নার্সিংয়ে ক্যারিয়ার
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
বিপদ কখনও বলে-কয়ে আসে না। স্বাস্থ্যজনিত বিপদে আমাদের ছুটতে হয় হাসপাতালে; আশ্রয় নিতে হয় ডাক্তারের কাছে। দেখে-শুনে, টেস্ট করে ওষুধ-পথ্য লিখে দেন ডাক্তার। আর শুশ্রূষার কাজটি পরম মমতায় করে যান সে পেশার মানুষ, তাদের নার্স বলে ডাকা হয়।
অথবা যদি ধরা যায় বয়স্ক মানুষদের কথা : বয়োজ্যেষ্ঠদের দেখভাল করার দায়িত্ব এই নাগরিক ব্যস্ততার জীবনে আমরা চাইলেও সামলাতে পারি না ঠিকঠাক। এ এক আধুনিক বিপদই বটে! এ বিপদেও মমতার হাত বাড়িয়ে দেন একেকজন নার্স।
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে নার্সিং পেশায় ক্যারিয়ারের ব্যাপ্তি দিন দিন বাড়ছে। প্রতিনিয়ত বাড়ছে নার্সের প্রয়োজনীয়তা_ হোক তা দেশে, কিংবা বিদেশে। এ পেশার চাহিদাকে স্থান-কাল-পাত্রে সীমাবদ্ধ করা যায় না। যদি দেশের সার্বিক পরিস্থিতির দিকে তাকাই, দেখা যাবে, জনসংখ্যার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে হাসপাতালের চাহিদা। গড়ে উঠছে বয়োজ্যেষ্ঠদের সেবাকেন্দ্রও। ফলে নার্স থাকা তো চাই-ই চাই!
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রটোকল অনুযায়ী, একটি দেশে চিকিৎসক ও নার্সের অনুপাত হওয়া প্রয়োজন ১:৩। আমরা সেই ভারসাম্য এখনও ঠিকঠাক তৈরি করতে পারিনি। কেননা, আমাদের দেশে এখনও এ অনুপাত ২:১। যেখানে একজন চিকিৎসকের বিপরীতে তিনজন নার্স থাকা প্রয়োজন, সেখানে আমাদের দু’জন চিকিৎসকের বিপরীতে পাওয়া যায় একজন নার্স! অথচ শুধু আহত, অসুস্থ এবং পরিবারের জ্যেষ্ঠ সদস্যরাই নন, নার্সিং সেবা প্রয়োজন অন্যদেরও।
প্রিয় নাইটিঙ্গেল
ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেলের কথা মনে আছে? জানেন নাকি নার্সিং ইতিহাসে বৈপ্লবিক উন্নয়ন ও পরিবর্তন সাধিত হয়েছিল ঐতিহাসিক ক্রিমিয়ার যুদ্ধে? এ সময়ে বিশ্বখ্যাত ইংরেজ নার্স ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল নার্সিংয়ের পেশাদারি পর্যায়টির সূচনা ঘটিয়ে দিয়ে স্মরণীয় ও বরণীয় হয়ে আছেন। তার প্রণীত ‘নোটস অন নার্সিং’ বইটিকে গণ্য করা হয় এ বিষয়ের আদি ও মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে। অন্যদিকে, বিশ্বের প্রথম দেশ হিসেবে নিউজিল্যান্ডে জাতীয় পর্যায়ে নার্সদের নিবন্ধন কার্যক্রম শুরু করেছিল। গত শতকের নব্বইয়ের দশকে ওষুধ দেওয়া, ডায়াগনস্টিক, প্যাথলজি পরীক্ষাসহ রোগীদের প্রয়োজনে অন্য পেশাদারি স্বাস্থ্যকর্মী বা চিকিৎসকের কাছে স্থানান্তরের অনুমতি দেওয়া হয় নার্সদের। তারপর তাদের দায় ও দায়িত্ব হয়ে ওঠে আরও গুরুতর।
পাঠসূত্র
পেশাদার নার্স হওয়ার জন্য বিএসসি ইন নার্সিং ডিগ্রি অর্জন করা প্রয়োজন। এ বিষয়ে পড়ার জন্য ভর্তি হতে হয় উচ্চ মাধ্যমিকের পরই। তবে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক বা সমমানের পরীক্ষায় নূ্যনতম জিপিএ ২.৫০ থাকা চাই। ভালো কথা হলো, বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীরা নার্সিংয়ে ভর্তির ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পেলেও মানবিক ও বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীদের জন্যও এ সনদ লাভের পথ খোলা। সরকারি কলেজগুলোয় ভর্তি সাধারণত জিপিএর ভিত্তিতেই হয়। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফল বের হওয়ার পরই শুরু হয় এ কার্যক্রম।
সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান
আমাদের দেশে এখন সরকারি পর্যায়ে সাতটি বেসিক বিএসসি নার্সিং কলেজে এ কোর্স চালু রয়েছে। কলেজগুলো হলো_ ঢাকা নার্সিং কলেজ, ময়মনসিংহ নার্সিং কলেজ, রাজশাহী নার্সিং কলেজ, চট্টগ্রাম নার্সিং কলেজ, রংপুর নার্সিং কলেজ, সিলেট নার্সিং কলেজ ও বরিশাল নার্সিং কলেজ। এ ছাড়া চাকরির বাজারে বাড়তি চাহিদার কথা মাথায় রেখে বেশ কয়েকটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ও কোর্স চালু করেছে নার্সিংয়ের ওপর।
আবেদন ও ভর্তি প্রক্রিয়া
এই কোর্সের জন্য সরকারি-বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বছরের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় ভর্তির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করে। এ ছাড়া প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব ওয়েবসাইটের মাধ্যমেও ভর্তি বিজ্ঞপ্তি দিয়ে থাকে। ধাপে ধাপে কয়েকটি পরীক্ষা যেমন: লিখিত, মৌখিক ও ডাক্তারি পরীক্ষার মাধ্যমে চূড়ান্তভাবে ভর্তির জন্য নির্বাচন করা হয়। লিখিত পরীক্ষায় সাধারণত প্রশ্ন করা হয় বাংলা, ইংরেজি, জীববিজ্ঞান, পদার্থবিজ্ঞান, সাধারণ জ্ঞান ইত্যাদি বিষয় থেকে। নার্সিং পেশাটিকে আমাদের দেশে ব্যাপক পরিসরে শুধু নারীদের পেশা হিসেবে গণ্য করা হলেও, এ পেশায় ১০ শতাংশ ছেলেদেরও রয়েছে ভর্তির সুযোগ।
কাজের ময়দান
নার্সিং বিষয়ে পড়া শেষ করে অনায়াসেই ক্যারিয়ার গড়া যায় দেশে কিংবা বিদেশে।দেশে সরকারি-বেসরকারি হাসপাতাল, সমাজসেবা অধিদপ্তর, হোটেল, মোটেল, এনজিও এমনকি পর্যটন করপোরেশনেও নাসিংয়ে ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ রয়েছে। বর্তমানে আমাদের দেশের প্রায় দুই হাজার নার্স সৌদি আরব, লিবিয়া, যুক্তরাজ্যসহ বিশ্বের ১৩টি দেশে কর্মরত রয়েছেন। নার্সিং পেশার সম্ভাবনার দিক বিবেচনা করে অনেক প্রতিষ্ঠানই নার্সিংয়ে পড়ালেখার সুযোগ করে দিচ্ছে। তবে বাংলাদেশ নার্সিং কাউন্সিল অর্ডিন্যান্স নং খঢও-১৯৮৩ অনুযায়ী কাউন্সিল এবং স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন ছাড়া কোনো প্রতিষ্ঠান নার্সিং বিষয়ে শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা, ভর্তি, সনদপত্র প্রদান ইত্যাদি কাজ করতে পারবে না। কাজেই কোনো প্রতিষ্ঠানে ভর্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে জেনে নিন সেই প্রতিষ্ঠানের অনুমোদন আছে কি-না।
উপার্জনের হিসেব
নার্সি অবশ্যই সেবামূলক পেশা, তবে তা বিনামূল্যে নয় নিশ্চয়ই। তবে এ এমন এক পেশা, যেখানে উপার্জনের পাশাপাশি সেবার মনমানসিকতা পালন করে বড় ভূমিকা। তাই এ বিষয়ে পড়ার মাধ্যমে যেমন মানবসেবার সুযোগ ব্যাপক, তেমনি সম্ভাবনা রয়েছে ভালো ক্যারিয়ারও। নার্সিং পেশায় বর্তমানে বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা আগের তুলনায় বেড়েছে কয়েকগুণ। এ দেশে প্রয়োজনের তুলনায় নার্সের ঘাটতি থাকায় এ পেশায় পড়াশোনা শেষ করার সঙ্গে সঙ্গেই চাকরি পাওয়ার নিশ্চয়তা প্রায় শতভাগ।
নার্সিং পেশায় বেতনের পাশাপাশি আছে ওভারটাইমের মাধ্যমে অতিরিক্ত আয়ের সুযোগ। নিবন্ধনকৃত ও অভিজ্ঞ নার্সদের জন্য আছে আকর্ষণীয় বেতন-ভাতা। কিছু কিছু প্রতিষ্ঠান নার্সদের পরিবারকেও বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা দেয়। এ ছাড়া নার্সদের প্রতিষ্ঠান কর্তৃক জীবন বীমার সুবিধাসহ অনেক ধরনের সুযোগ-সুবিধা থাকায় বর্তমানে নার্সরা আগের চেয়ে সচ্ছলতার সঙ্গে জীবনযাপন করছেন। এ বিষয়ে পড়ার পর দেশ-বিদেশের সব জায়গায়ই ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ আছে।
চাকরির ডাক
সরকারি নার্সিং কলেজগুলো থেকে বিএসসি ইন নার্সিং কোর্স করতে চাইলে খরচ পড়ে ১ থেকে ১ লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো। আর বেসরকারি কলেজগুলোতে খরচ হয় চার বছরে ২ থেকে ৩ লাখ টাকার মতো। তবে বেসরকারি পর্যায়ের কলেজগুলোতে খরচ প্রতিষ্ঠানভেদে কমবেশি হয়ে থাকে। আর সরকারি কলেজগুলোতে ডিপ্লোমা ইন নার্সিং করতে কোর্স ফি নেয় না। প্রতি মাসে উল্টো টাকা দেয় ভাতা হিসেবে। নিশ্চিত চাকরির কথা ভেবে এবং মানবসেবার মতো মহৎ পেশার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত করতে নার্সিং পেশাকে বুকে টানতে আজই নেমে পড়ূন এ ক্যারিয়ারের রাস্তায়!