কর্পোরেট দুনিয়ার হাতছানি
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
‘বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বের শিক্ষাব্যবস্থা এখন হয়ে গেছে বাজারচালিত। অর্থাৎ বাজারে যা কিছুর চাহিদা আছে তা-ই পড়ানো হচ্ছে। আগে একটি দেশের অর্থনীতিতে ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরের অবদান ছিল ৭৫ শতাংশ এবং সার্ভিস সেক্টরের অবদান ছিল ২৫ শতাংশ। বর্তমান একেবারে উল্টো হয়ে গেছে। অর্থাৎ এখন সার্ভিস সেক্টর থেকে আসছে ৭৫ শতাংশ এবং ম্যানুফ্যাকচারিং থেকে আসছে মাত্র ২৫ শতাংশ। ম্যানুফ্যাকচারিং সেক্টরে প্রয়োজন হচ্ছে ইঞ্জিনিয়ার আর সার্ভিসে প্রয়োজন ম্যানেজার। সেবা খাতে এই ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার জন্যই মূলত বিবিএ ও এমবিএর মতো পেশাদার ডিগ্রিগুলো এত জনপ্রিয়তা পেয়েছে।’ কথাগুলো উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব বিজনেসের ডিন অধ্যাপক ড. নজরুল ইসলামের।
বিশ্বে সেবা খাতের জনপ্রিয়তা এখন তুঙ্গে। বাংলাদেশও ব্যতিক্রম নয়। ব্যবসা ক্ষেত্রে পেশাদার কর্মী তৈরি করার জন্য বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো ব্যবসায় প্রশাসনের বিভিন্ন বিষয়ে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর ডিগ্রি দিচ্ছে। প্রায় প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যবসায় প্রশাসন পড়ানো হয়। অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের মূল বিষয়ই হচ্ছে ব্যবসায় প্রশাসন। অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স ও ব্যাংকিং, মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ইকোনমিকস—এসব বিষয়ে ব্যবসায় প্রশাসনের ডিগ্রি দেওয়া হয়ে থাকে।
এসব বিষয়ে লেখাপড়া করলে করপোরেট চাকরির যে কোনো শাখায় চাকরির জন্য আবেদন করা যায়। বাংলাদেশের চাকরির বিজ্ঞাপনের ওয়েবসাইট খুঁজলে দেখা যাবে সবচেয়ে বেশি চাকরি খালি আছে মার্কেটিং ও ফিন্যানশিয়াল অর্গানাইজেশনে। অন্য যে চাকরিগুলো রয়েছে তার মধ্যেও বেশির ভাগ চাকরিতে শিক্ষাগত যোগ্যতা চাওয়া হয় বিবিএ অথবা এমবিএ। নির্দিষ্ট কোনো পরিসংখ্যান না থাকলেও বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যবসায় প্রশাসনে যে সবচেয়ে বেশি ছাত্রছাত্রী লেখাপড়া করে তা খালি চোখেই বোঝা যায়।
ব্যবসায় প্রশাসনের শিক্ষার জন্য নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় সুপরিচিত। বিশ্ববিদ্যালয়টির স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকসের ডিন ড. মাহবুব রহমান শিক্ষার্থীদের উদ্দেশে বলেন, নর্থ সাউথের মোট শিক্ষার্থীর মধ্যে অর্ধেক আমাদের স্কুলে (স্কুল অব বিজনেস অ্যান্ড ইকোনমিকস) পড়ে। আমাদের এখানকার ডিগ্রিধারীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বে অন্যান্য দেশে চাকরি ও ব্যবসার ক্ষেত্রে সমানভাবে সাফল্য পাচ্ছে।
বিশ্ববিদ্যালয়টি অ্যাকাউন্টিং ও ফিন্যান্স, ইকোনমিকস, ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং ও ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস বিভাগে স্নাতক ডিগ্রি দিয়ে থাকে। স্নাতকোত্তরে এমবিএ ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ রয়েছে। এসব ডিগ্রি নিয়ে ছাত্ররা নিজেদের পেশার ক্ষেত্রে আরো দক্ষ করে তুলতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয় ভেদে স্পেশালাইজেশন বা বিশেষায়ণের বৈচিত্র্য লক্ষ করা যায়। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে মেজর বিষয়গুলোর মধ্যে আছে অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স, হিউমেন রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, মার্কেটিং, কম্পিউটার ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট, ই-বিজনেস, এন্টারপ্রেনারশিপ ও অপারেশনস ম্যানেজমেন্ট। এই বিষয়গুলোর মধ্য থেকে ছাত্ররা নিজেদের ভালো লাগার বিষয় পছন্দ করে নিতে পারবে।
পুরো ব্যবসায় প্রশাসনের কোর্সকে তিনটি ভাগে ভাগ করা যায়—এক. সাধারণ জ্ঞান বিষয়ক কোর্স, যেগুলো শিক্ষার্থীকে পরবর্তী বিষয়গুলোর জন্য প্রস্তুত করবে। অনেক বিশ্ববিদ্যালয়েই এই কোর্সগুলো জিইডি বা জেনারেল এডুকেশন ডেভেলপমেন্ট বা সাধারণ জ্ঞানের উন্নয়ক কোর্স হিসেবে পরিচিত। যেমন সাধারণত উচ্চ মাধ্যমিক পড়ে আসা শিক্ষার্থীদের অনেকেই ইংরেজিতে কিছুটা দুর্বল হয়, তাই ইংরেজির সাধারণ কোর্স থাকে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশের বিষয়ে সাধারণ জ্ঞান থেকে শুরু করে ইতিহাসসহ অন্যান্য বিষয়ও থাকে। থাকে আইটির দক্ষতা বাড়াতে কম্পিউটারের বিভিন্ন প্রোগ্রাম নিয়েও কোর্স। এরপর আসে কোর কোর্স। এই বিষয়গুলো ব্যবসায় প্রশাসনের বিষয়ভিত্তিক কোর্স। এই কোর্সগুলো বেসিক কিছু বিষয় শেখাবে। ব্যবসায় প্রশাসনের বিভিন্ন দিক সম্পর্কে ছাত্রকে শেখাবে। তৃতীয় ও শেষ পর্যায়ে আসে মেজর কোর্স। এ বিষয়গুলো পড়লেই বিশেষায়ন নির্ধারিত হয়। এই তিনটি ভাগে মোট ১২০ থেকে ১৪০ ক্রেডিটে ব্যবসায় প্রশাসনের স্নাতক পড়া হয়। প্রতিটি ক্রেডিটের জন্য প্রতি সপ্তাহে এক ঘণ্টা করে ১৩ সপ্তাহ ক্লাস করতে হবে। বিবিএতে পড়ার বিষয়গুলো সাধারণত প্রতিটি তিন ক্রেডিটের হয়ে থাকে। অর্থাৎ ১৩ সপ্তাহে ৩৯ ঘণ্টা একটি বিষয় বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে হবে। সর্বশেষ সেমিস্টারে ইন্টার্নশিপ অথবা থিসিস করে এই ডিগ্রি অর্জন করতে হয়। ইন্টার্নশিপে একটি নির্দিষ্ট সময়ে কোনো একটি পেশাদার কম্পানির সঙ্গে কাজ করে তার শিক্ষাজীবনের জ্ঞানকে কাজে লাগাতে হয়। এরপর সেখান থেকে ফিরে একটি প্রতিবেদন জমা দিতে হয়। যেটি একটি প্যানেল পর্যালোচনা করে তাঁকে এই ডিগ্রিধারী ঘোষণা করে। আর থিসিসের বিষয়টি পুরো শিক্ষাজীবনে তার লব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে এর একটি অংশ নিয়ে বিস্তর গবেষণা করে একটি গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি করা এবং সেটি একটি প্যানেলের সামনে ডিফেন্ড করতে হয়। অর্থাৎ নিজের সিদ্ধান্ত প্রতিষ্ঠিত করতে হয়। এরপর প্যানেলের পর্যালোচনায় তাকে ডিগ্রিধারী ঘোষণা করা হয়।
বিবিএ/এমবিএর চাকরি
এই বিষয়টির চাকরির ক্ষেত্র তুলনামূলক বেশি। ব্যাংক ও ফিন্যানশিয়াল প্রতিষ্ঠান, মার্কেটিং ও প্রমোশন থেকে ম্যানেজমেন্ট ইত্যাদি খাতে নিযুক্ত হতে পারে। এসব ক্ষেত্রে একজন সদ্য পাস করা শিক্ষার্থী কী শিখেছে তা দেখে থাকে কম্পানিগুলো। একজন নতুন কর্মী নিয়োগের ক্ষেত্রে একটি কম্পানি কী চায় তা নিয়ে কথা বলেছেন সায়েম গ্রুপের ডিরেক্টর আবরার হোসেন সায়েম। তিনি বলেন, ‘ফ্রেশার নিয়োগের ক্ষেত্রে আমি প্রথম দেখি প্রার্থীর মধ্যে সঠিক দৃষ্টিভঙ্গি আর পরিশ্রম করার মানসিকতা আছে কি না। শেখার আগ্রহ আর পরিশ্রমের মানসিকতা থাকলে যে কেউ যেকোনো ক্ষেত্রে ভালো করতে পারে। ফল অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ তবে ফলের সঙ্গে সঙ্গে এই বিষয়গুলোও গুরুত্বপূর্ণ।
অভিজ্ঞতা পেতে
প্রতিবছর নতুন গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে লাখের কাছাকাছি। শিক্ষার্থীদের প্রশ্ন, এই অভিজ্ঞতা আসবে কোথা থেকে? এটি সম্পর্কে চাকরি বিশেষজ্ঞদের পরামর্শ হচ্ছে—শিক্ষাজীবনে শুধু লেখাপড়ার মধ্যেই ডুবে না থেকে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থাকা; বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন এক্সট্রা কারিকুলার অ্যাক্টিভিটির সঙ্গে নিজেকে জড়িত রাখা; ইন্টার্নের পাশাপাশি প্রয়োজনে এক সেমিস্টার সময় নিয়ে একটি পেশাদার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের জন্য কাজ করা। আর পেশাদার অভিজ্ঞতার বিকল্প হিসেবে গবেষণার মূল্য রয়েছে বলে জানিয়েছেন আবরার। তিনি বলেন, যদি একটি বিষয়ে কারো গভীর জ্ঞান থাকে তাহলে সেটি চাকরিদাতার নজর কাড়ে।
যে দক্ষতা লাগবেই
বিবিএ ও এমবিএ পড়ে ভালো ফল করতে শিক্ষার্থীকে অবশ্যই যোগাযোগ ও উপস্থাপনায় দক্ষতার উন্নয়ন করতে হবে। এর জন্য বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো বিভিন্ন বিষয়ে প্রেজেন্টেশন নিয়ে থাকে। এতে শিক্ষার্থীদের জড়তা কাটে। পাশাপাশি ইংরেজিতে দক্ষতাও বাড়ে। বহুজাতিক কম্পানিগুলোতে কাজ করার ক্ষেত্রে ইংরেজি বলা, বোঝা ও লেখায় দক্ষতা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। প্রযুক্তি সম্পর্কেও ধারণা থাকতে হবে। যেমন অ্যাকাউন্টিং বিষয়ে কিছু সফটওয়্যার রয়েছে, যেগুলো বিবিএ শিক্ষার্থীদের জানতেই হবে। মাইক্রোসফট অফিসের বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশন যেমন ওয়ার্ড, পাওয়ার পয়েন্ট ও এক্সেলও জানতে হবে। প্রেজেন্টেশন তৈরিতে শিখতে হবে পাওয়ার পয়েন্ট। ডাটা অ্যানালিসিসের জন্য এক্সেল জানা চাই। ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম সম্পর্কেও থাকতে হবে ধারণা।
একনজরে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বিবিএ/এমবিএ
অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, মার্কেন্টিং, ম্যানেজমেন্ট—এ বিষয়গুলো মেজর প্রায় সব বিশ্ববিদ্যালয়েই রয়েছে। চলুন দেখে নেওয়া যাক কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে কোন কোন ক্ষেত্রে মেজর করা যায়।
নর্থ সাউথ বিশ্ববিদ্যালয় : এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং, ইকোনমিকস, এন্টারপ্রেনারশিপ, ফিন্যান্স, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, ম্যানেজমেন্ট, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, মার্কেটিং, সাপ্লাই চেইন ম্যানেজমেন্টে মেজর করা যায়। এ ছাড়া সাধারণ বিবিএ ও ইকোনমিকসে বিএস করা যায়। স্নাতকোত্তরে আছে এমবিএ ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ।
আমেরিকান ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি : এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং ও ফিন্যান্স, মার্কেটিং, ট্যুরিজম অ্যান্ড হসপিটালিটি ম্যানেজমেন্ট, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, অপারেশনস ম্যানেজমেন্ট, ইকোনমিকস ও ম্যানেজমেন্টে মেজর করা যায়।
গ্রিন ইউনিভার্সিটি: রেগুলার ও এক্সিকিউটিভ, দুটি এমবিএ-ই আছে এখানে। ২০০৩ সাল থেকে এখানে চালু হয়েছে গ্রিন বিজনেস স্কুল। বিবিএর মোট ৪২টি কোর্সে রয়েছে ১২৯ ক্রেডিট।
ইস্ট ওয়েস্ট বিশ্ববিদ্যালয় : এই বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, ম্যানেজমেন্টে মেজর করা যায়।
ইনডিপেনডেন্ট বিশ্ববিদ্যালয় : অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, মার্কেটিং, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, ইন্টারন্যাশনাল বিজনেস, জেনারেল ম্যানেজমেন্ট।
ইউনিভার্সিটি অব লিবারেল আর্টস : অ্যাকাউন্টিং, ইকোনমিকস, ফিন্যান্স, ব্যাংকিং অ্যান্ড ইনস্যুরেন্স, ম্যানেজমেন্ট, মার্কেন্টিং, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম অ্যান্ড ই-বিজনেস, হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট ও এন্টারপ্রেনারশিপ।
উত্তরা বিশ্ববিদ্যালয় : অ্যাকাউন্টিং, ফিন্যান্স, মার্কেন্টিং, ম্যানেজমেন্ট ইনফরমেশন সিস্টেম, ম্যানেজমেন্ট।
এ ছাড়া ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল বিশ্ববিদ্যালয়, ইস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়, স্টামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়, স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়েও কমবেশি একই রকম মেজর করার সুযোগ রয়েছে। সেই সঙ্গে এমবিএ ও এক্সিকিউটিভ এমবিএ তো থাকছেই।