যেভাবে ইন্টারভিউ নেবেন
- ক্যারিয়ার ডেস্ক
সবারই একটা কৌতূহল আছে যে, কি হয় ইন্টারভিউ রুমে তা জানার। আপনারও কী জানতে ইচ্ছে করছে? এ লেখায় থাকছে বিস্তারিত।
লিখিত পরীক্ষা : একটি খালি পদের জন্য যখন ৫০ থেকে ১০০ বা তার চেয়েও বেশি আবেদন পড়ে তখন মেধা যাচাইয়ের জন্য অনেক কোম্পানি লিখিত পরীক্ষার আয়োজন করে। লিখিত পরীক্ষাগুলোতে আপনি যে পদের জন্য আবেদন করেছেন ওই পদের কাজের সঙ্গে সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন থাকবে। এরপর প্রশ্ন থাকবে কিছু সাধারণ জ্ঞান, কিছু অনুবাদ। উপস্থিত বুদ্ধি পরীক্ষার জন্য থাকবে কিছু প্রশ্ন। একেক কোম্পানির প্রশ্ন ও নম্বর বণ্টনের ধরন একেক রকম।
মৌখিক পরীক্ষা : লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণদের ডাকা হয় মৌখিক পরীক্ষায়। মৌখিক পরীক্ষা নানাভাবে হতে পারে। ধরুন, ১০০ জনের মধ্য থেকে ৮ জনকে ইন্টারভিউ দিতে ডাকা হয়েছে। চলুন দেখি কি কি হতে পারে এখানে :
১। ৮ জনকে হয়তো দুইটি দলে ভাগ করে দেয়া হল। তাদের কোনো একটা বিষয়ে তর্ক করতে বলা হল। তর্কের বিষয় অনেক রকম হতে পারে। যেমন ধরুন, ‘স্মার্ট ওয়ার্ক ও হার্ড ওয়ার্ক’, ‘জীবনে টাকা ও সম্মানের গুরুত্ব’ ইত্যাদি যে কোনো বিষয় হতে পারে। বিশেষ করে বিক্রয়, কাস্টমার কেয়ার, সাপ্লাই চেইন এমনকি উৎপাদন বিভাগে লোক নিয়োগের ক্ষেত্রেও তর্কের আয়োজন করা হয়। প্রশ্ন হতে পারে, কেন এই তর্কযুদ্ধ? আসলে এই তর্কের মাধ্যমে যাচাই করা হয়, আপনি আসলে নির্দিষ্ট বিষয়ে কতটা ফোকাস করে কথা বলতে পারেন ও আপনি কতটা যুক্তিবাদী। দেখা হয় আপনি গঠনমূলক সমালোচনা করতে পারেন কি না।
২। যে কোনো ঘটনার ওপর আপনাকে উপস্থিত বক্তৃতা দিতে হতে পারে। যেমন ধরুন, মেট্রোরেল, ফ্লাইওভার, বইমেলা, প্রিয় মুভি, প্রিয় নেতা ইত্যাদি। আপনাকে যে বিষয় দেয়া হবে সেটা আপনি কতটা সাবলীলভাবে উপস্থাপন করতে পারবেন সেটা বিচার করা হয় এখানে। অনেক ক্ষেত্রে এখানে নম্বর দেয়ার কাজটা করে বাকি ক্যান্ডিডেটরা।
৩। আপনাকে বলা হতে পারে কোনো একটি পেপারের অংশবিশেষ দিয়ে সেটি বাংলায় অনুবাদ করতে। পরবর্তী সময় বলা হতে পারে সেটা বাংলা ও ইংরেজিতে টাইপ করতে। আপনার অনুবাদের দক্ষতা ও টাইপ স্পিড দুই জানা হয়ে গেল এই টেস্টের মাধ্যমে। ভালো কোম্পানি ভালো পোস্টের জন্য শুধু টাইপ স্পিড বা অনুবাদের দক্ষতাই যাচাই করে না, তারা অনেক সময় এক্সেলেরও ছোটখাটো সমস্যা সমাধান করতে বলে।
৪। আধা ঘণ্টার প্রেজেন্টেশন তৈরি করতে বলাটা বেশ কমন হয়ে যাচ্ছে আজ-কাল। একটি নির্দিষ্ট বিষয় দিয়ে দেয়া হয়। কখনও গ্রুপে, কখনও বা এককভাবে তৈরি করতে হয় প্রেজেন্টেশন। সেখানে বিচার করা হয় আপনি টিমে কতটা কাজ করতে পারেন, আপনি কতটা লিড নিতে পারেন। আর সবশেষে যাচাই করা হয় আপনার প্রেজেন্টেশন স্কিল। পাওয়ার পয়েন্টে কাজ পারেন কি না সেটাও রিক্রুইটার এখান থেকেই যাচাই করতে পারেন। তাই যারা ল্যাবে ফাঁকি দেন, অ্যাসাইনমেন্ট আরেকজনেরটা কপি করেন তারা সাবধান। একদিন কিন্তু ঠিকই ধরা খেয়ে যাবেন।
৫। উপস্থিত বুদ্ধি যাচাই প্রায় সব বহুজাতিক কোম্পানিতেই করা হয়। ‘আপনি জঙ্গলে যাবেন, কোন জিনিসটি সঙ্গে নিবেন?’ ‘আপনাকে এক মাস ছুটি দিলে কি করবেন?’ ‘এক কোটি টাকা পেলে কি করবেন?’- এরকম প্রশ্ন করা হবে আপনাকে। উত্তর ভেবে-চিন্তে দিতে হয় এ সব ক্ষেত্রে। আপনি হয়তো বললেন বনে টর্চ লাইট নিয়ে যাবেন। তাহলে খাবেন কি? ব্যাটারি শেষ হয়ে গেলেই বা কি করবেন? আপনি বললেন আপনি বই নিয়ে যাবেন। তাহলে আত্মরক্ষা করবেন কিভাবে? এই ধরনের প্রশ্ন করে যাচাই করা হয় আপনার দূরদৃষ্টি। চাকু হতে পারে একটি সঠিক উত্তর। আত্মরক্ষা হবে, খাবারও খাওয়া যাবে। আগুন আরেকটি ভালো উত্তর হতে পারে। উপস্থিত বুদ্ধি যাচাই করার জন্য অনেক সময় ধাঁধা দেয়া হয়।
৬। অনেক ক্ষেত্রে কেস দেয়া হয়। একটি নির্দিষ্ট অবস্থার কথা বলা হয়। এরপর কিছু প্রশ্ন দেয়া হয়। সেগুলোর উত্তর করতে হয়।
৭। পার্সোনালিটি টেস্ট এখন খুবই কমন হয়ে গেছে। আপনি মানুষ হিসেবে কেমন? আত্মকেন্দ্রিক নাকি মিশুক, আপনি কি চিন্তা করে সিদ্ধান্ত নেন নাকি আবেগ দিয়ে সিদ্ধান্ত নেন, আপনি কিভাবে তথ্য সংগ্রহ করেন, লোকজনের সঙ্গে কিভাবে মিশেন সেগুলো বের করার জন্য টেস্ট আছে কিছু। এগুলোকে বলে সাইকোমেট্রিক টেস্ট। আপনাকে কিছু বিবৃতি বা লাইন দেয়া হবে। আপনাকে হয়তো হ্যাঁ অথবা না বলতে হবে। খুব সোজা এই টেস্ট। আপনি টেরই পাবেন না কখন আপনি মানুষ হিসেবে কেমন সেটার পরীক্ষা হয়ে গেল। এই টেস্টের মাধ্যমে জানা যাবে আপনি একজন বিক্রয়কর্মী হিসেবে কেমন, আপনি লিডার হিসেবে কেমন, আপনি টিমে কেমন কাজ করবেন। এ ধরনের পরীক্ষাগুলো অনেক রিসার্চের ফল। তাই চাইলেও ফলাফল অগ্রাহ্যের সুযোগ নেই।
৮। মূল্যবোধের পরীক্ষা, ভালো ও মন্দের পার্থক্য আপনি কিভাবে করেন এবার হবে সেই পরীক্ষা। বিভিন্ন অবস্থায় আপনি কি সিদ্ধান্ত নিতেন জানতে চাওয়া হবে। আপনি উত্তর করলেই বেরিয়ে আসবে আপনার মূল্যবোধ কি ধরনের।
৯। আপনার পূর্ববর্তী চাকরির রেকর্ড ও কাজের ধরন চেক করা হতে পারে। এ ক্ষেত্রে প্রশ্ন করা হয় অথবা ডকুমেন্ট টেস্ট করা হয়। পে স্লিপ, অব্যাহতিপত্র, অর্থ সংক্রান্ত নিষ্পত্তিনামা চেক করা হতে পারে। সার্টিফিকেটের মেইন কপি কাউকে দিবেন না। এটা বাংলাদেশের শ্রম আইন অনুযায়ী অবৈধ।
১০। আপনার রেফারেন্স চেক হতে পারে। তাই যাদের সিভিতে রেফারেন্স রেখেছেন, তারা যেন আপনার সম্পর্কে সত্য তথ্য দেন সেই ব্যাপারে তাদের জানিয়ে রাখুন। আত্মীয়-স্বজনদের রেফারেন্স রাখবেন না। আপনার শিক্ষক ও কর্মক্ষেত্রে বস অথবা কলিগদের রেফারেন্স রাখতে পারেন।
এভাবে ধাপে ধাপে আপনাকে যাচাই করা হয়। এই কাজগুলো করতে পুরো একদিন সময় লেগে যায়। এ সব ধাপ যদি আপনি উত্তরণ করতে পারেন তা হলেই, আপনি ফেস করবেন ইন্টারভিউ বোর্ড।
ভালো কোম্পানিগুলো অনেক যাচাই-বাছাই করে সর্বোত্তম লোকটিকেই বেছে নেয়। তাই ওই সব কোম্পানির লোকদের চাকরি ছাড়ার প্রবণতাও অনেক কম। মানবসম্পদ বিভাগের লোকেরা তাই অল্পসংখ্যক ক্যান্ডিডেটের ইন্টারভিউ অনেক সময় লাগিয়ে নেন। এদের সিভি বাছাই থেকে শুরু করে প্রতিটি কাজই নিখুঁত।
ইন্টারভিউ টিপস :
১। ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় পোশাকের প্রতি লক্ষ্য রাখুন। ছেলেরা চুল এলোমেলো রাখবেন না, শেভ করে যাবেন। কাপড়-চোপর পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হতে হবে। পোশাক আপনার রুচিবোধের প্রকাশ ঘটায়। কানে দুল, ব্রেসলেট ছেলেদের পোশাক নয়। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে এগুলো পরে যাবেন না। মেয়েরাও মার্জিত পোশাকে যাবেন। ঝাঁজালো গন্ধের বডি স্প্রে বা সেন্ট মাখাবেন না। সব ক্ষেত্রে রুচিশীল হোন। ফ্রেশার যারা আছেন তারা অনেক সময় ছাত্রদের মতো পোশাক পরেই ইন্টারভিউ দিতে চলে যান। মনে রাখবেন ছাত্রজীবন শেষ কিন্তু।
২। ইন্টারভিউ দিতে যাওয়ার সময় অবশ্যই সিভি, কভার লেটারের একটি কপি প্রিন্ট করে নিয়ে যাবেন। আপনার সিভি প্রিন্ট করতে রিক্রুইটার বাধ্য নন।
৩। কলম না নিয়ে ইন্টারভিউ দিতে যাওয়া শুধু ভুলই নয়, অপরাধও বটে। লেট করে যাওয়া আরেকটি বড় অপরাধ।
৪। রিক্রুইটার বাংলায় প্রশ্ন করলে পণ্ডীতি করে ইংরেজিতে উত্তর দিবেন না। এটা বেয়াদপি, ওভার স্মার্টনেস।
৫। আপনি ইংরেজিতে দুর্বল হলে, রিক্রুইটারের কাছে বাংলায় কথা বলার অনুমতি চেয়ে নিন। এতে রিক্রুইটার শুধু বুঝবে যে আপনার ইংরেজি দুর্বল। কিন্তু এটা না করে আপনি যদি ভুল ইংরেজি, আধো আধোভাবে বলতে চান, তাহলে আপনার আরও অনেক দিকই আপনি তুলে ধরতে পারবেন না। আরও বেশি হেয় হওয়ার সুযোগ থাকবে।
৬। ইন্টারভিউ বোর্ডে অনেকে বসা থাকেন। যে প্রশ্ন করবে, তার দিকে তাকিয়ে উত্তর দিন, নিচে অথবা এদিক-সেদিক তাকাবেন না।
৭। ফোন সাইলেন্ট রাখবেন, ইন্টারভিউ চলাকালীন ভাইব্রেশানও থাকা চলবে না।
৮। ইন্টারভিউ বোর্ডের সামনে মিথ্যা বলবেন না। তারা বুঝতে পারে। ইন্টারভিউ দিতে ঢোকার আগে সিগারেট খাবেন না।
৯। যে কোম্পানিতে আবেদন করেছেন ওই কোম্পানি সম্পর্কে জেনে যাবেন, ওই কোম্পানির প্রোডাক্ট কি, সার্ভিস কি না জেনে যাবেন না।
১০। যে পদের জন্য আবেদন করেছেন ওই পদের কর্ম বর্ণনা ভালোভাবে পড়ে যাবেন। আমি স্যার সব পারব, এরকম ভাঁড়ামো মার্কা কথা বললে চাকরি হবে না।
১১। রিক্রুইটারের সঙ্গে তর্ক করবেন না। আপনার চাকরি এখনও হয়নি। এটা মনে রাখবেন। সহনশীল, ভদ্র, নমনীয় আচরণ করবেন।
১২। আপনি চাকরি পাচ্ছেন না, তাই মানসিকভাবে একটু দুর্বল, কিন্তু কিছুতেই সেটা রিক্রুইটারকে বুঝতে দিবেন না। সদা আত্মবিশ্বাসী ও উদ্যমীভাবে নিজেকে তুলে ধরুন।
১৩। ঔদ্ধত্য ও দাম্ভিক আচরণ করবেন না। চাকরি না হোক, সুসম্পর্ক বজায় রাখুন সবার সঙ্গে।
১৪। আপনি মানসিক চাপ নিতে পারেন কি না তার জন্য অনেক সময় আপনাকে রিক্রুইটার ভারি গলায় কথা বলতে পারেন। মাথা ঠাণ্ডা রাখুন। আপনার টেস্ট হচ্ছে। এটাকে বলে ইমোশনাল ইন্টেলিজেন্স টেস্ট। এখানে রেগে গেলেন তো হেরে গেলেন।
১৫। সবশেষে আবারও বলি, কাজকে ফোকাস করে আকর্ষণীয় সিভি তৈরি করুন। কাজ আপনার হয়ে চাকরির জন্য সুপারিশ করবে। এভাবে আপনি ইন্টারভিউ বোর্ড পর্যন্ত আসবেন। তারপর আবার নিজেকে সবার সামনে তুলে ধরুন কর্মদক্ষ, পরিশ্রমি, উদ্যমী হিসেবে। আপনার কথা শুনে কাজ দেখে রিক্রুইটার যেন বলতে বাধ্য হয়, ‘ভাই, আপনকেই তো খুঁজছিলাম, কোথায় ছিলেন এতদিন’।