বিশ্বাস ব্যতীত টেকসই নেতৃত্ব স্থাপন সম্ভব নয়
- কে এম হাসান রিপন
স্বপ্ন মানুষকে বাচতে শেখায়, স্বপ্ন মানুষকে সামনে বাড়তে প্রেরণা যোগায়। আমরা স্বপ্ন দেখি, আমরা স্বপ্নকে নিজের মতো করে মাঝে মাঝে সাজাতেও পারি। এমন অনেক সময়ই হয়েছে একটি স্বপ্ন দেখার পর মনে হলো আরেকটু উত্তেজনাপূর্ণ হলে ভালোই হতো এবং সাথে সাথে ঘুমিয়ে ওটাকে নিজের মতো করে বানিয়ে ফেলতাম। একবার মনে আছে আমি স্বপ্নের ভেতর চাকরির ইন্টারভিউ দিচ্ছিলাম। স্বপ্নের ভেতরই দেখলাম যিনি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন তিনি আমাকে বললেন আমি চাকরিটার জন্য যোগ্য নই এবং সাথে সাথে ঘুম ভেঙ্গে গেলো। আমি আবার ঘুমিয়ে পড়লাম এবং ইন্টারভিউয়ের রেজাল্ট আমার পক্ষে নিয়ে আসলাম। মজার ব্যাপার হলো এবার আর ঘুম ভাঙ্গেনি। কারণ এটি আমার নিজের তৈরি করা স্বপ্ন।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হলো ঠিক তার একবছর পর এরকমই একটি ইন্টারভিউর সম্মুখীন হলাম এবং যথারীতি যিনি আমার ইন্টারভিউ নিচ্ছিলেন তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারলাম তিনি আমাকে না বলবেন। সাথে সাথে আমার সেই স্বপ্নের কথা মনে পড়ে গেলো এবং আমি স্বপ্নে যা বলেছিলাম তাই বললাম “স্যার আমার মনে হচ্ছে আপনি আমাকে না বলবেন, না বলবার আগে আমার একটি ছোট্ট প্রস্তাব আছে। আমাকে আপনি একমাস কাজ করার সুযোগ দেবেন এবং তার বিনিময়ে আমাকে কোনো পারিশ্রমিক দিতে হবে না। যদি এই একমাসে আমি আমার কর্মদক্ষতা প্রমাণ করতে পারি তাহলে আপনার উপর সিদ্ধান্তের ভার দিয়ে চলে যাবো। তিনি রাজি হলেন এবং একমাস পর আমি নিয়োগপত্র হাতে পাই। স্বপ্নকে নিজের মতো করে বানানো এবং যথাসময়ে তার প্রয়োগ সম্ভব হয়েছিল শুধুমাত্র নিজের প্রতি নিজের বিশ্বাসের কারনে। আমার ক্যারিয়ারের বয়স যখন মাত্র একবছর তখন আমার বস একদিন আমাকে একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ প্রজেক্টের দায়িত্ব দিলেন। আমার বসের অনেক গুনাগুন ছিল। তবে সবচেয়ে বড় যে গুনটি ছিল সেটা হলো তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন। আর যেহেতু তিনি বিশ্বস্ত ছিলেন তাই প্রত্যেকেই তার সিদ্ধান্তকে নিজের বলে মেনে নিতেন।
আজকে লিখতে বসেছি নেতৃত্ব নিয়ে, নেতৃত্বের গুনাবলী সম্মন্ধে। কিন্তু আমার কাছে মনে হয় প্রত্যেক টেকসই নেতৃত্বের পেছনে রয়েছে একটিই শব্দ “বিশ্বাস” বা ‘‘বিশ্বস্ততা”। নেতৃত্বের স্থানে থেকে আমরা সবাই সবচেয়ে বড় যে ভুলটি করি এই ভেবে যে আমার পদবী বা পদমর্যাদার কারণে আমাকে সবাই বিশ্বাস করবে। বিশ্বাস বা বিশ্বস্ততা কখনই পদবী বা পদমর্যাদার সাথে আসে না। বিশ্বাস অর্জন করার ব্যাপার। ধরুন আপনি অনেক পরিশ্রমী, নিষ্ঠাবান, কৌশলী, চমৎকার যোগাযোগ দক্ষতা, উদ্ভাবনী অন্তর্দৃষ্টি, আপনার আছে দক্ষ দল কিন্তু মানুষের বিশ্বাস আপনি অর্জন করতে পারেননি। আপনি কখনোই আপনার আশানুরূপ ফল অর্জন করতে সক্ষম হবেন না। নেতৃত্বের স্থানে থেকে বিশ্বস্ততা তখনই অর্জন করা সম্ভব যখন আপনি আপনার সক্ষমতায় মানুষের আস্থা কায়েম করতে পারবেন। ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে “Practice Makes Perfect” বা “অণুশীলনেই সক্ষমতা”। বিশ্বস্ততা বা বিশ্বাস স্থাপনের ক্ষেত্রে প্রয়োজন অনুশীলন। খুব সহজেই আমরা নিজ অবস্থান থেকে ছোট ছোট কিছু কাজের মাধ্যমে “বিশ্বস্ত নেতৃত্ব” বা “Trustworthy Leadership” অর্জন করতে পারি। নিচে কিছু বিষয় অনুশীলনের জন্য উল্লেখ করা হলো:
১. মানুষ স্পষ্টতাকে বিশ্বাস করে। অবিশ্বাস বা দ্বিধান্বিতকে অবিশ্বাস করে। আপনার লক্ষ্য, উদ্দেশ্য, প্রত্যাশা এবং দৈনন্দিন কার্যক্রম সম্পর্কে পরিষ্কার হতে হবে। তাহলেই আপনার সাথে যারা কাজ করছেন তাদের আস্থা অর্জনে সম্ভব হবে।
২. নেতৃত্বের স্থানে থেকে কথা এবং কাজে মিল থাকাটা অত্যন্ত জরুরী। অন্যথায় একবার যদি আপনার উপর আস্থা রাখাটা কষ্টকর হয় তাহলে সেটা পুনরায় অর্জন করা কঠিন।
৩. আমরা অনেকসময় সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগি। সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে আমরা হিমশিম খাই। এসময় অনেক মানুষ আশপাশ থেকে এসে বিভ্রান্ত করার চেষ্ট করে এবং আমরা সহজেই বিভ্রান্ত হয়ে যাই। যার পরিনাম ভুল সিদ্ধান্ত আর পরিণতি মানুষের অনাস্থা।
৪. নেতৃত্বের স্থানে থেকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ থাকা অত্যন্ত জরুরী। কথা এবং কাজে যদি মিল না থাকে তাহলেই অবিশ্বাস জন্ম নেয়। কিন্তু একটা বিষয় আমাদের সবসময় খেয়াল রাখতে হবে যে মানুষ সবসময় কোনটি আপনার অন্তরের আর কোনটি আপনার শুধুমাত্র মুখের লোক দেখানো তা খুব সহজেই বুঝতে পারে।
৫. আপনার সহকর্মীরা যখন বিশ্বাস করবে যে আপনি তাদের যেকোন সমস্যায় সামনে এগিয়ে আসবেন তখনই তারা আপনার স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করতে নিজের সবটুকু দিয়ে এক হয়ে কাজ করবে।
৬. Leaders become great not for their Power but because of their ability to empower others. আমাদের সামনে নেতৃত্বের অনেক উদাহরণ আছে যেখানে আমরা দেখতে পাই সফল নেতৃত্বদানকারী ইচ্ছাকৃতভাবেই ক্ষমতা ছেড়ে দেন এবং সরাসরি কর্মীদের হাতে তুলে দেন। তারা এটি করেন কারণ তারা তাদের দলের প্রত্যেকের কর্মদক্ষতার উপর আস্থাশীল। যার ফলে কর্মীরাও তাদের দক্ষতার সবটুকু দিয়ে চেষ্টা করেন লক্ষ্য অর্জনের জন্য।
৭. ইংরেজিতে একটি প্রবাদ আছে “If you are the smartest person in the room, you are in the wrong room.” সফল নেতৃত্বস্থানীয় ব্যাক্তিরা সবসময় স্বীদ্ধান্ত গ্রহনের ক্ষেত্রে সকলের মতামত প্রদানের জন্য পরিবেশ তৈরী করেন। এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন আস্থা অর্জনের ক্ষেত্রে।
৮. রবার্ট এ্যান্থনী অত্যন্ত চমৎকার একটি উক্তি করেছিলেন “When you blame others, you give up your power to change”। আমরা কখনই সহজে আত্মসমালোচক হতে পারি না। নিজের ভুলগুলোকে দেখতে পাই না বা কেউ দেখালে তা সহ্য করতে পারি না। এটি টেকসই নেতৃত্বের জন্য বড় প্রতিবন্ধক।
এরকম আরো অনেক উদাহরণ দেওয়া যায়। কিন্তু একটি কথাই পরিশেষে বলতে চাই বিশ্বাস এবং নেতৃত্ব একই সাথে তাল মিলিয়ে চলে অন্যভাবে বলা যায় একটি আরেকটির পরিপূরক। বিশ্বাস প্রতিটি ভাল সম্পর্কের মূল হিসেবে কাজ করে সেটি ব্যাক্তি জীবনে হোক আর কর্মক্ষেত্রে। যখন মানুষ আপনাকে বিশ্বাস করে এবং আস্থা রাখে যে আপনি যাই করছেন তা সততার সাথে করছেন। তখন তারা আপনার লক্ষ্য বাস্তবায়নের জন্য কাধে কাধ মিলিয়ে কাজ করে। আজকের লেখায় আমার শেষ উক্তি “বিশ্বাস ব্যতীত টেকসই নেতৃত্ব স্থাপন সম্ভব নয়” এবং এটিই আমার আজকের শিরোনাম।
কে এম হাসান রিপন
নির্বাহী পরিচালক, বাংলাদেশ স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট (বিএসডিআই)