গুগলের শিক্ষানবিশ হতে চাইলে
- বৃষ্টি শিকদার
যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে পড়েছেন বাংলাদেশের মেয়ে বৃষ্টি শিকদার। বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষ থেকেই গুগল, গুগল ডিপমাইন্ড, কোরার মতো স্বনামধন্য বেশ কিছু প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপ করেছেন তিনি। লিখেছেন তাঁর অভিজ্ঞতার কথা।
আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা সাধারণত পড়ালেখা শেষ করে তারপর ইন্টার্নশিপ (শিক্ষানবিশি) করে। বাইরের দেশে কিন্তু স্নাতক চলাকালেই ইন্টার্নশিপ করার প্রচলন আছে। অনেকে মনে করেন, ‘আমি তো কিছুই জানি না। কীভাবে ইন্টার্নশিপ করব?’ কিন্তু ইন্টার্নশিপের মূল লক্ষ্যই থাকে, যারা জানে না তাদের শিখতে সাহায্য করা। তাই ভয় না পেয়ে, নিজের দক্ষতা বাড়ানোর জন্য অবশ্যই আগেভাগেই ইন্টার্নশিপ শুরু করে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শেষ বর্ষের অপেক্ষায় থাকলে চলবে না।
আমি যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে (এমআইটি) পড়েছি। প্রথম বর্ষ থেকেই বিশ্বের বেশ কিছু নামী প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের সুযোগ হয়েছে। বাংলাদেশে বসেও কিন্তু চাইলে বিশ্বের বড় বড় প্রতিষ্ঠানে ইন্টার্নশিপের জন্য আবেদন করা যায়।
গুগলে ঘুরে
আমার খুব সৌভাগ্য, ইন্টার্নশিপের শুরুই হয়েছে গুগলে। গুগল ট্রান্সলেট দলে ছিলাম আমি। ছবি থেকে কোনো তথ্য কীভাবে টেক্সট (লিখিত) ফরম্যাটে আনা যায়, সেটা নিয়ে কাজ করছিলাম আমরা। এমন নয় যে আমার ভূমিকা খুব বড় কিছু ছিল। তবে কীভাবে গুগলে কাজ করতে হয়, গুগল কোড বেসে কীভাবে কোড রান করাতে হয়, সেগুলো শিখেছি। এখানে প্রায় এক লাখ প্রকৌশলী কাজ করেন। প্রত্যেকেই ছোট-বড় নানা রকম প্রকল্প নিয়ে কাজ করে যাচ্ছেন। তাই এখানকার কর্মীরা বছরের বিভিন্ন সময়ে তাঁদের সুবিধামতো ইন্টার্ন (শিক্ষানবিশ) হিসেবে শিক্ষার্থীদের নিয়ে তাঁদের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ করে দেন।
গুগলে বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ ইন্টার্নশিপ প্রোগ্রাম আছে। একে বলা হয়, ‘ইঞ্জিনিয়ারিং প্র্যাকটিকাম ইন্টার্নশিপ।’ আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়জীবনের শুরুতেই এই ইন্টার্নশিপে যুক্ত হই। আমাদের সঙ্গে গুগলের একজন প্রকৌশলীকে পরিচয় করিয়ে দেওয়া হয়। ইন্টার্নশিপ চলাকালে যেকোনো সমস্যায় সাহায্য করেছেন তিনি। এ ধরনের ইন্টার্নশিপে আবেদনের জন্য কিন্তু অনেক কিছু জানার প্রয়োজন হয় না। কোডিংয়ে সামান্য দক্ষতা থাকলেই আবেদন করা যায়। বিশ্বের যেকোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীরাই শুধু এই প্রকল্পে আবেদন করতে পারেন। প্রতিবছর গ্রীষ্মে ও শীতে দুবার এভাবে ইন্টার্ন নেওয়া হয় গুগলে। আবেদন–প্রক্রিয়া শুরু হয়ে যায় আগের বছর থেকেই। এ ক্ষেত্রে careers.google.com/students/লিংকে গিয়ে নির্ধারিত ফরমে আবেদন করতে হয়।
ইন্টার্নশিপের সময়কাল ১০ থেকে ১৪ সপ্তাহ। তাই আমরা চাইলেই কিন্তু আমাদের দেশের ছুটির সঙ্গে মিলিয়ে এই ইন্টার্নশিপে অংশ নিতে পারি। পাশের দেশ ভারত থেকে প্রতিবছর বহু শিক্ষার্থী এই ইন্টার্নশিপের জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যায়। আমরা পিছিয়ে থাকব কেন?
ছোট প্রতিষ্ঠানে বড় কাজ—কোরা
কোরাতে আমি ইন্টার্নশিপ শুরু করি বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় বর্ষে উঠে। কীভাবে কোরা ব্যবহারে মানুষকে উৎসাহী করা যায়—এ নিয়ে ছিল আমার কাজ। এখানে অনেক ছোট দল কাজ করে। তাই কাজের দায়িত্ব বেশি, সঙ্গে শেখার সুযোগও। একটা সোশ্যাল নেটওয়ার্কিং সাইটের পেছনের নানা কৌশল আমি সেখানে শিখেছি।
কোরাতে ইন্টার্নশিপের আবেদনের দুই রকম প্রক্রিয়া আছে। আপনার পরিচিত কেউ কোরাতে থাকলে তাঁকে সিভি জমা দিয়ে ইন্টার্নশিপের জন্য বলতে পারেন। আবার লিংকডইন ব্যবহার করে চাইলে কোরাতে যাঁরা নিয়োগ করেন তাঁদের সরাসরি সিভি দিয়ে আপনার বিষয়ে জানাতে পারেন। এ ছাড়া কোরার অফিশিয়াল ওয়েবসাইটে ‘হায়ার অ্যাট’ সেকশনে সিভি জমা দিয়েও আবেদন করা যায়। অনেকে ভাবেন, হয়তো এভাবে সিভি দিলে কেউ পড়ে না; ভুল। ওরা কিন্তু প্রতিটি সিভি খুলে দেখে। এমন অনেককে আমি দেখেছি, যাঁরা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শুধু সিভি জমা দিয়েই কোরাতে কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন।
পর্দার পেছনের বড় কাজ—ব্রিজওয়াটার
ব্রিজওয়াটার হলো বিশ্বের সবচেয়ে বড় ‘হেজফান্ড’। হেজফান্ডগুলো মূলত সারা বিশ্বের মানুষের সম্পদ বণ্টন নিয়ন্ত্রণ করে। কোন স্টক মার্কেটে কী পরিমাণ খরচ হবে, কোন পণ্যের বাজারদর কীভাবে বাড়বে-কমবে, সবকিছু সামলায় এ ধরনের হেজফান্ডগুলো। আমি এখানে শিখেছি সারা বিশ্বের অর্থনীতি কীভাবে কাজ করে; স্টক, বন্ড, ইক্যুইটি, শেয়ার—কোনটার কী ভূমিকা।
আমার বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতিতে পড়ত, এমন কিছু বন্ধু সে বছর এই ব্রিজফার্মে ইন্টার্নশিপের আবেদন করেছিল। তাদের দেখাদেখি আমিও যাই। এখানে গিয়ে আমার চিন্তার জগৎ সম্পূর্ণভাবে বদলে যায়। আগে কখনো ভাবতেও পারিনি, আমাদের দেখার বাইরেও বিশাল বিশাল কাজ করছে এ ধরনের প্রতিষ্ঠানগুলো। প্রকৌশলের বাইরেও ইতিহাস, দর্শন কিংবা সামাজিক বিজ্ঞান নিয়ে পড়াশোনা করা ছাত্রছাত্রীরা এখানে কাজ করতে আসছেন। আপনি যুক্তি দিয়ে বিচার করে অর্থনীতির বাজারটা বুঝতে পারেন কি না, তাদের কাছে সেটাই গুরুত্বপূর্ণ। যেকোনো বিষয়ে পড়াশোনা করা মানুষের পক্ষেই এটা সম্ভব।
তাদের ওয়েবসাইটে গিয়ে সিভি জমা দিয়ে আবেদন করলে ওরাই যোগাযোগ করবে। গণিত বা কম্পিউটার সায়েন্সের অভিজ্ঞতা থাকলে অগ্রাধিকার পাওয়া যায়। আমাদের দেশের শেয়ারবাজার যেহেতু বেশি সমৃদ্ধ নয়, তাই আমরা হয়তো অনেকে এ বিষয়ে কখনো ভাবি না। কিন্তু এটা নিয়ে আসলে আমাদের চিন্তা করা উচিত। কেননা, সারা বিশ্বের অর্থনীতি নিয়ে ভাবার সুযোগ পাওয়া সৌভাগ্যের ব্যাপার।
সারা বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে শিক্ষার্থীরা এই ইন্টার্নশিপের আবেদন করে। সাধারণভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাওয়া কঠিন হলেও, ইন্টার্নশিপের জন্য কিন্তু ভিসা পাওয়া তুলনামূলক সহজ।
অসীম মাত্রার কাজ—ইয়োগাবাইট
বিশ্ববিদ্যালয়ের চতুর্থ বর্ষে উঠে আমি ইন্টার্নশিপ শুরু করি ইয়োগাবাইটে। এটা মূলত একটি তথ্যভান্ডার (ডেটাবেইস) বিশ্লেষণ ও রক্ষণাবেক্ষণ প্রতিষ্ঠান। বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে থাকা ডেটাবেইসগুলো থেকে প্রয়োজনমতো তথ্য সরবরাহ করা এবং সেগুলোর নিরাপত্তা নিয়ে কাজ করে ইয়োগাবাইট। ফেসবুকের শুরুর দিকের কয়েকজন কর্মীর হাত ধরে শুরু হয়েছিল প্রতিষ্ঠানটির। তাঁদের কাজের পরিসর ছোট হলেও, সীমানা কিন্তু অসীম। প্রতিষ্ঠান ছোট হওয়ার ফলে আমরা সবাই সবাইকে চিনতাম। এই সুযোগে বিশ্বের সব খ্যাতিমান ডেভেলপারদের খুব কাছ থেকে দেখেছি আমি।
জটিল কাজের সহজ উপায়—গুগল ডিপমাইন্ড
গুগল ডিপমাইন্ড মূলত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে কাজ করে। এখানে ইন্টার্নশিপের সময় আমি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তানির্ভর ‘ভিজ্যুয়াল সিস্টেম’ আর ‘রোবট ন্যাভিগেশন’ নিয়ে কাজ করেছি। এই প্রতিষ্ঠানে সাধারণভাবেই আবেদন করা যায়। মূলত আমার আগের কাজগুলোর প্রতি নজর রেখে ডিপমাইন্ড তাদের সঙ্গে আমাকে নিয়েছিল। এখানে কাজ করতে গিয়ে আমি আমার সেরা অভিজ্ঞতা পেয়েছি। কারণ এখানে সবাই কিছু না–কিছু শেখার জন্য কাজ করছে। ওরা যে শুধু গবেষণার কাজ করে, তা নয়। ভাবতেই ভালো লাগে, একটা বিশাল মেধাবী মানুষের দল কাজ করছে সুন্দর পৃথিবীর আশায়।
কীভাবে পাব খোঁজ
আমি যে প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা বলছি, এর বাইরেও কিন্তু বিশ্বের নামীদামি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান ইন্টার্ন হিসেবে ছাত্রছাত্রীদের নিয়ে থাকে। কিছু ইন্টার্নশিপ অবৈতনিক হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে পারিশ্রমিক এত ভালো যে এই কদিনের আয় দিয়ে ভিনদেশে যাওয়া-আসা, থাকা-খাওয়ার খরচটা সহজেই উঠে আসে।
ইন্টার্নশিপের সুযোগের খবর জানতে হলে আপনার পছন্দের সঙ্গে মিলিয়ে বিভিন্ন ব্লগ, ফোরাম বা গ্রুপে যুক্ত থাকতে হবে। এ-সংক্রান্ত ওয়েবসাইট বা ম্যাগাজিনে চোখ রাখতে হবে। পছন্দের প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইটে গিয়েও আপনি সুযোগের খোঁজ করতে পারেন।
শুধু বিদেশে নয়, আমাদের দেশের অনেক প্রতিষ্ঠানেও কিন্তু শিক্ষার্থীদের কাজ শেখার সুযোগ করে দেওয়ার চর্চা গড়ে উঠছে। তাই সব সময় খোঁজখবর রাখতে হবে।
মজার কিছু অভিজ্ঞতা
তখন আমি গুগল ডিপমাইন্ডের লন্ডন অফিসে কাজ করছি। সহকর্মীর সঙ্গে গল্প করছিলাম। হঠাৎ সামনে দিয়ে একটা লোক হেঁটে গেল। দেখেই মনে হলো, লোকটাকে কোথায় যেন দেখেছি! একটু পর বুঝলাম, তিনি ডিপমাইন্ডের সিইও ডেমিস হাসাবিস। আমি ভাবলাম, ‘এই লোকটা এখানকার সিইও। সে হেঁটে গেল। আমরা কেউ খেয়ালই করলাম না!’ এরপর একদিন দেখি গেমজোনে সে আরেক ইন্টার্নের সঙ্গে ফুসবল খেলছে! আমাদের এখানে যেমন অফিসে ‘বস বস’ বলে তটস্থ হওয়ার রেওয়াজ আছে, বাইরে পুরো বিষয়টাই অন্য রকম।
আমার এক বন্ধু ছিল তুর্কি। তার কাছ থেকে আমি তুর্কি বিভিন্ন খাবার খাওয়া শিখেছি। তুর্কি মিষ্টি আমার খুব প্রিয়। একদিন ক্যানটিনে দেখলাম একটা লোক বসে আছেন। দেখতে তুর্কিদের মতো। আমি সাধারণভাবেই গিয়ে তাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম যে আশপাশে কোথায় তুর্কি খাবার ভালো পাওয়া যাবে। তিনি আমাকে নির্দ্বিধায় সব তথ্য জানালেন। পরে জেনেছি, তিনি ছিলেন ডিপমাইন্ডের ডিরেক্টর অব রিসার্চ। এই যে সহকর্মীদের সঙ্গে বন্ধুসুলভ আচরণ, এটা খুব উপভোগ করেছি।
সুযোগ আছে কার?
গুগলে শুধু সফটওয়্যার ডেভেলপার লাগে তা কিন্তু নয়। বরং এখানে মার্কেটিং, ফিন্যান্স, অ্যাডমিনিস্ট্রেশন, আইন, অপারেশনসহ নানা রকম বিভাগ আছে। যেখানে প্রচুর ইন্টার্ন নেওয়া হয়। এমনকি গুগল ডুডলের জন্য প্রতিবছর নতুন নতুন শিল্পী নেওয়া হয়। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েদের জন্য কিন্তু এটা অনেক বড় সুযোগ। এখানে নানা রকম যোগ্যতা চাওয়া হলেও সেগুলো কিন্তু সাধারণ নির্দেশনা। অনেকেরই ওই যোগ্যতা না থাকার পরও তাঁর কাজের আগ্রহ দেখে গুগল তাঁকে নিয়ে নেয়। শুধু গুগল নয়; আমাজন, ফেসবুক, ইউটিউবের মতো নামী প্রতিষ্ঠানগুলোতেও নানা খাতে কাজ করার সুযোগ আছে।