তারা কখনোই অশুভর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ করতে ভয় পাননি। তারা ভয় পান নিজস্ব সীমাবদ্ধতাকে আর তাই তাদের প্রতিটি মুহূর্তই কাটে কৌতুহলী এবং নতুন কিছু জানার প্রক্রিয়ায় মধ্য দিয়ে। প্রকৃত নেতা কখনোই কে সঠিক সে বিষয়ে আগ্রহ দেখান না তাদের আগ্রহের জায়গা হলো কোনটি সঠিক। তারা শুধু সিদ্ধান্তে বাধা প্রদান করেই ক্ষান্ত হন না-নতুন উপায় সন্ধানও করে থাকেন। একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, প্রকৃত নেতৃত্ব কখনোই তার আশপাশের মানুষদের এড়িয়ে যান না। প্রত্যেকের সাথে কথা-বার্তা বলে, আলোচনা করে, সংলাপ করে অথবা প্রয়োজনে বিতর্কেও যান কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে। তারা খুব ভালো করেই জানেন, সবার কথা শুনে, উপলদ্ধি করে কাজ করাকেই সফল নেতৃত্ব বলে।
রাজনৈতিক নেতৃত্ব, ব্যবসায়িক নেতৃত্ব অথবা যেকোনো ধরনের নেতৃত্বের ক্ষেত্রে সত্যিকারের সূত্রগুলো কিন্তু একই। আর নিজের মধ্যে এইরকম নেতৃত্বগুণ গড়তে চাইলে ৮টি বিষয় নিবিড়ভাবে মেনে চলতে হবে।
১. প্লাটফর্ম নয় মানুষই হলো নেতৃত্বের মূল :
আমরা সব সময়ই বলে থাকি একটা ভালো প্লাটফর্ম থাকলে নেতৃত্ব দেখানো সুযোগ থাকতো। যারা কিনা এই প্লাটফর্মের আফসোস করে সময় নষ্ট করছেন তাদের বলছি, আপনি কখনোই একটি প্লাটফর্মকে নেতৃত্ব দেবেন না আপনি নেতৃত্ব দেবেন মানুষকে। প্রকৃত নেতৃত্বের জন্য এটা খুব সহজ বিষয়। তারা লক্ষ্য রাখেন মানুষের ওপরে কখনোই বস্তু বা প্লাটফর্ম নয়। তারা খুব ভালো করেই জানেন, মেধাবী কর্মী এবং একটি চমৎকার সংস্কৃতি ছাড়া যেকোনো ভালো কৌশলই ব্যর্থ হতে পারে। প্রকৃত নেতৃত্ব বোঝেন প্লাটফর্ম কখনোই সমস্যা সমাধান করতে পারে না, মানুষ তা পারে। নেতৃত্বের তখনই জয় হয় যখন মানুষ জয়ী হয়।
২. চিন্তার সীমাবদ্ধতা নয়, প্রয়োজন উদ্ভাবন :
একজন দক্ষ নেতা কখনোই কিছু নির্ধারিত ধারণার মধ্যে আটকে থাকতে পারেন না। তারা কখনো আদিকালের কিছু ছকে বাঁধা নিয়ম মেনে কোনো সিদ্ধান্ত নেন না। তারা প্রতিটি সিদ্ধান্তের জন্য যৌক্তিক ও সমসাময়িক সমস্যার কথা মাথায় রেখে তাদের কার্যপ্রণালী সাজান। তারা তাদের প্রতিটি কাজের জন্য পাশাপাশি আরও কয়েকটি সম্পূরক চিন্তা মাথায় রেখে কাজের রূপরেখা তৈরি করে থাকেন। আর তাই ভালো নেতৃত্বের জন্য সীমাবদ্ধতা একটি বড় বাধা। তাদের কাজের ও মুক্তচিন্তা লালনের চর্চাই প্রতিটি ক্ষেত্রে সাফল্য বয়ে আনে।
৩. সর্বব্যাপিতা :
এ ব্যাপারে সত্যি কোনো সন্দেহ নাই নেতৃত্বে কমান্ড করা ও শৃঙ্খলিত নিয়মের মধ্য দিয়ে চলা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের জানা উচিত- নেতৃত্ব কখনোই একটি স্কেল নয়। একটি ধরা-বাঁধা নিয়ম নয়। মানুষ যন্ত্র নয় যে যা হুকুম হবে তাই করবে। নেতৃত্ব মানুষকে অন্ধকারে আচ্ছন্ন করে রাখে না, আলোকিত করে। ভালো-খারাপ বিবেচনা করে কাজ করতে সহযোগিতা করে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নেতৃত্বকে ভুলভাবে ব্যবহার করা হয়ে থাকে। কিছু প্রতিষ্ঠান নেতৃত্বকে তাদের মতো করে ব্যবহার করে। একটা রুটিন কাজের মধ্যে বেঁধে দেয়। এভাবেই তারা একটি সম্ভাবনাকে ভুল পথে নিয়ে যায়। আর তাই ভালো নেতৃত্বের জন্য সর্বব্যাপিতা খুবই জরুরি।
৪. ভালো শ্রোতা হতে হবে :
প্রতিদিন আপনার কাছে বিভিন্ন ধরনের অভিযোগ, অনুযোগ, ব্যক্তিগত কথাবার্তা, পারিবারিক সমস্যা নিয়ে অনেকেই আসতে পারে। আপনি যদি প্রকৃত নেতা হতে চান তবে প্রত্যেকের সমস্যাই আপনি মনোযোগ সহকারে শুনবেন। তাদের আবেগময় বিষয়গুলোতে সমবেদনা জানাবেন। আপনার কর্মীদের দুঃখের কথা শোনার সময়ে আপনার মুখের অবয়বও সমবেদনাময় থাকবে। মোট কথা, আপনাকে একজন দক্ষ শ্রোতা হতে হবে। আপনার অধীনস্তকে কখনোই বুঝতে দেবেন না আপনি তার বস। সব সময় তার সাথে সহকর্মীর মতো আচরণ করবেন। আপনি তাদের সাথে খুব ভালো ব্যবহার করবেন। আর এভাবেই আপনি তাদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠবেন। আর তাই নেতৃত্বের একটি বড় শর্ত ভালো শ্রোতা হওয়া।
৫. দায়িত্বশীলতা, জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা :
একজন প্রকৃত নেতা কখনোই অন্যের প্রশংসা করতে দ্বিধা করবেন না। এবং নিজের ভুল স্বীকার করতেও ভয় পান না। তারা সব সময় তাদের ভুল স্বীকারের জন্য প্রস্তুত থাকেন এবং ভুল থেকে কিছু শিখে নেন। কোনো মানুষই ভুলের উর্ধ্বে নন। আমরা সব সময় ভালোকে প্রশংসার সাথে গ্রহণ করি। কিন্তু কখনোই সাহসকে প্রশংসা করি না যখন তা ব্যর্থ হয়। অনেক নেতা আছে যারা কিনা স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়িত্বশীলতা সব সময় এড়িয়ে চলেন। তাদের উদ্দেশ্য করে বলছি, অনেক ক্ষেত্রেই ভালো নেতার কাছ থেকে পারফেক্ট কাজ আশা করা হয় না। আশা করা হয় স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহিতা। প্রকৃত নেতৃত্ব গড়ে উঠার পেছনে এই স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা এবং দায়িত্বশীলতার বিরাট অবদান। কারণ এই বিষয়গুলো যার মধ্যে আছে তিনি সবার কাছে বিশ্বাসী এবং সৎ যোগ্য নেতা হিসেবে জায়গা করে নেন।
৬. আপসহীনতা :
এই রাস্তায় যাবো নাকি ওই রাস্তায় যাবো এমন সিদ্ধান্তে যাওয়াটা খুব জরুরি নয় ভালো নেতৃত্বের কাছে। একটি রাস্তা বেছে নেওয়ার চেয়ে দুইটি রাস্তা বুঝে নেওয়াটাই হলো প্রকৃত নেতৃত্বের দক্ষতা। একটি কাজ আপনাকে কিছুটা এগিয়ে দিতে পারে কখনোই সম্পূর্ণ পথটা দেখিয়ে দেবে না। আপনাকে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে আপসহীনভাবে। একজন প্রকৃত নেতা কখনোই তার কাজের ব্যাপারে আপস করবে না। তার নৈতিক মূলবোধের মধ্যে থেকে জয়যাত্রা চালিয়ে যাবে। এই রকম কোনো ইতিহাস নেই যেখানে কোনো নেতা মহানুভবতা দেখিয়ে জয়ের রাস্তা থেকে সরে গেছে।
৭. ঝুঁকি গ্রহণের মানসিকতা :
একজন সফল নেতা অনেক কঠিন সময় পেরিয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যান। এ ক্ষেত্রে হার না মানার মানসিকতাই তাকে জয়ী করে তোলে। সফল নেতৃত্বের হাত ধরেই সমাজ তার গতানুগতিক ব্যবস্থা ভেঙে প্রগতিশীলতার দিকে এগিয়ে যায়। নেতা শুধু নিজেই ত্যাগ স্বীকার করেন না। অন্যকেও ত্যাগের মহিমায় দীক্ষিত করে থাকেন। ঝুঁকি এড়িয়ে যাওয়া পক্ষান্তরে সম্ভাবনাকে হাতছাড়া করার নামান্তর। গৃহীত ঝুঁকিতে প্রাপ্ত সাফল্যই সফল নেতৃত্বের মাপকাঠি।
৮. লক্ষ্য বিন্যস্তকরণ :
একটি বৃহৎ সাফল্য ধাপে ধাপে অর্জিত বিভিন্ন সাফল্যের সমন্বিত রূপ। সফল নেতৃত্বের জন্য সঠিক সময়ে সঠিক লক্ষ্য নির্ধারণ এবং লক্ষ্য অর্জনের ধারাবাহিকতা ও সমন্বয় অত্যন্ত জরুরি। শুধু তাই নয়, একজন প্রকৃত নেতা প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতার সৃষ্টি করে। ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্যের সমন্বয় সাধনের ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি প্রভাবিত করে প্রকৃত নেতৃত্ব। প্রতিষ্ঠানের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কৌশল এবং ব্যক্তির লক্ষ, উদ্দেশ্য ও কৌশলের যোগসূত্রই একজন নেতাকে সফল করে তোলে।