ডিজিটাল মার্কেটিং: ক্যারিয়ার গড়ুন
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
ফেস বুকিং করেও আয় করা যায়। ব্যবসা-বাণিজ্য বা চাকরির অফুরন্ত সুযোগ রয়েছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে। কিন্তু এ বিষয়ে অনেকেরই সঠিক ধারণা নেই। বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যবসায়িক প্রচারণা নিয়ে কাজ করছেন রেড রকেটের হেড অব ডিজিটাল আরিফুল বাশার। তিনি এ খাতে চাকরি ও ব্যবসায়িক সম্ভাবনা নিয়ে কথা বলেছেন দৈনিক যুগান্তরের সঙ্গে।
আরিফুল বাশার : মার্কেটিং নিয়ে আমাদের গ্রাজুয়েশন লেভেলে যেসব বই পড়ানো হতো সেগুলো সব দেশের বাইরের ছিল। তার সঙ্গে বাংলাদেশের বাস্তবতা ভিন্নতা ছিল। মার্কেটিংয়ের ওইসব বিদেশী সাহিত্যের ৮০ শতাংশ তত্ত্ব বাংলাদেশে কাজ করে না। কারণ বাংলাদেশের গ্রাহক-দর্শক আলাদা। বাংলাদেশের ৯০ শতাংশ মানুষ সংবাদপত্র পড়ে না। অথচ বাংলাদেশের প্রধান সংবাদপত্রগুলো কিন্তু অঞ্চল ভেদে শহুরে সমাজে চলে। কিন্তু শহরে আরও কত মানুষই বাস করে। মোট জনসংখ্যার ৫ শতাংশ। সুতরাং আমরা কখনোই বাকি ৯৫ শতাংশ মানুষের কাছে পৌঁছাতে পারিনি। কেননা তাদের কাছে
রেড রকেটে ডিজিটাল মার্কেটিং শুরু হয়েছে কবে থেকে?
আরিফুল বাশার : রেড রকেট প্রতিষ্ঠার প্রাক্কালেই ডিজিটাল মার্কেটিং শুরু করি। ২০১৩ সালের নভেম্বরে আমরা কাজ শুরু করি। ফেসবুকের মাধ্যমে টি-শার্ট বিক্রি করে প্রতি মাসে ৩ থেকে ৪ লাখ টাকা আয় করছে ১৮ থেকে ২৬ বছর বয়সী তরুণ ব্যবসায়ীরা। এরা ফেসবুক মার্কেটিংয়ের শুরুতে এ ব্যবসা শুরু করেছিল। ১০০ টাকায় টি-শার্ট কিনে আর শ’খানেক টাকায় ডিজাইন করে খুব সহজে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকায় টি-শার্ট বিক্রি করছে এরা।
প্রতি টি-শার্টে এদের ২০০ টাকা লাভ হচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া শিক্ষার্থীরাই শুধু ফেসবুকে প্রচারণা চালিয়ে এত টাকা আয় করছে। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের মূল কথা হল লক্ষ্যে ঠিক থাকা। প্রথমদিকে আমরা যখন ব্যবসা শুরু করেছিলাম কেউ আমাদের পাত্তা দেয়নি। ক্লায়েন্টদের আকর্ষণ করার জন্য সরাসরি প্রভাব ফেলতে পারিনি আমরা। আসলে সরাসরি প্রভাব ফেলাও যায় না। ২০১২ সালের দিকে আমরা জোড়াতালি লাগাতাম। জোড়াতালি বলতে, আমরা বলতাম, সংবাদপত্রের এ বিজ্ঞাপনই ফেসবুকে উপস্থাপন করব আমরা। কিন্তু ফেসবুকে আপনাকে অতিরিক্ত টাকা ঢালতে হবে। তখন অ্যাপ্লিকেশন চার্জ আমরা নিতাম না। ফেসবুকের তখনকার অ্যাডমিনরা বুঝল, ফেসবুকে কোনো পণ্যের মার্কেটিং কেমন হল তা দেখা যায়। এখানে লুকানোর কিছু নেই। ক্লিক করলেই আমরা দেখতে পাবে সে পোস্টটা কতটা মানুষের কাছে পৌঁছাতে পেরেছে। সুতরাং এটি এতটাই স্বচ্ছ যে, এখানে গোপনীয়তার কোনো অবকাশ নেই। এটি দেখার পরপরই প্রতিষ্ঠানগুলো মজা পেয়ে গেল। কোনো ব্রান্ড একবার ফেসবুক মার্কেটিংয়ে মজা পেয়ে গেলে ওই প্রতিষ্ঠানটির পরবর্তী মার্কেটিং পরিকল্পনার ফেসবুককে রাখবেই।
ফেসবুক মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে আপনাদের দায়িত্বটা কী?
আরিফুল বাশার : আমরা কন্টেন্ট বানাই। তাদের অ্যাডভার্টাইজিং সল্যুশন দিচ্ছি, প্রচারণা চালাচ্ছি। কারণ কতগুলো ব্রান্ড আছে যাদের ফেসবুকীয় প্রশ্নোত্তর ম্যানেজ করা উচিত নয়। কারণ সহজ.কমের মতো ব্রান্ডের ফেসবুকীয় প্রশ্নোত্তরে অনেক বিস্তারিত উত্তর দেয়া লাগে। কেউ প্রশ্ন করল রংপুরের কখন গাড়ি পাওয়া যাবে, সিট ভাড়া কত ইত্যাদি। এগুলো ওই প্রতিষ্ঠান নিজ দায়িত্বে ভালো সামলাতে পারবে। এ তথ্যগুলো কোনো এজেন্সি দিতে পারবে না। আর দিলেও হয়তো এজেন্সিটি একটু বেশি টাকা কামাবে। কিন্তু কিছু টাকার জন্য সময়ের অপচয় হবে বেশি। তাই ব্রান্ডিংটাকে মূলত আমরা ফোকাস করি। এলিট মোবাইলের ক্ষেত্রে যদি বলি, ফোনটির ব্রান্ডিং হয়েছে মূলত ফেসবুকের কারণে। এফ কমার্সের (ফেসবুক কমার্স) ক্ষেত্রে একটা শাখা আছে যারা শুধু বেচা-বিক্রি করে, আরেকটা আছে ব্রান্ডিংয়ের জন্য এবং আরেকটা আছে পর্যবেক্ষণ করার জন্য। বাংলাদেশে ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ৮০ শতাংশ ফেসবুকে হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান খরচ বহন করতে পারে তাদের বিভিন্ন বিজ্ঞাপন যাচ্ছে অনলাইন নিউজ পোর্টালে। সাধারণত বড় প্রতিষ্ঠানই অনলাইন নিউজ পোর্টালে বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। এটা ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ১৫ শতাংশ।
আপনাদের অনেক প্রতিযোগী সংস্থা আছে। ক্লায়েন্টরা তাদের কাছে না গিয়ে আপনাদের কাছে কেন আসবে?
আরিফুল বাশার : আমাদের খিদা বেশি; কিন্তু টাকা নেই। একটা বিজ্ঞাপন এজেন্সিগুলো ১০ থেকে ১৫ বছর গেলেই অনেক স্থিতিশীল হয়ে যায়। তাদের অনেক ধরনের লিয়াজুঁ তৈরি হয়। মিডিয়া, ক্লায়েন্ট সবার সঙ্গেই একটা ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে। সেক্ষেত্রে মার্কেটিং খাতে ওইসব পুরনো এজেন্সি খুব স্বাচ্ছন্দ্যে কাজ করতে পারে। কিন্তু নিউ মিডিয়ার এ ব্যাপারগুলোতে তারা অতটা ওয়াকিবহাল নয়। তারা ওই টিভি বিজ্ঞাপন, সংবাদপত্রের ক্ষেত্রেই অনেক বেশি অভিজ্ঞ। সুতরাং ডিজিটাল মার্কেটিং তথা ফেসবুক কমার্সে বিজ্ঞাপন দেয়ার ক্ষেত্রে আমাদের মতো নতুন এজেন্সিগুলোরই দরকার পড়বে ক্লায়েন্টদের। আমাদের দেশের প্রথিতযশা বিজ্ঞাপন এজেন্সিগুলো কিন্তু অনলাইনে পারদর্শী নয়। কারণ তারা তো এটা দিয়ে শুরুই করেনি। এখন শুরু না করে হয়তো তারা নতুন একটা ডিপার্টমেন্ট খুলতেছে। ওই ডিপার্টমেন্টে যাদের নিয়োগ দেয়া হয়েছে তাদের যে ফেসবুক বা অনলাইন কমার্স সম্বন্ধে ভালো ধারণা আছে তা বলা যাবে না। দেখা যায় তাদের বেশিরভাগ অন্য অ্যাড এজেন্সির ব্রান্ড ম্যানেজার ছিল। আর আমাদের কাছে আসার বড় কারণ হল, আমরা শুরুই করছি এটা দিয়ে।
আপনার বাজেটিং কীভাবে করেন?
আরিফুল বাশার : আমরা ফেসবুকের অ্যাড ম্যানেজার ব্যবহার করি না। আমরা এখান থেকে ফেসবুক পোস্ট বুস্ট করি না। কারণ হচ্ছে, এখান থেকে মাইলেজটা আসে না। আমরা জটিল প্রক্রিয়া ব্যবহার করে থাকি। এটাকে বলে পাওয়ার এডিটর। আর তা হলে পণ্যের নির্দিষ্ট দর্শকের কাছে পৌঁছাতে পারি আমরা। এই ধরুন, স্যামসাং গ্যালাক্সি সিরিজের নির্দিষ্ট মডেলের গ্রাহকদের কাছেই শুধু বিজ্ঞাপন পৌঁছে দিতে পারি আমরা। আবার ধরুন, আইফোনের আপডেটেড আইওএস ব্যবহারকারীদের কাছেই শুধু বিজ্ঞাপনটি যাবে এটারও ব্যবস্থা করতে পারি আমরা। এত ডিটেইলে আমরা ফেসবুকে পোস্ট করতে পারি। আমরা একটা নির্দিষ্ট এলাকা ধরেও প্রচারণা করতে পারব। অর্থাৎ, শুধু ওই এলাকার লোকই বিজ্ঞাপনটি পাবে, তাছাড়া বাংলাদেশের আর কেউ দেখতে পাবে না। এই দেখুন, গুলশান ক্লাবে একটা প্রোগ্রাম হবে। আমরা এমনভাবে বিজ্ঞাপনটি পোস্ট করেছি যে এটা গুলশানের তিন মাইলের মধ্যকার মানুষের কাছে পৌঁছাবে। তাছাড়া আর কেউ দেখতে পাবে না। বাজেটিং নির্ভর করে ক্লায়েন্টের ওপর। আমরা বিজ্ঞাপন নির্মাতারা যত বেশি বাজেট পাব তত আমার সুবিধা। কারণ এটা অনেকটা অংকের মতো। আমি যদি ফেসবুককে বলি এই নাও ১০০ ডলার, ফেসবুক আমার বিজ্ঞাপন ২০ হাজার মানুষের কাছে পৌঁছে দেবে। আবার আমি যদি ফেসবুকে ৫০০ ডলার বিনিয়োগ করি, তবে ফেসবুক আমার পোস্টটি ১ লাখ মানুষের কাছে দেখাবে। এভাবেই দর্শকের কাছে পোস্টের বিশ্বায়ন হয়। কিন্তু আমরা কিছু টিউটোরিয়াল জানি যার মাধ্যমে ফেসবুকে ৫০০ জনের কাছে পৌঁছানো পোস্টটিকে ৫ হাজার জনে নিয়ে যেতে পারি। তখন আমরা ক্লায়েন্টদের এভাবে প্রভাবিত করি। ক্লায়েন্ট কেন আমাদের কাছে আসবে এটাই তার সবচেয়ে বড় উত্তর।
কাজ চলা অবস্থায় সাধারণ সমস্যাগুলো কী থাকে?
আরিফুল বাশার : ব্রান্ডের ক্ষেত্রে সাধারণ সমস্যা হল প্রতিষ্ঠানগুলো অতটা খোলামেলাভাবে বাজেট বরাদ্দ দেয় না। সংবাদপত্র বা টিভিতে লাখ লাখ টাকার বিজ্ঞাপন দিলেও ডিজিটাল মার্কেটিংয়ের ক্ষেত্রে যদি ১ লাখ টাকাও বরাদ্দ দেয়া হয় তাতে তারা সন্দেহ পোষণ করে। তারা মনে করে এখান থেকে চুরি হয়। এই প্লাটফর্ম সম্বন্ধে অজ্ঞতার কারণেই সাধারণত এটা হয়। তবে এক মাস যাওয়ার পর রিপোর্ট হাতে পেলে তাদের এই ভুল ভাঙে। যখন তারা দেখে এতে কোনো ফাঁকফোকর নেই তখন থেকে তারা আর কোনো আপত্তি করে না। প্রাণের তিনটি পণ্যের প্রচারণা চালাচ্ছি আমরা। প্রাণ এখন ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে অনেক এগিয়ে। ব্লাক হর্স, টাইগার এগুলোও সোশ্যাল মিডিয়ায় অনেক সক্রিয়। প্রতিষ্ঠানগুলোর বোঝা উচিত, এই সোশ্যাল মিডিয়ার যুগে সবাইকে পণ্য প্রচারণার জন্য এই প্লাটফর্মে আসতে হবে। এর চেয়ে সস্তা এবং পরিষ্কার প্রচারণা তো আর হয় না।
বাংলাদেশে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবসায় ক্যারিয়ার কেমন? অর্থাৎ, কেউ যদি ভাবে সোশ্যাল মিডিয়ায় পণ্য প্রচারণার ব্যবসা করবে সেক্ষেত্রে এই ক্ষেত্রটা কেমন?
আরিফুল বাশার : একজন উদ্যোক্তা যদি তরমুজ বিক্রি করতে চায়, তবে তার এখন একটি ফেসবুক পেজ ও বিজ্ঞাপনের দরকার পড়বে। ব্যাস, এভাবেই তরমুজের ব্যবসা করতে পারবে সে। পরিবহন ব্যবস্থা ঠিক থাকলেই ভালো ব্যবসা করতে পারবে সে। ফেসবুকে পে করাটা কিছুটা জটিল। কারণ সেক্ষেত্রে ক্রেডিট কার্ড দরকার পড়ে। এটাই বাধা। গত বছর ডিজিটাল মিডিয়াতে আমরা কোটি টাকার মতো কাজ করেছি। এই মিডিয়াটি এখন সম্ভাবনাময়।
আপনার টিমে কতজন লোক আছে?
আরিফুল বাশার : টিমটা আমরা ওভাবে ভাগ করি না। আমাদের পুরো এজেন্সি মিলে ৩৫ জনের টিম। এই ৩৫ জনই প্রতি মিডিয়াতে কাজ করছে। আপাত দৃষ্টিতে যদি ভাগই করেন তবে প্রতি টিমে ৮ থেকে ১০ জন সদস্য আছে।
টিমে কার কী কাজ থাকে?
আরিফুল বাশার : এজেন্সি কাঠামো যেমন থাকে ওরকমই। আমার এখানে ক্লায়েন্ট রিলেশনশিপ ম্যানেজ করার জন্য একজন কর্মী আছে। সে এসে আমার ক্রিয়েটিভ টিমে সব দাবি জানায়। দাবি অনুযায়ী তিনজন সেই কাজ সম্পর্ণ করে তাকে। আর একজন থাকে অ্যাকাউন্টসে। আপনার ক্রিয়েটিভ টিমে যদি দুজন, অ্যাকাউন্টসে একজন এবং ক্লায়েন্টদের সঙ্গে রিলেশনশিপে একজন থাকে তবে একটি এজেন্সি খোলা সম্ভব। চারজন, একটা রুম আর পরিকল্পনা এ দিয়েই মাসে মাসে লাখ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
কেউ যদি এফ কমার্সে থিতু হতে চায় সেক্ষেত্রে আপনার পরামর্শ কী থাকবে?
আরিফুল বাশার : প্রথম পরামর্শ থাকবে পড়ে থাকা। ফেসবুক এখন খুব অভিজ্ঞ প্লাটফর্ম। ইউটিউবে ভিডিও দেখে অভিজ্ঞতা অর্জন করতে পারে সে। ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে পরিকল্পনা তৈরির অনেক ভিডিও আছে ইউটিউবে। ইউটিউবে ভিডিও দেখে পরবর্তীতে কোনো পরিচিত ব্যবসায়ীকে যদি সে রাজি করাতে পারে, আমি তোমার ফেসবুক পেজ খুলে প্রচারণা চালাব; তাহলে ওই ব্যবসা চলবে। সে শুধু তার সার্ভিসটাকে বেচবে। পরিচিত মানুষটার কাছে সে প্রাথমিকভাবে কিছু টাকা চার্জ করতে পারে।
ডিজিটাল মার্কেটিংয়ে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ কী?
আরিফুল বাশার : বিশ্বের শীর্ষ তিন ধনকুবের বিল গেটস, ল্যারি পেইজ এবং জাকারবার্গ। এরা তিনজনই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা। তারা ডটকমকে ব্যবহার করে বড়লোক হয়েছে। এখান থেকেই বোঝা যায় এর ভবিষ্যৎ। অনলাইন প্রাথমিক মিডিয়া হিসেবে একসময় পরিগণিত হবে। তখন টিভি সেকেন্ডোরি মিডিয়া হয়ে যাবে। টিভি সেকেন্ডারি হয়ে গেলে অনলাইন প্লাটফর্মে ফোকাস আসবে। কারণ এখনকার প্রজন্ম যখন বড় পর্যায়ে যাবে তখন এই মিডিয়া গুরুত্ব পাবে।