কোন পথে যাবে তুমি?
- আদনান মান্নান
একটা সময় ছিল যখন এইচএসসি কিংবা এ-লেভেল পাস করার আগে থেকেই সবাই ধরেই নিত জীবনের লক্ষ্য হবে চিকিৎসক কিংবা প্রকৌশলী। সবাই প্রশ্ন করত—কোথায় পড়বে? মেডিকেলে নাকি ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে? শিক্ষার্থীরা যেকোনো একটিতে পড়ার ইচ্ছা প্রকাশ করত। কিন্তু সেই দিন এখন নেই। অনেকেই মুচকি হেসে উত্তর দেয় ‘না, কোনোটিতেই না।’
এ কথা সত্য, সামাজিক সম্মান আর আর্থিক স্বাচ্ছন্দ্য বিবেচনা করলে পুরো পৃথিবীতেই এই দুটি পেশা পছন্দের তালিকায় শীর্ষে অবস্থান করে। কিন্তু এটাও বাস্তব, পৃথিবীতে এখন অনেক কিছুর নতুন নতুন চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে। এগিয়ে গেছে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি। তৈরি হয়েছে যুগের প্রয়োজনে নতুন নতুন পেশা ও কর্মক্ষেত্র। এই সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় কর্মক্ষেত্রের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে বেশ কিছু নতুন এবং এ সময়ের চাহিদাসম্পন্ন পেশা। গবেষণাধর্মী বা প্রযুক্তিনির্ভর অন্যান্য বিষয়ে পড়েই বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরা এখন স্থান করে নিয়েছে অক্সফোর্ড, ক্যামব্রিজ, হার্ভার্ড আর এমাইটির মতো জায়গায়। কাজ করছে গুগল, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিস ইউএসএ, গোল্ডম্যান স্যাচ, রয়্যাল ব্যাংক অব স্কটল্যান্ডের মতো প্রতিষ্ঠানে।
এখন এসব কথার অবতারণা কেন? কারণ শুরু হয়ে গেছে ভর্তি পরীক্ষার মৌসুম। কেউ হয়ত বা সুযোগ পাবে পছন্দের প্রতিষ্ঠানে, কেউ পাবে না। যারা সুযোগ পাবে না তারা খুব মন খারাপ নিয়ে হয়ত দেখবে সবচেয়ে প্রিয় বন্ধু বা বান্ধবী সুযোগ পেয়েছে ইঞ্জিনিয়ারিং কিংবা মেডিকেলে। কেউ কটাক্ষ করতে পারে, প্রশ্ন তুলতে পারে মেধা নিয়ে, কেউ হয়ত বা রীতিমতো উপেক্ষা করবে। কিন্তু এখানেই কি জীবন ৩০ বছর আগের পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে? সেই উত্তর—না, এখন খোলা আছে অনেক পথ। সেই পথেই এগোবে তুমি।
বিশ্বাস করো, ঠিক পাঁচ বছর পর সবাই দেখবে তুমি কতটা যোগ্য হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলেছ, নিজের বিষয়ে তুমি কতটা দক্ষ, একটি প্রতিষ্ঠানে কাজ করার মতো কী কী গুণ তুমি অর্জন করেছ? তোমার পেশা আর প্রতিষ্ঠানের চেয়ে তোমার সৃজনশীল চিন্তা অনেক বেশি গুরুত্ব পাবে।
প্রশ্ন আসতে পারে, কী কী বিষয় নিয়ে পড়তে পারি? গত ১০ বছরে কোন বিষয়গুলো খুব উদীয়মান এবং সম্ভাবনাময় হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে? কেন তারা চিকিৎসক আর প্রকৌশলীদের মতোই সমানভাবে স্বীকৃত, সম্মানিত ও সচ্ছল? উত্তরটা হলো—পড়ার আছে অনেক কিছুই।
এই মুহূর্তে বিভিন্ন দেশে উন্নয়ন ও গবেষণা খাতে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করা ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো ভেটেরিনারি ও কৃষি। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে পশুর স্বাস্থ্য, দুগ্ধশিল্প, গবাদিপশুর মাংসের বিশাল বাজার। ফলে ভেটেরিনারি বা পশুর স্বাস্থ্য বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আবার দেশের খাদ্যসংকট মোকাবিলা, নতুন জাতের ফসল উদ্ভাবন, ফসলে রোগের সংক্রমণ প্রতিরোধ করা, এ রকম বিভিন্ন কারণে কৃষিক্ষেত্র প্রত্যেকটি দেশেই গুরুত্ব পাচ্ছে। বাংলাদেশে যেমন এই পেশাটি গুরুত্বপূর্ণ, তেমনি যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ডেনমার্কের মতো দেশগুলোতেও রয়েছে সম্ভাবনাময় চাকরি ও গবেষণা ক্ষেত্র। এ ক্ষেত্রে দেশে পড়ার সুযোগ রয়েছে বেশ কয়েকটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ও ভেটেরিনারি বিশ্ববিদ্যালয়ে।
বাংলাদেশে অফুরন্ত সম্ভাবনার আরেকটি ক্ষেত্র মৎস্যসম্পদ ও সামুদ্রিক বিজ্ঞান। মাছের জাত উন্নয়ন, বিষক্রিয়া প্রতিরোধ, সামুদ্রিক সম্পদ বিভিন্নভাবে কাজে লাগানো এ রকম অনেক কিছু নিয়েই আছে কর্মক্ষেত্র। মেরিন সায়েন্স ও ফিশারিজ তাই পড়াশোনার জন্য আরেকটি ভালো সুযোগ। ভেটেরিনারি, কৃষি ও ফিশারিজ—তিনটি বিষয়েই দেশের বাইরে স্নাতকোত্তর ও পিএইচডির জন্য রয়েছে অনেক শিক্ষাবৃত্তির সুযোগ।
এ সময়ের অন্যতম চাহিদা হলো বস্ত্রশিল্প। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কৌশল জানতে হলে পড়তে পারো টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ারিং। অন্যদিকে চামড়াশিল্প বিভিন্ন কারণে পৃথিবীতে সব সময়ই সমাদৃত। এর সঙ্গে সম্পর্কিত বিষয়ে পড়ার জন্য আছে লেদার টেকনোলজি।
একেবারেই নতুন ধারার প্রযুক্তি নিয়ে পড়তে চাইলে বেছে নিতে পারো অ্যারোস্পেস ইঞ্জিনিয়ারিং। চ্যালেঞ্জিং, বেতনের ক্ষেত্রেও রয়েছে সচ্ছলতা। ছোটবেলা থেকে যারা আকাশে ওড়ার স্বপ্ন নিয়ে বড় হয়েছে তাদের জন্য আরেকটি সম্ভাবনাময় বিষয় হলো অ্যারোনটিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং। রয়েছে ভ্রমণের সুযোগ, আবার অন্যদিকে বেশ সম্মানজনক বেতন।
প্রত্যেকটি দেশ এখন অর্থনৈতিক অগ্রগতির জন্য গুরুত্ব দিচ্ছে উন্নয়ন নিয়ে গবেষণাকে। ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ বিষয়ে এখন দেশে অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই পড়া যায়। এই বিষয় সংশ্লিষ্ট ভালো চাকরি ও গবেষণাক্ষেত্র তৈরি হয়েছে পাশ্চাত্যের দেশগুলোতেও। এর সঙ্গে সংশ্লিষ্ট একটি মৌলিক বিষয় হলো অর্থনীতি। পৃথিবীতে চিরকালই গবেষণা, পড়াশোনা আর নীতিনির্ধারক পর্যায়ে অর্থনীতি একটি দরকারি বিষয়। পড়াশোনা করার জন্য আরেকটি আকর্ষণীয় বিষয় হলো গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা। দেশে ইলেকট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ার সংখ্যা বেড়েছে, মানুষের কাছে তাৎক্ষণিক ও বিষয়ধর্মী সংবাদের গুরুত্ব বেড়েছে। তৈরি হচ্ছে নতুন নতুন কাজ করার ক্ষেত্র।
দেশের অস্থিতিশীলতা দূরীকরণে এবং সমাজে ন্যায় প্রতিষ্ঠায় কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে আইনজীবীরা। আইন বিষয়ে পড়ার সুযোগ আছে অনেক প্রতিষ্ঠানেই। একদিকে যেমন আদালতে রয়েছে প্র্যাকটিস করার সুযোগ, অন্যদিকে রয়েছে শিক্ষকতার সম্ভাবনা, আরও রয়েছে লিগ্যাল অ্যাডভাইজার হিসেবে বিভিন্ন করপোরেট প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ।
যারা একটু ভিন্নধারার পড়াশোনা করতে চাও, আগ্রহ রয়েছে সৃষ্টিশীল কাজে কিংবা আঁকাআঁকি বা ডিজাইনিংয়ে। তারা ভেবে দেখতে পারো ফ্যাশন ডিজাইনিং বা অন্দরসজ্জা নিয়ে পড়ার কথা। দিন দিন বাড়ছে কাপড়ে বৈচিত্র্য ও নতুন ধারার সংযোজনের চাহিদা। একইভাবে প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠান বা নতুন বাড়িকে মানুষ সাজাতে চাইছে একটু নতুনত্ব দিয়ে।
ব্যবসা সংশ্লিষ্ট বিষয়ে পড়ার জন্য রয়েছে হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ইনফরমেশন সিস্টেমস ম্যানেজমেন্ট। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো দেশগুলোতে এসব বিষয়ের চাহিদা ধীরে ধীরে বাড়ছে।
যারা জীববিজ্ঞানে আগ্রহী তাদের জন্য রয়েছে একই সঙ্গে গবেষণা ও ইন্ডাস্ট্রিয়াল কাজের সুযোগ। গত কয়েক বছরে ছাত্রদের পছন্দের তালিকায় ওপরের দিকে আছে ফার্মাসি। ওষুধশিল্পে দেশের ভালো অবস্থান, ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠানে কাজের সুযোগ, শিক্ষকতার সুযোগ এবং বাইরে পড়তে যাওয়ার সম্ভাবনা এই বিষয়ের জনপ্রিয়তার অন্যতম কারণ। বর্তমান বিশ্বে সবচেয়ে বেশি বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনেছে এমন পাঁচটি বিষয়ের নাম বলতে বললে তার মধ্যে একটি হবে বায়োটেকনোলজি। ডিএনএ, জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং, ক্লোনিং, ড্রাগ ডিজাইনিংয়ের মতো আকর্ষণীয় বিষয়গুলো নিয়ে পড়তে চাইলে বায়োটেকনোলজি হতে পারে তোমার জন্য সবচেয়ে উপযোগী বিষয়। কাজের সুযোগ আছে আইসিডিডিআরবি, ডিএনএ ফরেনসিক ল্যাব, টিকা আর ইনসুলিন নিয়ে কাজ করা ফার্মাসিউটিক্যাল প্রতিষ্ঠান এবং ক্যানসার সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানসমূহে। একই রকমের পড়াশোনা আর সম্ভাবনা রয়েছে আরও দুটি বিষয়ে—মাইক্রোবায়োলজি ও প্রাণরসায়ন তথা বায়োকেমিস্ট্রি নিয়ে। এই তিনটি বিষয়ের মতো এত প্রচুরসংখ্যক আন্তর্জাতিক বৃত্তি খুব কম বিষয়েই দেওয়া হয়।
পৃথিবীতে দিন দিন খাদ্য নিয়ে সচেতনতা বেড়েই চলেছে, একই সঙ্গে বাড়ছে বিভিন্ন রোগে আক্রান্ত মানুষের সুষম খাদ্য নিয়ে পরামর্শকের প্রয়োজনীয়তা। ফুড সায়েন্স বা ডায়েটিক্স এখন খুবই সময়োপযোগী একটি বিষয়। চাকরি ক্ষেত্র রয়েছে বিভিন্ন হাসপাতাল, ইন্ডাস্ট্রি ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানে। অন্যদিকে স্বাস্থ্য সমস্যার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে নানাবিধ হাড় কিংবা মজ্জাজনিত ব্যথা আর বার্ধক্যজনিত চলাফেরার সমস্যা। এসব সমাধানে বাড়ছে ফিজিওথেরাপিস্টের গুরুত্ব। পড়ার জন্য ফিজিওথেরাপি হতে পারে অন্যতম বিষয়।
যদি ভালোবাস উদ্ভিদ কিংবা পরিবেশ নিয়ে থাকে আগ্রহ, তাহলে বেছে নিতে পারো ফরেস্ট্রি অথবা এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্স। পরিবেশ নিয়ে কাজ করে এমন অনেকগুলো দেশি ও বিদেশি সংস্থাতে রয়েছে কাজ করার সুযোগ, আছে পরিবেশ সংরক্ষণ নিয়ে উচ্চতর গবেষণার সুযোগ এবং বিদেশি বিভিন্ন প্রকল্পে নিজেকে যুক্ত করার সম্ভাবনা।
জনস্বাস্থ্য দিন দিন হচ্ছে হুমকির সম্মুখীন। স্বাস্থ্য সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা, সমাধানের উপায় খোঁজা এবং জনস্বাস্থ্য বিষয়ে সরকারের নীতি নির্ধারণে সহায়তা করার কাজটিই করে জনস্বাস্থ্যবিষয়ক পড়াশোনা। ‘পাবলিক হেলথ’ (জনস্বাস্থ্য) সে কারণে দিন দিন পরিণত হচ্ছে খুবই প্রয়োজনীয় ও আকর্ষণীয় একটি বিষয়ে।
দেশের বাইরে যারা পড়তে যেতে চাও তাদের মাথায় রাখতে হবে স্নাতক পর্যায়ে বিদেশে পড়াশোনা অনেক ব্যয়বহুল। কিছু কিছু বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষাবৃত্তি দিয়ে থাকে যেখানে সেট, টোফেল, আইইএলটিএস ও আগের পরীক্ষার ফলাফলকে গুরুত্ব দেওয়া হয়। বাইরে যাওয়ার ক্ষেত্রে ভাবতে পারো যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, মালয়েশিয়া ও সিঙ্গাপুরের মতো দেশগুলোর কথা। তবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে অনেক বেশি বৃত্তির ব্যবস্থা থাকে। দেশের বাইরে পড়তে পার ন্যানো টেকনোলোজি, প্রজেক্ট ম্যানেজমেন্ট, রোবোটিকস, বায়োমেডিসিনের মতো বিষয়গুলো।
মনে রাখতে হবে যেই বিষয়েই পড়ো না কেন, নিজের মেধা ও যোগ্যতা দিয়ে নিজেকে প্রমাণ করতে হবে। চিকিৎসা বা প্রকৌশল বিদ্যায় না পড়েও আজকে সফল মানুষের কাতারে আছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস, হুমায়ূন আহমেদ, আবেদ চৌধুরী, ড. মুহাম্মদ জাফর ইকবাল। বিভিন্ন সাম্প্রতিক বিষয়ে পড়ে পৃথিবীর সেরা প্রতিষ্ঠানগুলোতে জায়গা করে নিয়েছে আমাদের শিক্ষার্থীরা। বায়োটেকনোলজি বিষয়ে পড়ে পরবর্তী সময় হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী। আবার বাণিজ্য কিংবা তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে এমআইটিতে পড়াশোনা করে মাইক্রোসফটে কাজ করছে অনেকে।
মোদ্দাকথা, আশা হারানোর কিছু নেই। নিজের ভালো লাগার বিষয়টি খুঁজে বের করো। যে বিষয়েই পড়ো না কেন তা নিয়ে গবেষণা করো, সাম্প্রতিক খবরগুলো নজরে রাখো। মনে রাখতে হবে তোমার সৃজনশীলতা দিয়ে তুমি অনেক দূর যেতে পারবে। লেগে থাকো, নিজের লক্ষ্যে অটুট থাকো।
লেখক: সহকারী অধ্যাপক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়