গবেষক হতে যা জানা জরুরি
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
আমাদের দেশে প্রকৃতপক্ষে গবেষণার চর্চা তেমন নেই বললেই চলে। কিন্তু শিক্ষার্থীরা যদি গবেষণা না করে, তাহলে আমাদের শিক্ষা ব্যবস্থার সামগ্রিক মানোন্নয়ন কোনদিন ঘটবে না।
শিক্ষার্থীদের পক্ষে গবেষণা করা কষ্টসাধ্য। তার অন্যতম মূল কারণ, কীভাবে গবেষণা করতে হয়, সে ব্যাপারে তাদের ধারণা নেই। পারতপক্ষে গবেষণার শুরু কোথা থেকে করতে হবে, সেই বিষয়েই কেউ ভালোমতো জানে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র নিয়নেরও গবেষণার বিষয়ে যথেষ্ট ধারণা ছিল না। কিন্তু আমাদের চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন বিষয় সম্বন্ধে বিস্তারিতভাবে জানার জন্য তার মধ্যে একটা আকাঙ্ক্ষা ছিল।
আবার, ক্লাস-পরীক্ষার চাপের কারণে সে গবেষণা করার সময়ও বের করতে পারছিল না। একবার ফাইনাল পরীক্ষার সময় সে দেখল যে পরীক্ষার আগের দিন রাতের বেলাও সে ইন্টারনেটে বসে বসে ইউটিউব, ফেসবুক এগুলোতে অহেতুক সময় নষ্ট করছে। সে জানে তার পড়ালেখা করা দরকার, কিন্তু তবুও সে মোবাইল হাতে নিয়ে বসে আছে।
তার পরীক্ষা শেষ হবার পর সে বোঝার চেষ্টা করলো যে এই বিষয়টি কেন ঘটলো? সে ঠিক করলো, সে এই বিষয়টি নিয়ে গবেষণা করবে। এজন্য প্রথমেই সে গেল তার বিভাগের সিনিয়র নাহিয়ান ভাইয়ের কাছে।
নিয়ন: “ভাই, আমি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহার নিয়ে একটা গবেষণা করতে চাই। সেক্ষেত্রে কীভাবে আগাব?”
১। নির্দেশনা সম্বন্ধে নিশ্চিত হওয়া:
নাহিয়ান ভাই: “প্রথমেই তোকে যেটা ঠিক করতে হবে সেটা হচ্ছে তুই গবেষণাটা কীভাবে শুরু করবি। গবেষণা করার ক্ষেত্রে সবাই যে ভুলটা করে সেটা হল যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়াই কাজ শুরু করে দেয়া, ফলে পরবর্তীতে কাজটা আর ভালো হয় না।”
নিয়ন: “প্রস্তুতি বলতে এক্ষেত্রে আসলে কী বুঝায়?”
নাহিয়ান ভাই: “যদি কোন এসাইনমেন্টের জন্য পেপার লিখিস, তাহলে সাধারণত বিষয়, তথ্যসূত্র, কাঠামো, পৃষ্ঠার সীমা ইত্যাদি বিষয়ে নির্দেশনা থাকবে। এই বিষয়ে আগেই নিশ্চিত হয়ে নিতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষকের সাথে কথা বলে নিতে হবে বা মেইল করতে হবে।”
২। বিষয় বাছাইকরণ:
- নির্দেশনা অনুযায়ী বিষয় বেছে নেওয়া:
নিয়ন: “গবেষণার বিষয় বাছাইয়ের ক্ষেত্রে কি কোন বাধ্যবাধকতা আছে? আমি কি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেরকুফল নিয়ে গবেষণা করতে পারবো?”
নাহিয়ান ভাই: “ব্যক্তিগত পর্যায়ে যেকোন বিষয়েই তুই গবেষণা করতে পারিস। সেক্ষেত্রে তোকে প্রথমেই ঠিক করতে হবে যে তোর গবেষণার উদ্দেশ্য এবং প্রশ্ন কী? তোর ক্ষেত্রে যেমন প্রশ্নটা হতে পারে, ‘মানুষ কেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আসক্ত হয়ে পড়ে?’ গবেষণার মাধ্যমে তোকে এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজে বের করতে হবে।”
নিয়ন: “আমার মাথায় তো ভাই এই আইডিয়াটা আসছে দেখে এটা নিয়ে কাজ করছি। আপনি তো ক্লাস এসাইনমেন্ট আর তার বাইরেও বিভিন্ন কম্পিটিশনে পেপার দিয়েছেন। সেগুলোর বিষয় কীভাবে ঠিক করতেন? তখন তো নিজের ইচ্ছামত কাজ করা যায় না।”
নাহিয়ান ভাই: “হ্যাঁ, সাধারণত যেকোন কোর্স বা কম্পিটিশনের ক্ষেত্রে একটা নির্দিষ্ট ক্ষেত্র বলে দেয়া থাকে, সেটা মাথায় রেখেই তখন গবেষণার উদ্দেশ্য এবং প্রশ্ন ঠিক করতে হয়। যেমন ধর, দারিদ্র্য বিমোচন নিয়ে একটা পেপার লিখতে বললে তখন তুই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম নিয়ে লিখতে পারবি না। তখন, তোকে দারিদ্র্যর ওপরই লিখতে হবে।”
- পছন্দের বিষয়ের ওপর জোর দেওয়া:
নিয়ন: “দারিদ্র বিমোচন অনেক কঠিন এবং বড় একটা বিষয়। এরকম একটা বিষয়কে গবেষণার মাধ্যমে কীভাবে তুলে ধরবো?”
নাহিয়ান ভাই: “দারিদ্র্যের বিভিন্ন কারণ রয়েছে, সেই কারণগুলো দূরীভূত করার জন্য বিভিন্ন ধরণের মতবাদও রয়েছে। আবার বিশ্বের বিভিন্ন অংশে দারিদ্র্যের স্বরূপ একই রকম নয়। সেজন্য গবেষণা করার আগে চিন্তা করতে হবে যে তুই ঠিক দারিদ্র্য বিমোচনের কোন অংশ নিয়ে কাজ করবি। গবেষণা করার ক্ষেত্রে অবশ্যই তোর কাজে সৃজনশীলতা থাকতে হবে।
একটা নির্দিষ্ট বিষয়ে এর আগে যেই কাজগুলো হয়েছে, সেগুলোর ওপর ভিত্তি করে নতুন কোন সমাধান বা মতামত দাঁড় করাতে হবে। কাজটা অনেক কঠিন। এজন্য কোন বিষয় নিয়ে কাজ করার আগে সেই বিষয়টা তুই উপভোগ করিস কি না, এটা ভেবে নেয়া দরকার। কারণ, গবেষণা করা অনেক দীর্ঘ একটা প্রক্রিয়া। যদি তুই বিষয়টা পছন্দ না করিস, তাহলে দীর্ঘদিন বিষয়টা নিয়ে কাজ করতে পারবি না। এরপর সিলেবাস এবং ক্লাস নোটস দেখে বোঝার চেষ্টা কর যে কোন বিষয়টা তোকে আকৃষ্ট করে। অনেক সময় বন্ধুদের সাথে আলোচনা করলেও ভালো আইডিয়া মাথায় চলে আসে।”
- সম্ভাব্য বিষয়গুলো নিয়ে পড়া:
নিয়ন: “বেশ কিছু আইডিয়া মাথায় আসার পর তো সেগুলো নিয়ে একটু পড়া উচিত, তাই না?”
নাহিয়ান ভাই: “হ্যাঁ, যেই আইডিয়াগুলো তোর পছন্দ, সেগুলো নিয়ে ১-২ ঘণ্টা পড়লে তুই ভালোমতো বুঝতে পারবি যে আসলে কোন বিষয়ে তোর গবেষণা করা উচিত হবে। অনেক সময় দেখা যাবে তোর পছন্দের বিষয়ে কাজ করার যথেষ্ট সুযোগ নেই, অনেক সময় দেখবি যে বিষয়টার কলেবর এত বড় যে তুই গবেষণা করতে হিমশিম খাবি। এজন্য বিষয়গুলো নিয়ে কাজ শুরু করার আগেই একটু ঘাঁটাঘাঁটি করা উচিত।”
- শিক্ষকের সাথে আলোচনা করা:
নিয়ন: “একটা বিষয় বেছে নিলাম, কিন্তু দেখা গেল তা আমার শিক্ষকের পছন্দ হল না। তাহলে তো লাভ নাই। এজন্য আগে থেকেই শিক্ষকের মতামত নিয়ে রাখা উচিত না?”
নাহিয়ান ভাই: “তা তো অবশ্যই। শিক্ষকের সাথে কথা বলার আগে এটা খেয়াল রাখতে হবে যে তুই বিষয়টা সম্বন্ধে ভালোমতো বুঝিস। তাহলে, তুই শিক্ষককেও তোর আইডিয়াটা ভালোমতো বুঝিয়ে বলতে পারবি। তাছাড়া, শিক্ষকই তোকে বুঝিয়ে দিতে পারবেন যে পেপার আসলে কীভাবে সাজাতে হবে এবং কোথা থেকে তুই প্রয়োজনীয় তথ্য পেতে পারিস।”
৩। গভীরভাবে পড়া:
- বই পড়া:
নিয়ন: “একটা বিষয় বেছে নিলাম। কিন্তু আমি সেই বিষয়ে আরও ভালোমতো জানতে চাই, তখন কী করা উচিত?”
নাহিয়ান ভাই: “ভালোমতো কোন বিষয়ে পেপার লিখতে হলে সেই বিষয়ে অবশ্যই স্বচ্ছ ধারণা থাকতে হবে। সেজন্য বেশি বেশি পড়তে হবে। সাধারণত কোন এসাইনমেন্ট হিসেবে পেপার লিখতে দেওয়া হলে ক্লাসেই সেই বিষয়ে পড়ানো হয়। কিন্তু গবেষণা করার জন্য আরও অনেক গভীরভাবে জানতে হবে।”
নিয়ন: “সেক্ষেত্রে কোথা থেকে পড়া উচিত? সেই বিষয়ের ওপর লেখা যে বইগুলো লাইব্রেরিতে পাওয়া যায়, সেগুলো পড়লেই কি হবে?”
নাহিয়ান ভাই: “হ্যাঁ, সেগুলো তো পড়তেই হবে। এছাড়াও সিনেমা, পেইন্টিং, উপন্যাস, কবিতা, চিঠি, ঐতিহাসিক নথিপত্র ইত্যাদিও প্রাথমিক তথ্যসূত্র হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।”
- গবেষণা প্রবন্ধ পড়া:
নিয়ন: “ভাই, আমার আগেও অনেকেই হয়তো সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অতিরিক্ত ব্যবহারের ক্ষতি নিয়ে গবেষণা করে গেছে, সেগুলো কোথা থেকে পড়া যায়?”
নাহিয়ান ভাই: “গুগল স্কলারে (https://scholar.google.com/) বা JSTOR (https://www.jstor.org/) গিয়ে তোর দরকারি বিষয়ে যদি খুঁজে দেখিস, তাহলে অনেক জার্নাল-আর্টিকেল পাবি। অনেক সময় সম্পূর্ণটা নেটে ফ্রী দেয়া থাকে। যদি পুরো আর্টিকেল না থাকে, তাহলে সাধারণত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের এ সকল ডেটাবেজ ব্যবহারের অনুমতি থাকে, তাঁদের কাছ থেকে পেপার সংগ্রহ করে নিতে পারিস।”
- তথ্যসূত্রগুলো যাচাই করে নেয়া:
নিয়ন: “অনেক ভালো বইয়েও অনেক সময় ভুল তথ্য দেয়া থাকে। সেক্ষেত্রে তথ্যগুলো যাচাই কীভাবে করবো, ভাই?”
নাহিয়ান ভাই: “উইকিপিডিয়ার মত পপুলার ওয়েবসাইট গবেষণার ক্ষেত্রে গ্রহণযোগ্য নয়। তাই, এ ধরণের ওয়েবসাইট থেকে তথ্য না নেয়াই ভালো। যদি কোন কারণে এ ধরণের ওয়েবসাইটের তথ্য ব্যবহার করিস, তাহলে অবশ্যই সেটা অন্য কোন সূত্র থেকে নিশ্চিত হয়ে নিবি। তাছাড়া গবেষণার জগতে ‘peer reviewed’ সূত্রগুলোতে ভুল কম থাকে।”
নিয়ন: “Peer reviewed’ বলতে কী বোঝায়, ভাই?”
নাহিয়ান ভাই: “একজন গবেষকের কাজ যখন অন্য গবেষকরা মূল্যায়ন করেন, তখন সেই পদ্ধতিকে ‘peer review’ বলা হয়। যদি এই কাজটি না করা হয়, তাহলে কাজে ভুল থাকার সম্ভাবনা রয়ে যায়। তখন, সেই তথ্যসূত্রগুলির উপর নির্ভর করা কঠিন হয়ে যায়।”
নিয়ন: “আমি যতদূর জানি, বিভিন্ন ধরণের গবেষণার ওপর ভিত্তি করে অসংখ্য জার্নাল প্রতি বছর বের হয়। কোন জার্নালগুলি অধিক নির্ভরযোগ্য?”
নাহিয়ান ভাই: “এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলে নেয়া ভালো। কারণ, একই বিষয়ে অনেক জার্নাল থাকে এবং একজন ছাত্রের পক্ষে সবসময় বোঝা সম্ভব নয় যে সেই জার্নালটির মান কী রকম। বিশেষজ্ঞরাই বলে দিতে পারবেন যে কোনগুলো উৎকৃষ্ট মানের জার্নাল।”
নিয়ন: “আর কোন কিছু কি খেয়াল রাখতে হবে?”
নাহিয়ান ভাই: “কোন জার্নাল আর্টিকেল পড়ার সময় খেয়াল রাখবি যে তথ্যসূত্র বা রেফারেন্সে কয়টা নাম আছে। কারণ, একটা আর্টিকেলে যত বেশি তথ্যসূত্র থাকে, সেই আর্টিকেল লিখতে তত বেশি গবেষণা করা হয়েছে। ফলে, আর্টিকেলটির গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। তাছাড়া, কোন আর্টিকেল যদি তোর পছন্দ হয়, তাহলে সেই আর্টিকেলের রেফারেন্সগুলোও তোর পড়ে ফেলতে পারিস। কারণ, লেখক সেগুলোর উপর ভিত্তি করেই তার লেখা লিখেছেন।”
নিয়ন: “আচ্ছা, ভাই, অসংখ্য ধন্যবাদ। আমি পরে লেখার সময় কোন সমস্যায় পড়লে আপনাকে আবার বিরক্ত করবো।”
নাহিয়ান ভাই: “আরে, বিরক্ত কেন হব? আমি তোকে যথাসাধ্য সাহায্য করে যাব! তরুণ প্রজন্ম গবেষণায় মন দিলেই তো আমাদের দেশ এগিয়ে যাবে!”