কোন ধরণের চাকরি করবেন? কেন করবেন?
- ডা. মোহাম্মদ ইলিয়াস
চাকরি জীবনে আপনি কী করবেন, কতটুকু করবেন, কতটুকু যাবেন, সৃষ্টিকর্তা আপনাকে দিয়ে কী করাবেন, সেটার ইন্ডিকেটর তিনটা “P” – Post, Position & Pro-Position।
মনে করুন, আপনি মি. এক্স, এডিশনাল ডিরেক্টর, বাংলাদেশ রেলওয়ে, অধ্যাপক, সার্জারি বিভাগ, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, পরিচালক, বাংলাদেশ এগ্রিকালচারাল অ্যান্ড রুরাল ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি ইত্যাদি।
এই ডেজিগনেশান বা পদবীই হচ্ছে আপনার পোস্ট। পোস্ট আপনাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেক কিছুতেই হেল্প করবে। যেমন আপনি যদি কোনো সরকারি মেডিকেলের অধ্যাপক বা রেজিস্ট্রার হোন, অনেক রোগী আপনাকে চিনবে না, কিন্তু আপনার চেম্বারে আসবে, এই জন্য আসবে– এই রোগী একজন প্রফেসরকে দেখাতে চায়।
পোস্টের জন্যই আপনি অনেক সম্মান, মর্যাদা এবং শ্রদ্ধা পাবেন। মানুষ মূলত শ্রদ্ধা করছে ওই পোস্টটাকেই। আবার, আপনি প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট বা অ্যাসিস্টেন্ট কিছুই না, কিন্তু আপনার পাশেই চেম্বার করা প্রফেসর, অ্যাসোসিয়েট বা অ্যাসিস্টেন্ট প্রফেসরদের চেয়ে আপনার চেম্বারে অনে…… ক বেশি রোগী।
কেন জানেন? এর কারণ হচ্ছে আপনার কোয়ালিটি তথা, আপনার পজিশন। কারণ আপনার ডেজিগনেশান বা পোস্ট যাই হোক, আপনার কোয়ালটি আছে, আপনি হ্যাপি কাস্টমার তৈরি করতে পারেন, আপনার কনভিন্সিং পাওয়ার আছে, আপনি মোটিভেট করতে পারেন। সুতরাং যে বা যারা আপনার সাথে ঘনিষ্ঠভাবে মিশেছে বা অপরিচিত কোনো গ্রাহক আপনার কাছে একবার এলে সেই আপনার হ্যাপি কাস্টমার হয়ে গেছে। আপনাকে ছাড়া অন্য কাউকে দেখাচ্ছে না।
এবারে থার্ড P তথা Proposition। Pro-position মানে ইউনিক ক্রিয়েটিভিটি। এমন একটা সার্ভিস, কনসেপ্ট, মেকানিজম – যেটি শুধু আপনিই দিতে পারেন, অথবা অনেকেই দিতে পারে, কিন্তু উক্ত সার্ভিস, কনসেপ্ট, মেকানিজমে আপনার লেভেল অন্যদের ধরাছোঁয়ার বাইরে। অথবা বাজারে আপনি নিত্য নতুন ক্রিয়েটিভিটি, কনসেপ্ট, আইডিয়া নিয়ে আসতে পারেন, আইডিয়া পুরনো হয়ে যাওয়ার আগেই নতুন আইডিয়া নিয়ে হাজির হতে পারেন। আপনার যদি এই P তথা Proposition থাকে, তাহলে আপনি অনন্য। আপনাকে চাকরি করতে হবে না, আপনি অসংখ্য মানুষকে চাকরি দিতে পারবেন। আপনিই অনেক বড় পরিসরে জাতিকে অনেক বড় কিছু দিতে পারবেন, অনেক বড় ধরনের উদ্যোক্তা হয়ে এমন কিছু করতে পারবেন, যে পর্যায়ে যাওয়ার স্বপ্নই হয়ত আপনি দেখেননি। শুধু একটু নিজের ওপর আত্মবিশ্বাস রাখতে পারলে এবং পরিশ্রমী হতে পারলেই হবে।
কী করবেন? আগে নিজেকে জানুন। অন্যকে নিয়ে, অন্য বিষয় নিয়ে অনেক অনেক গবেষণা তো করেছেন, একটু নিজেকে সময় দিন, স্বার্থপর হয়ে নিজেকে একটু সময় দিন, চিন্তা করতে থাকুন।
১। আপনার সবচেয়ে শক্তিশালী পাঁচটি দিক কী?
২। আপনার সবচেয়ে দুর্বল পাঁচটি দিক কী?
৩। আপনার সামনে শীর্ষ পাঁচটি বড় বড় সম্ভাবনা কী আছে?
৪। আপনার বড় ধরণের পাঁচটি চ্যালেঞ্জ কী কী?
অনলাইনে অনেক ক্রিয়েটিভিটি অ্যাসেসম্যান্ট টুলস পাওয়া যায়, সেলফ অ্যাসেসম্যান্ট টুলস পাওয়া যায়। এগুলি দেখে নিজেকে বিচার করতে শিখুন।
আপনি যদি পোস্টের উপর বেশ নির্ভরশীল হন, কোন ধরণের ঝুঁকি নিতে না চান, একটি নির্ভেজাল জীবন যাপন করতে চান, খুব বেশি ঝামেলার মধ্যে যেতে না চান, ছিমছাম গোছানো সুন্দর প্রেডিক্টেবল লাইফ চান, তাহলে চাকরি করা আপনার জন্য অবশ্য কর্তব্য। আর চাকর যদি হনই, তাহলে সরকারি চাকর হওয়াই উত্তম।
দুই.
আপনি যদি নিজের কোয়ালিফিকেশন আর পরিশ্রম করার ক্ষমতা সম্পর্কে কনফিডেন্স থাকেন, আপনি যদি সৎ পরশ্রমী এবং নিয়ামানুবর্তী হন, তাহলে আপনি পছন্দমত যেকোন চাকরিই করতে পারেন – সরকারি/বেসরকারি। যেখানেই আপনি কমফোর্ট ফিল করেন–যেতে পারেন। এই চাকরিই করতে হবে এটা আপনার জন্য বাধ্যতামূলক না। চাকরিদাতারা আপনাকেই খুঁজছে। আজ আপনি চাকরি ছাড়বেন, এর চেয়ে ভালো অফার কাল আপনার কাছে আসবে – এটা আগামীকালের সূর্যোদয়ের মতোই নিশ্চিত।
আপনি হয়ত আপনার যোগ্যতা অনুযায়ী সর্বোচ্চ সম্মান বা ইনকাম পাবেন না, কিন্তু আপনি খারাপও থাকবেন না, আপনি অবশ্যই ভাল থাকবেন।
তিন.
আপনি যদি ক্রিয়েটিভ হন, কনসেপ্ট কীভাবে তৈরি করতে হয়, কীভাবে কনসেপ্ট পুরানো হয়ে যায়, কীভাবে সেটাকে রিভাইভ করাতে হয় – এইগুলিতে যদি আপনি দক্ষ হন। আর আপনি যদি খুব একটা শৃঙ্খল না হন, অর্থাৎ বিশৃঙ্খল হন, তাহলে অনুগ্রহ করে – আপনি চাকরি করবেন না, জাতি একজন উদ্যোক্তা হারাবে, অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে জাতির।
যমুনা গ্রুপ, এস আলম গ্রুপ, বসুন্ধরা গ্রুপ, হা মীম গ্রুপ, ট্রান্সকম গ্রুপ, বেক্সিমকো গ্রুপ ও নিটোল গ্রুপের উদোক্তারা যদি চাকরি করতেন, জাতি আজ ৫০ বছর পিছিয়ে থাকত।
ড. ইউনুস চাকরি অব্যাহত রাখলে আমরা একজন নোবেল বিজয়ী বাংলাদেশী পেতাম না। আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ চাকরি করলে আমরা বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র পেতাম না।
আর এই জাতের মানুষ হবার পরও আপনি জোর করে চাকরি করলে, দেখবেন আপনার মানিয়ে নিতে সমস্যা হচ্ছে, আপনি চাকরি নিয়ে সন্তুষ্ট হতে পারছেন না, আপনার নিয়োগকর্তারা আপনার উপর সন্তুষ্ট না, আপনি ডিসিপ্লিন্ড হতে পারছেন না, আপনি এডজাস্ট করতে পারছেন না। অতএব নিজেকে জানুন, সিদ্ধান্ত নিন।
সবাইকে একই ট্রেন্ড ফলো করতে হবে – এটা জরুরি না। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু ছিলেন আইসিএস (Indian Civil Service) অফিসার। এখনকার বিসিএস এডমিন অফিসার থেকে অনেক অনেক বেশি ক্ষমতাধর ছিলো সেই সময়ের আইসিএস অফিসাররা। সেই ক্ষমতার মোহ এক বছরের মাথায় ত্যাগ করেছিলেন। তাই হতে পেরেছিলেন সারা ভারতবর্ষের নেতা। যদি ব্রিটিশ সরকারের চাকরিই সারা জীবন করতেন তাহলে আমরা সুভাষ চন্দ্র বসুকে হয়ত পেতাম কিন্তু নেতাজীকে পেতাম না।
আরেকজন ট্রু লিডার ড. আখতার হামিদ খানও ছিলেন আইসিএস অফিসার। ত্রাণ বিতরণের অব্যবস্থাপনা দেখে রাগে ক্ষোভে দুঃখে চাকরি ছেড়ে দিয়েছিলেন। প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বার্ড (বাংলাদেশ একাডেমি ফর রুরাল ডেভেলপমেন্ট)। এই বার্ড থেকেই জন্ম নিয়েছে পাকিস্তান এবং বাংলাদেশের পল্লী উন্নয়নের অসংখ্য সফল মডেল এবং কনসেপ্ট। বর্তমানের উপজেলা পরিষদের মডেল বার্ডের সৃষ্টি। কো অপারেটিভ মাইক্রোফিন্যান্সের ধারণা এসেছে বার্ড থেকে। ড. আখতার হামিদ খান চাকরি না ছাড়লে হয়তো আমরা একজন জাঁদরেল মন্ত্রী পরিষদ সচিব পেতাম কিন্তু বাংলাদেশের গ্রামগুলোতে এখনো মানুষ না খেয়ে মারা যেত।
আমাদের প্রথম ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ছিলেন পাকিস্তান সিভিল সার্ভিসের ট্যাক্স ক্যাডারের অফিসার। চাকরি ছাড়ার দলে তিনিও একজন। চাকরি না ছাড়লে হয়ত এনবিআররের চেয়ারম্যান হতেন কিন্তু দেশ কি স্বাধীন হতো?
সরকারি চাকরিতে ক্ষমতাসীন দলের শর্তহীন আনুগত্য করতে হয়, মাথা নিচু করা আনুগত্য। হাতজোড় করা আনুগত্য। মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসার আনুগত্য।
মুক্ত চিন্তার মানুষ যারা এটা করতে পারবে না সরকারি চাকরি তাদের জন্য একটি মানসিক অত্যাচার। নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু, ড. আখতার হামিদ খান, সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই মানসিক অত্যাচার থেকে নিজেদের মুক্তি দিয়েছিলেন। ফলশ্রুতিতে ভারতবর্ষ মুক্তি পেয়েছিল ব্রিটিশ থেকে, গ্রামগুলো মুক্তি পেয়েছিল দারিদ্র থেকে, বাংলাদেশ মুক্তি পেয়েছিল পাকিস্তান থেকে।
লিডাররা সিস্টেম ক্রিয়েট করে আর ম্যানেজাররা সেই সিস্টেম ফলো করে, মেইনটেইন করে। চাকরিজীবীদের তেমনি একটি সিস্টেমের মধ্যে চলতে হয়। এখানে লিডারশিপ কোয়ালিটির তেমন কোন দাম নেই। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে আমাদের অনেক অনেক ট্রু লিডার দরকার। বর্তমান সময়ের তথাকথিত পলিটিক্যাল লিডার না।
নেতৃত্বের সত্যিকারের গুণাবলীসম্পন্ন মানুষগুলোর কোন ধরণের চাকরিতেই প্রবেশ না করা উচিৎ। এই চাকরি আপনাদের জন্য না। আপনারা আরো বড় পরিসরে জাতিকে নেতৃত্ব দিন। আমাদের যে সত্যিকারের ক্রিয়েটিভ নেতার যে বড় অভাব!
লেখক: ডিপার্টম্যান্ট অফ নিউরোলোজি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা