পেশা গড়ি বোকা বাক্সে
মারুফ ইসলাম: টেলিভিশনকে ‘বোকা বাক্স’ বলে তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করার দিন শেষ! সময় যত গড়চ্ছে, মানুষ যত আধুনিক হচ্ছে ছোট পর্দার আবেদন তত বাড়ছে। বিনোদন এবং ব্যবসায়-উভয় দিক থেকেই ছোটপর্দা তার অনিবার্যতা প্রমাণ করে চলেছে। বিশেষজ্ঞদের অভিমত, শুধু ঢাকাতেই নাকি ছোট পর্দায় বছরে ৩০০ কোটি টাকার ব্যবসা হয়। সুতরাং নাম, যশ, অর্থ আর গ্ল্যামার একসঙ্গে চাইলে ক্যারিয়ার হিসেবে বেছে নিতে পারেন বোকা বাক্সকে।
বৈদ্যুতিক মাধ্যমের দুটি গুরুত্ব অংশ একটি নিউজ চ্যানেল, যেখানে সংবাদ সম্প্রচার হয় এবং অন্যটি বিনোদন অর্থাৎ ধারাবাহিক বিভিন্ন অনুষ্ঠান (গান, নাচ, কথিকা, টক শো, রিয়েলিটি শো) সম্প্রচার হয়। নিউজ চ্যানেলের ক্ষেত্রে ধরাবাঁধা চাকরি আর বিনোদনক্ষেত্রে কাজটি হয় চুক্তিভিত্তিক ফ্রিল্যান্সিং জব।
নিউজ কাস্টিং
রেডিওতে খবর পড়তে হয়, কিন্তু টেলিভিশনে খবর বলতে হয়। সে জন্য বর্তমানে সংবাদ পাঠক-পাঠিকাদের বলা হয় ‘নিউজ কাস্টার’। সংবাদ চ্যানেলে এই পদে লোক নেওয়া হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা হিসেবে সাধারণসত স্নাতক চাওয়া হয়। এর বাইরে এই পদের জন্য যেসব গুণ থাকা দরকার: ১. স্ক্রিন পার্সোনালিটি ২. খবর গুছিয়ে বলার ক্ষমতা ৩. ভালো কণ্ঠস্বর ও নির্ভুল উচ্চারণ ৪. যথার্থ সংবাদ-জ্ঞান।
রিপোর্টার, সাব-এডিটর, ফটোগ্রাফার
সংবাদ সংগ্রহ ও ডেস্কে বসে কপি লেখার জন্য রিপোর্টার/সাব-এডিটর নেওয়া হয়। ঠিক তেমনই ছবি তোলার জন্য ফটোগ্রাফার পদে লোক নেওয়া হয়। শিক্ষাগত যোগ্যতা লাগে গ্র্যাজুয়েট এবং সেই সঙ্গে দরকার হয় কারিগরি দক্ষতা।
অনুষ্ঠান সঞ্চালনা
বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান বা গেম শোগুলোর উপস্থাপনার উপস্থাপক নেওয়া হয়। উপস্থাপনার কাজ নিউজ নিউজ কাস্টিং বা অ্যাঙ্কারিংয়ের থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। অনেক ক্ষেত্রে তাদের হাতে তৈরি স্ক্রিপ্ট থাকে না। বিষয় অনুযায়ী ভাষা তৈরি করে দর্শকদের মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখতে হয় কথার জাদুতে।
রিসার্চার
বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠানের (টক শো, গেম শো, ইন্টারভিউভিত্তিক অনুষ্ঠান) জন্য তথ্য সংগ্রহ, বিশিষ্ট ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে সাক্ষাৎকার এবং গবেষণার কাজে রিসার্চার পদে লোক নেওয়া হয়।
অভিনেতা-অভিনেত্রী
বিভিন্ন চ্যানেলের ধারাবাহিকে চোখে পড়ে প্রতিষ্ঠিত শিল্পীদের পাশাপাশি অনেক তরুণ মুখ। নতুন ধারার পরিচালকরা অচেনা নতুন মুখ নিয়ে কাজ করতে পছন্দ করেন। সাধারণত নতুন শিল্পী বাছাইয়ে দেখা হয়: ১. চিত্রনাট্যের চরিত্র অনুযায়ী শিল্পীর চেহারার সামঞ্জস্য, ২. পর্দায় দেখতে ভালো লাগবে কিনা, ৩. অভিনয় ক্ষমতা এবং ৪. কাজের পূর্বঅভিজ্ঞতা।
স্টোরি ডেভেলপার/সংলাপ লেখক/চিত্রনাট্যকার
ধারাবাহিকের ধরন অনুযায়ী গল্প দাঁড় করানো, চরিত্র, ঘটনা, পটভূমিকা তৈরির দায়িত্বে থাকেন স্টোরি ডেভেলপার। গল্প অনুযায়ী চিত্রনাট্য লেখেন চিত্রনাট্যকার। সংলাপ লেখকের দায়িত্ব প্রতিটি চরিত্রের জন্য সংলাপ লেখা। এই তিন ধরনের কাজের জন্য ভালো লেখার হাত থাকা চাই।
কনসেপ্ট ডেভেলপার
বিশেষ কোনো ভাবনাকে কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে অনুষ্ঠান। এই ভাবনার খসড়া তৈরি বা পরিকল্পনা করেন কনসেপ্ট ডেভেলপার বা অনুষ্ঠান প্রযোজক। এই ধরনের কাজের জন্য ভালো চিন্তাশক্তি ও সৃজনশীল ক্ষমতা থাকা দরকার।
টাইটেল সঙ গায়ক-গায়িকা
এ ক্ষেত্রে বেশিরভাগ সময় ডাকা হয় নতুনদের। কারণ নামিদের সম্মানী বেশি। টাইটেল সঙ ছাড়াও সিরিয়ালের সময় বিভিন্ন সিকোয়েন্সে হিট গান বা নতুন গান গাইতে শিল্পীদের ডাকা হয়।
কস্টিউম ডিজাইনার
চরিত্রের জন্য পোশাক থেকে জুয়েলারি, জুতো, ব্যাগ ও অন্যান্য অ্যাক্সেসরিজ তৈরি ও সংগ্রহের দায়িত্বে থাকেন কস্টিউম ডিজাইনার।
গ্রাফিক্স-ডিজাইনার
সংবাদ বা ধারাবাহিক বা বিভিন্ন অনুষ্ঠানে ডিজাইনিং ও শিল্পনৈপুণ্য ফুটিয়ে তুলতে ডাকা হয় গ্রাফিক্সশিল্পীদের। এই কাজের জন্য মাল্টিমিডিয়ার কাজ জানা জরুরি।
প্রডাকশন এক্সিকিউটিভ বা ম্যানেজার
শিল্পীদের সঙ্গে কথা বলে শুটিংয়ের তারিখ ঠিক করা, শুটিংয়ের জন্য লোকেশন বাছাই, অভিনেতা/কলাকুশলীর জন্য খাওয়ার ব্যবস্থাপনা ইত্যাদির দায়িত্বে থাকেন প্রোডাকশন ম্যানেজার। তার অধীনে থাকেন অ্যাসিস্ট্যান্ট বা এক্সিকিউটিভ।
কোরিওগ্রাফার
টাইটেল সিকোয়েন্সের এবং সিরিয়ালের কিছু দৃশ্য থাকে কোরিওগ্রাফারের। বিয়ে, পার্টি বা কোনো উৎসবের দৃশ্য হলে ডাক পড়ে কোরিওগ্রাফারের। এরা মূলত নাচের দৃশ্য বা মডেলদের নেপথ্য পরিচালক বা প্রশিক্ষক।
ক্রিয়েটিভ হেড
ওপরের যে কাজের ক্ষেত্রগুলোর কথা বলা হলো, তার পুরো দায়িত্বে থাকেন ক্রিয়েটিভ হেড। কোনো ধারাবাহিক বা প্রোগ্রামের কনসেপ্ট ঠিক হয়ে গেলে এবং পাইলট পর্ব চ্যানেলের সবুজ সঙ্কেত পেয়ে গেলে প্রডাকশন হাউসের কর্তৃপক্ষ ক্রিয়েটিভ হেডের সঙ্গে বসেন। কোন ক্ষেত্রে কে কাজ করবেন, তা ঠিক করেন। এক কথায় জুতো সেলাই থেকে চণ্ডিপাঠ, সব ধরনের কাজ করেন ক্রিয়েটিভ হেড ও তার টিম।
টেকনিক্যাল কাজ
পর্দার সামনে যত লোক কাজ করেন, তার থেকে বেশি লোক কাজ করেন পর্দার নেপথ্যে। যাদের বলা হয় টেকনিশিয়ান বা কলাকুশলী। কাজ জানলে এসব পেশায় কেউ বসে থাকে না। যথেষ্ট রোজগার, খ্যাতি ও সম্মান রয়েছে। দেখে নেওয়া যাক গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রগুলো।
পরিচালক
টিভিতে ফিকশন ও নন-ফিকশনের ব্যাপক কাজ বাড়ায় তরুণ পরিচালকদের কাজের সুযোগ অনেক বেড়েছে। বিশ্ববাজারে শর্টফিল্ম, টেলিফিল্ম ও বিজ্ঞাপন চিত্রের রমরমা বাজার। ধারাবাহিক বা প্রোগ্রামে একজন মূল পরিচালক ছাড়াও থাকেন পর্ব পরিচালক। আবার একজন পরিচালকের অধীনে থাকেন অন্তত দু-তিনজন সহপরিচালক।
ক্যামেরাম্যান
ক্যামেরাম্যান হলেন পরিচালকের চোখ। সিনেমার দৃশ্য গ্রহণের দায়িত্বে থাকা ক্যামেরাম্যানকে বলা হয় সিনেমাটোগ্রাফার আর ছোট পর্দার বেলায় বলা হয় ভিডিওগ্রাফার। বড় ক্যামেরাম্যানের অধীনে থাকেন একাধিক সহকারী ক্যামেরাম্যান।
ভিডিওলজিস্ট
একই ফ্লোরে যখন একাধিক প্রডাকশনের কাজ হয়, তখন প্রতিটি ইউনিটের কারিগরি ক্ষেত্রের দেখভালের দায়িত্ব সামলান ভিডিওলজিস্ট। এই ধরনের কাজ বেশি হয় হলিউড-বলিউডের মতো জায়গায়।
এডিটর
গল্পের চরিত্র অনুযায়ী দৃশ্যের পর দৃশ্যজুড়ে সম্পাদনার করেন এডিটর। একজন এডিটরের অধীনে থাকেন একাধিক সহকারী সম্পাদক।
সাউন্ড রেকর্ডিস্ট
শব্দ ও সংগীত গ্রহণের কারিগরিশিল্পী সাউন্ড রেকর্ডিস্ট বা শব্দযন্ত্রী।
মেকআপশিল্পী
চরিত্র অনুযায়ী অভিনেতা-অভিনেত্রীদের সাজানোর দায়িত্বে থাকেন মেকআপশিল্পী। আবার শিল্পীদের কেশ পরিচর্যার দায়িত্বে থাকেন যারা, তাদের বলা হয় হেয়ার ড্রেসার।
যোগ্যতা ও দক্ষতা
বৈদ্যুতিক মাধ্যমে কাজের জন্য শিক্ষাগত যোগ্যতার বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয় দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও পেশাদারিত্বে। টেকনিক্যাল কাজের জন্য প্রতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ থাকাটা জরুরি। অভিনয়ের ক্ষেত্রে একেবারে আনকোরাদের চেয়ে কাজ জানাদের বেশি পছন্দ করা হয়।
পারিশ্রমিক
কাজের পারিশ্রমিক নির্ধারিত হয় এপিসোড পিছু বা মাসিক চুক্তিতে। মেগা ধারাবাহিকে মাসিক চুক্তি হয়। পারিশ্রমিক ছাড়াও খাওয়া-দাওয়ার সুযোগ রয়েছে।
কাজ পেতে
যোগ্যতা ও দক্ষতা অনুসারে পছন্দমতো ক্ষেত্র বেছে নিয়ে নিজেকে তৈরি করে এগোতে হবে। এই পেশায় যোগাযোগের মাধ্যমে কাজ পাওয়া যায়। যোগাযোগ করতে পারেন পরিচালক বা প্রডাকশন হাউসের সঙ্গে। অভিনয়ের জন্য নিজের পোর্টফোলিও জমা দিতে হবে। অন্যান্য সৃজনশীল কাজের জন্য বায়োডাটা পাঠাতে হবে প্রডাকশন হাউসের ঠিকানায়। কারিগরি অর্থাৎ টেকনিশিয়ান হিসেবে কাজ করতে সিরিয়াল বা প্রোগামে চাইলে টেকনিশিয়ান ফিল্ডের সদস্য হতে হয়। নবাগতদের শুরুতে ‘অবজারভার’ হিসেবে থাকতে হয়। তবে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের ছাত্রছাত্রী হলে অবজারভার হিসেবে থাকার দরকার হয় না।