সৃজনশীল ক্ষেত্রে সম্ভাবনাময় ক্যারিয়ার
- রুবাইয়াত সাইমুম চৌধুরী
ছোটবেলা থেকেই হয়তো আঁকাজোকা, নকশা করার প্রতি আপনার আগ্রহ; হয়তো ছবি তোলা ওূ অভিনয়ের মতো সৃজনশীল কাজ করতে আপনি ভালোবাসেন। এই আগ্রহই কিন্তু আপনাকে পড়ার বিষয় কিংবা ক্যারিয়ারের পথ দেখাতে পারে। কীভাবে?
খুব বেশি দিন আগের কথা নয়, যখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চিকিৎসা, প্রকৌশল, ব্যবসায় প্রশাসন কিংবা অর্থনীতির মতো বিষয়গুলোয় না পড়লে মোটামুটি জীবনে কিছুই হবে না বলে ধরে নেওয়া হতো। এখন বাজার বদলেছে, দৃষ্টিভঙ্গি বদলেছে। অর্থনীতিতে নতুন চাহিদার সঙ্গে তাল মেলাতে নতুন কিংবা আগে স্বল্প পরিচিত বিষয়গুলোয় দক্ষতা অর্জন করে এখন অনেকেই শুধু প্রতিষ্ঠিত নন, প্রথিতযশা। সারা বিশ্বেই চাকরির বাজারে সৃজনশীলতাকে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে, বাড়ছে সৃজনশীল বিষয়গুলোয় পড়ালেখার চাহিদা।
পোশাকশিল্পের বড় বাজার
তৈরি পোশাকশিল্প বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় চাকরির বাজার। দেশে প্রায় ১২ হাজারের বেশি পোশাক কারখানা আছে। সঙ্গে আছে বায়িং হাউস, সোয়েটার কারখানা, টেক্সটাইল ইন্ডাস্ট্রি, মান নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠান এবং ফ্যাশন হাউস। বাংলাদেশ ২০২১ সালে ৫০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছে। অর্থাৎ আমাদের অন্তত ৫০ হাজার দক্ষ জনশক্তি দরকার হবে। এই খাতে শ্রমিকেরা ছাড়া দক্ষ জনশক্তি বলতে তাঁদেরই বোঝানো হয়, যাঁরা সাধারণত পোশাক উৎপাদন ব্যবস্থাপনা ও প্রযুক্তি, পণ্য বিক্রি, ফ্যাশন ডিজাইন, টেক্সটাইল প্রকৌশল বা প্রোডাক্ট ডিজাইনিংয়ের মতো বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর করেছেন। এই পড়ালেখার বিষয়গুলোয় তাত্ত্বিক জ্ঞানের পাশাপাশি ব্যবহারিক শিক্ষাকে বিশেষভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়।
বর্তমান প্রেক্ষাপটে খুবই সম্ভাবনাময় ক্ষেত্র হলো ফ্যাশন ডিজাইনিং। যদিও ফ্যাশন ডিজাইনিং বলতে অনেকে শুধু পরিধেয় পোশাকের নকশা করাকেই বুঝে থাকেন। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে ফ্যাশন ডিজাইনিংয়ের পরিধি অনেক ব্যাপক। এই বিষয়ে পাস করা একজন শিক্ষার্থীর সামনে ডিজাইনার হওয়া ছাড়াও টেক্সটাইল বিশেষজ্ঞ, ফ্যাশন স্টাইলিশ, ফ্যাশন সাংবাদিক, কারখানা ব্যবস্থাপক, প্রোডাকশন ম্যানেজার ও শিক্ষক হওয়ার পূর্ণ সুযোগ থাকে। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের পাশাপাশি ২০০৩ সাল থেকে দেশের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ফ্যাশন ডিজাইনিং পড়ানো হচ্ছে।
গ্রাফিকস ডিজাইনের সম্ভাবনা
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে শুধু দেশে নয়, বরং সারা বিশ্বেই খুবই প্রয়োজনীয় একটি দক্ষতার জায়গা হলো গ্রাফিকস ডিজাইনিং। গ্রাফিকস ডিজাইনিং কোথায় দরকার? এর চেয়ে কোথায় দরকার নেই, সেই প্রশ্নের উত্তর দেওয়া সহজ! বইয়ের প্রচ্ছদ থেকে শুরু করে বিলবোর্ডের ডিজাইন, বিয়ের কার্ড থেকে ওয়েবসাইটের আউটলুক, সংবাদপত্রে বিজ্ঞাপন থেকে চলচ্চিত্রের প্রচারণা—সব ক্ষেত্রেই দক্ষ গ্রাফিকস ডিজাইনারের প্রয়োজন আছে। বাংলাদেশে খুব বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে গ্রাফিকস ডিজাইন কিংবা গ্রাফিকস ডিজাইন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়ায় স্নাতক ও স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয় না। এ ক্ষেত্রে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের গ্রাফিকস ডিজাইন বিভাগ বেশ পুরোনো। ১৯৪৮ সালে এর যাত্রা শুরু, যদিও সেই সময়ে এই বিভাগের নাম ছিল কমার্শিয়াল আর্ট ডিপার্টমেন্ট। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও শান্ত-মারিয়াম ইউনিভার্সিটি অব ক্রিয়েটিভ টেকনোলজির পাশাপাশি কিছু কিছু ইনস্টিটিউট গ্রাফিকস ডিজাইন পড়াচ্ছে।
দেশের চাকরির বাজারে দক্ষ গ্রাফিকস ডিজাইনারের বেশ চাহিদা আছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে পড়ালেখা শেষ হওয়ার আগেই তাঁরা চাকরি পেয়ে যান। আর যাঁরা চাকরি করতে চান না, তাঁরা সহজেই ফ্রিল্যান্সার হিসেবে দেশ-বিদেশের ওপেন মার্কেট প্লেস, যেমন: ওডেস্ক, আপওয়ার্কের মতো জায়গায় কাজ করতে পারেন। তাই গ্রাফিকস ডিজাইনাররা সাধারণত কখনোই বেকার থাকেন না।
স্থাপত্যের আধিপত্য
ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার বাংলাদেশে আরও একটি উদীয়মান ক্ষেত্র। মানুষের মাথাপিছু আয় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে জীবনযাত্রার মানেরও উন্নতি হয়েছে। তারই প্রভাব পরেছে রুচিবোধে এবং জায়গার সর্বোচ্চ সদ্ব্যবহারের ওপরে। এখন প্রতিটি ইঞ্চি মূল্যবান, প্রতি ইঞ্চিকেই হতে হবে ব্যবহারযোগ্য ও নান্দনিক। সেটা অফিস কিংবা বাসা, যেখানেই হোক না কেন। আর তাই দরকার ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট। তাঁরাই সৃজনশীল নকশার মাধ্যমে সবচেয়ে সুন্দরভাবে ব্যবহারযোগ্য করবেন প্রতিটি অফিস, দোকান, হোটেল, রেস্তোরাঁ কিংবা বাসা। একজন ইন্টেরিয়র আর্কিটেক্ট যে শুধু এসবই করবেন, এমন নয়, তিনি চাইলে সেট ডিজাইনার, ইন্টেরিয়র ম্যাটেরিয়াল বিশেষজ্ঞ, ল্যান্ডস্কেপ ডিজাইনার হিসেবেও ক্যারিয়ার গড়তে পারেন। বাংলাদেশে বুয়েটসহ বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে স্থাপত্য বিভাগে ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার পড়ানো হয়। এ ছাড়া কিছু কিছু বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে ইন্টেরিয়র আর্কিটেকচার বিভাগ রয়েছে।
এবং অন্যান্য
ওপরের বিষয়গুলোর মতো বাজারজুড়ে চাহিদা না থাকলেও বাজারের নির্দিষ্ট কিছু অংশে, যাকে আমরা ‘সেগমেন্টেড মার্কেট’ বলি, সেখানে কিছু বিষয়ের বিশেষ চাহিদা রয়েছে। আর এই চাহিদা দেশ ও বিদেশ উভয় ক্ষেত্রেই। ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া, অ্যানিমেশন ডেভেলপমেন্ট, শিল্পকলা কিংবা ফটোগ্রাফির মতো বিষয়গুলো ভবিষ্যৎ বিশেষায়িত চাকরি বাজারে বিশেষভাবে কাম্য। বাংলাদেশে সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটি, ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস বাংলাদেশসহ ঢাকার পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটে উল্লেখিত বিষয়গুলোর ওপর ডিগ্রি দেওয়া হয়। নৃত্য ও সংগীতের ওপরে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগ, নৃত্য বিভাগ এবং ছায়ানট স্নাতকসহ বিভিন্ন ধরনের কোর্স পড়িয়ে থাকে। এসব বিষয়ের পড়ালেখা কোরিওগ্রাফার, শিল্প নির্দেশক, কস্টিউম ডিজাইনার (পোশাক নকশাকার), মিউজিক স্কোর (আবহ সংগীত) ডিজাইনার কিংবা টাইপোগ্রাফার হওয়ার রাস্তাকে প্রসারিত করে।
পৃথিবীতে পরিবর্তনই শাশ্বত। আর এই পরিবর্তনের ছাপ পড়েছে আমাদের দেশের, তথা বিশ্বের চাকরির বাজারেও। চাকরিদাতারা আগের জনপ্রিয় ও ঐতিহ্যবাহী বিষয়গুলোর সঙ্গে নতুন চাহিদা পূরণে সক্ষম কর্মমুখী বিষয়গুলোকেও বিশেষভাবে বিবেচনা করছে। প্রযুক্তির বিষয়গুলোর সঙ্গে বাজার চাহিদার সমন্বয়ের ফলে ফ্যাশন ডিজাইনিং কিংবা ‘অ্যাপারেল ম্যানুফ্যাকচারিং’য়ের মতো বিষয়গুলো হয়ে উঠছে সৃজনশীল প্রযুক্তি। আর ভবিষ্যতের বাজারে সবচেয়ে কাঙ্ক্ষিত দক্ষতাই হবে প্রযুক্তির সঙ্গে সৃজনশীলতার মিশ্রণ করার পারদর্শিতার। তরুণদের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করার মানসিকতা এখন সবচেয়ে বেশি জরুরি। তাহলেই তারা শুধু দেশের বাজারের জন্য নয়, বরং বৈশ্বিক বাজারের জন্যও প্রস্তুত হতে পারবে।