সাক্ষাৎকার : ক্যারিয়ার হিসেবে মিডিয়া অনেক আকর্ষণীয়
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
অধ্যাপক মফিজুর রহমান। একজন গণমাধ্যম বিশেষজ্ঞ। অধ্যাপনার সঙ্গে নিজেকে যুক্ত রেখেছেন ১৯৯৭ সাল থেকে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে যোগ দেন একই বিভাগে প্রভাষক হিসেবে। উচ্চতর শিক্ষা ও ট্রেনিং গ্রহণ করেছেন ইউরোপ ও আমেরিকার বিশ্ববিদ্যালয়ে।কাজপাগল ও তরুণপ্রাণ এ মানুষটি এরই মধ্যে কাজের প্রয়োজনে আমেরিকা, ইউরোপ, জাপান, অস্ট্রেলিয়াসহ অন্তত ২৫টি দেশে ভ্রমণ করেছেন। সদস্য হিসেবে যুক্ত আছেন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনের বেশ কয়েকটি গণমাধ্যম গবেষণা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে। একাডেমিক পড়াশোনার পাশাপাশি দেশের ইলেকট্রনিক, প্রিন্ট ও অনলাইন মাধ্যমের সংবাদ-প্রোগ্রামসহ মিডিয়াতে চাকরির ধরন, যোগ্যতা ও স্বপ্নপূরণের কৌশল নিয়ে কথা বলেছেন এই সাক্ষাৎকারে।
‘চাকরির ক্ষেত্র’ হিসেবে বাংলাদেশের মিডিয়া নিয়ে আপনার মতামত–
- আমি মনে করি, আগের তুলনায় ক্যারিয়ার হিসেবে মিডিয়া এখন অনেক আকর্ষণীয় হয়ে উঠেছে। তরুণদের মধ্যে তো একটা অংশই আছে, যাদের স্বপ্নই হল মিডিয়ার মতো এমন চ্যালেঞ্জিং ক্যারিয়ারে আসা। কেননা এ অঙ্গনে কাজের পরিধি যেমন দিনদিন বাড়ছে তেমনি দেশে গণমাধ্যমের সংখ্যাও প্রতিনিয়ত বাড়ছে। সুযোগ-সুবিধাও বাড়ছে অন্য ক্ষেত্রের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে।
কাজের পরিবেশ বিবেচনায় গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলো কতটা আধুনিক হয়েছে?
- আগে তো সাংবাদিকতা ছিল একটা চ্যারিটির মতো। এখন মিডিয়া অফিসগুলো বেশ আধুনিক, ঝকঝকে। বিজ্ঞাপনের বাজারও অনেক। লক্ষ্য করলে দেখবেন আমাদের মিডিয়া হাউসগুলোও কিন্তু এরই মধ্যে একটি কর্পোরেট লুক নিয়েছে। চাহিদা ও যোগ্যতা অনুযায়ী মিডিয়া সংশ্লিষ্টরা এখন অনেক বেতনও পাচ্ছেন। অনেক প্রিন্ট মিডিয়ায় ওয়েজবোর্ডও অনুসরণ করা হচ্ছে। অন্যদিকে, গণমাধ্যমে যারা কাজ করেন তাদের ব্যাপক পরিচিতি ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। একটা ভালো স্ট্যাটাস দাঁড়িয়ে গেছে। পুরুষের পাশাপাশি অনেক নারীও বেশ সুনামের সঙ্গে এ পেশায় কাজ করছেন। আমি তো বলব অন্য আট-দশটা পেশার চেয়ে এখন মিডিয়ায় নারীদের উপস্থিতি আরও সরব। তাই এ কথা সহজেই বলা যায়, মিডিয়ায় কাজের পরিবেশ এখন যথেষ্ট উন্নত। তবে আরও উন্নত হওয়ার সুযোগ আছে।
তারপরও দেখা যায়, অনেকেই এখনও মিডিয়াকে স্থায়ী পেশা হিসেবে নিতে অনীহা প্রকাশ করেন আবার যারা আসেন তাদের অনেকেই একটা সময় পর চলে যেতে বাধ্য হন; কেন এমনটা ঘটছে?
- দেখুন, আমাদের দেশে গণমাধ্যমের বয়স কিন্তু খুব একটা বেশিদিনের না। বেসরকারি টিভির কথা ধরলে ২০০০ সালের কাছাকাছি সময়কে আমরা ধরতে পারি। সে হিসেবে ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিস্তার কেবল হতে শুরু করেছে। তবে আমার মতে, এ স্বল্প সময়ের মধ্যেই মিডিয়া কিন্তু একটা শক্ত ভিতে দাঁড়িয়েছি সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। যদিও মালিক পক্ষের সহযোগিতা থাকলে গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানগুলোকে আরও প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে পারবে বলে আমার বিশ্বাস। অনেকের কাছে আবার চাকরির স্থায়িত্বের বিষয়টি গুরুত্বপূর্ণ তাই অন্য চাকরিতে চলে যান।
মিডিয়ায় যারা সাংবাদিকতা, কমিউনিকেশন্স, ফিল্ম বা টেলিভিশন স্টাডিজে একাডেমিক জ্ঞান নিয়ে আসছেন অথবা যারা অন্য ব্যাকগ্রাউন্ড থেকে আসেন বা আসছেন; এ দু’পক্ষের কর্মপরিধি–দক্ষতা–যোগ্যতা নিয়ে আপনার মন্তব্য?
- অবশ্য যারা একাডেমিক জ্ঞান নিয়ে এ লাইনে আসবেন তারা এগিয়ে থাকবেন এটাই স্বাভাবিক। তবে এটা যেহেতু একটি চ্যালেঞ্জিং ও ক্রিয়েটিভ লাইন; সুতরাং এখানে সবারই কাজের সুযোগ আছে। আর একটি কথা, মিডিয়ায় কিন্তু কাজের ক্ষেত্র ও বিভাগ অনেক। তাই অন্যান্য বিষয়ের গ্রাজুয়েটদেরও কাজের যথেষ্ট সুযোগ আছে।
নতুন যারা মিডিয়ায় আসতে চান তাদের জন্য আপনার পরামর্শ–
- প্রথমেই মনে রাখতে হবে মিডিয়া একটা চ্যালেঞ্জিং, আধুনিক ও সৃজনশীল পেশা। এখানে কাজ করতে হলে তাকে সব সময় মনেপ্রাণে তরুণ থাকতে হবে। নিজেকে সময়ের সঙ্গে আপডেট রাখতে হবে। আর অবশ্যই মিডিয়াবিষয়ক সাধারণ বিষয়গুলো আয়ত্তে নিতে হবে। একইসঙ্গে গণমাধ্যম সংশ্লিষ্ট পরিভাষা ও সাংবাদিকতার নতুন নতুন ধরন সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা এবং আশপাশে যা ঘটছে সে বিষয়েও জানার পরিধিটা বাড়াতে হবে এবং প্রতিনিয়ত ভিন্ন ও নতুন কিছু করার আগ্রহ থাকতে হবে।
মিডিয়ার সংখ্যা বাড়লেও মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে; আপনার কী মনে হয়– এটা কি যোগ্য লোকের অভাবের কারণ?
- হ্যাঁ, ঠিক বলেছেন; মিডিয়ার সংখ্যা বাড়লেও মান নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যাচ্ছে। আমাদের দেশ অনুযায়ী এতগুলো চ্যানেল দরকার আছে কি’না সেটা অন্য আলোচনার বিষয়। তবে মিডিয়ায় অনেক যোগ্য লোক থাকলেও চাহিদা অনুযায়ী সংখ্যাটা যে পর্যাপ্ত নয়, এটা আপনি-আমি সবাই বুঝতে পারি। একইসঙ্গে মিডিয়ার মালিকপক্ষ নিজের মিডিয়া প্রতিষ্ঠান কীভাবে চালাতে চাচ্ছেন সেটিও কিন্তু কাঙ্ক্ষিত মান সৃষ্টিতে অনেক সময় বাধা হয়ে দাঁড়ায়।
মান ঠিক রাখতে কী পদক্ষেপ নেয়া উচিত?
- ইনহাউজ প্রশিক্ষণের আয়োজন করা, প্রত্যেকটা প্রতিষ্ঠানের নিয়োগ বিভাগের আরও দায়িত্বশীল ভূমিকা নিয়ে লোকবল নিয়োগ করা, মিডিয়া সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান যেমন প্রেস ইন্সটিটিউট ও অন্যান্য গণমাধ্যম শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিত্যনতুন কোর্স চালু করা, তথ্য মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতার মনোভাবসহ সাংবাদিকতায় যেসব নিত্যনতুন বিষয় যোগ হচ্ছে সেগুলো নিয়ে সেমিনার বা প্রশিক্ষণের আয়োজন করা। তবে আমি নির্দিষ্ট সময় পরপর ইনহাউজ ট্রেনিংকে বেশি গুরুত্ব দেব।
প্রিন্ট মিডিয়ায় বিশেষ করে বাংলা বানানে একেক পত্রিকা একেকভাবে লেখে, অন্যদিকে ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় ভাষা বিকৃতি রোধে কী পদক্ষেপ জরুরি?
- সত্যি বলতে কী একজন গণমাধ্যম বিশ্লেষক হিসেবে আমাদের কিন্তু এ দুটো বিষয় খুবই পীড়া দেয়। এজন্য বাংলা একাডেমিকে জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। কেননা, একটি দেশে একটি মাত্রই বানানরীতি থাকা উচিত। আর উচ্চারণের জন্য বলব, যিনি কাজ করছেন তার যেমন নজর দেয়া জরুরি তেমন প্রত্যেকটি প্রতিষ্ঠানেরও উচিত বিষয়টিতে তীক্ষ্ণ নজর রাখা। আমার জানা মতে, বড় কাগজগুলো বাংলা একাডেমির বানান রীতি অনুসরণ করে।
নৈতিকতা–মানবিকতা বনাম সাংবাদিকতা নিয়ে আপনার ভাবনা–
- সাংবাদিকতায় এ তর্কটি বহুদিনের। তবে পেশাদারিত্বের সঙ্গে যতটুকু মানবিক আচরণ করা যায় ততটা আমরা আশা করতেই পারি। তবে নৈতিকতাকে সর্বদা গুরুত্ব দিতে হবে। সংবাদে যেন কোনো মনগড়া তথ্য না থাকে এবং সংবাদ সংশ্লিষ্ট প্রোগ্রামে যেন ভুলভাল বা নিজেদের মতো করে কোনোকিছু দেখানো বা উপস্থাপন করা না হয় অন্তত এ বিষয়ে কোনো ছাড় দেয়া ঠিক হবে না।
স্যার, পেশাদারিত্বের জায়গার কারণে মানবিকতা প্রশ্নটি না হয় বাদ দিলাম, কিন্তু দেখা যায় প্রতিযোগিতা করতে গিয়ে অনেক সাংবাদিকই যেমন ফায়ার সার্ভিসের কোনো এক কর্মী আগুন নিভাচ্ছেন ওই সময় তাকে কথা বলতে বাধ্য করা হয়–
- না এমনটা কখনোই কাম্য নয়। এমনকি আমি অনেক সময় দেখি, যে বিষয়ে যার বা যে পরিস্থিতিতে যাকে কথা বলানো উচিত না তাদের প্রশ্ন করা হচ্ছে। মনে রাখতে হবে আপনার কোনো প্রশ্ন, ছবি বা লেখা যেন অন্য পেশা, কাজ, শ্রেণী বা বয়সকে বিকৃতভাবে উপস্থাপন না করে। এবং কোনোমতেই কারও কাজকে বাধাগ্রস্ত না করে। হ্যাঁ, সাংবাদিক অবশ্যই চাইবেন কত এক্সক্লুসিভ তথ্য দেয়া যায়; কিন্তু তার মানে অন্যের ব্যক্তিগত স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ করে নয়।
গত কয়েক বছর থেকে দেখা যাচ্ছে গান–আবৃত্তি–নাটক–চলচ্চিত্র ও উপস্থাপনায় রিয়েলিটি শো–এর নামে শিল্পী খোঁজার চেষ্টা করা হয় (বিশেষ করে টেলিভিশন মিডিয়ায়); কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই দেখা যায় কয়েক বছর যেতে না যেতেই অনেকেই হারিয়ে যান, এ বিষয়ে আপনার মত–
- প্রথমত প্রশ্ন হল, উঠিয়ে আনা কেন? ক্রিয়েটিভ লাইনে যিনি আসতে চাইবেন তিনি নিজের যোগ্যতায় উঠে আসবেন। তারপরও বলি এমন রিয়েলিটি শো’র আমি বিরুদ্ধ না। বিদেশে কিন্তু এমন প্রতিযোগিতার মাধ্যমে যারা উঠে আসে দেখা যায় কালক্রমে তারাই ওই দেশের মিডিয়ার বিভিন্ন অঙ্গন যেমন নাচ-গান-চলচ্চিত্র-নাটক-ডকুমেন্টারি বা প্রোগ্রামে সবচেয়ে ভালো করছে। তবে আমাদের দেশে উঠিয়ে আনা এবং তাদের ধরে রাখায় পদ্ধতিগত বিষয়গুলো খতিয়ে দেখতে হবে। তাই যারা উঠিয়ে আনেন আর যারা উঠে আসবেন তাদের প্রত্যেকেরই প্রতিনিয়ত প্রাকটিস ও শিক্ষার বিষয়টিতে নজর রাখতে হবে। একটা কথা মনে রাখবেন, কাউকে উঠিয়ে এনে সফল বানানো যায় না, আর ক্রিয়েটিভ লাইনে তো নয়ই। বরং যার মেধা আছে তাকে সুযোগ করে দিতে হবে।
আপনার কাছে সফলতা মানে কী?
- ভালো মানুষ হওয়া।