মানুষ নয়, কয়েকটি প্রাণী মহাকাশযাত্রাকে সুগম করেছে
- সুদীপ্ত মিত্র
আমরা সবাই জানি, মহাকাশ গবেষণায় নভোচারীরা সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। কিন্তু আপনি জানলে অবাক হবেন, মানব মহাকাশ অভিযাত্রার শুরুর দিকে নভোচারীদের কেউ-ই মানুষ ছিলো না। অপেক্ষা করুন, কোনো ভিনগ্রহের প্রাণীর কেচ্ছা বলছি না।
যাদের কথা বললাম, সেই নভোচারীরা হোমো সেপিয়েন্স নয় ঠিকই, তবে তারা আমাদের নীল গ্রহের-ই প্রাণী। এই মূহুর্তে আমরা মহাকাশ সম্পর্কে কতো কিছুই না জানি। অসীম মহাকাশে মনুষ্যবাহী নভোযান প্রেরণ করাও বর্তমানে খুব একটা কঠিন কাজ নয় মানুষের জন্যে। কিন্তু স্পেস সাইন্স সব সময় এতোটা সহজ বিষয় ছিলো না। মানুষের মহাকাশ অনুসন্ধানকে রকেট কিংবা দূরবীক্ষণ প্রযুক্তির আবিষ্কার যতোটা না বেগবান করেছে, ততোটাই সেই যাত্রাকে ফলপ্রসু করেছে এই গ্রহের-ই কিছু প্রাণী।
কিছু ইতিহাস
১৯৫৭ সালের নভেম্বরের ৩ তারিখ, সোভিয়েত ইউনিয়ন সারা বিশ্বকে তাক লাগিয়ে ‘স্পুটনিক-২’ মিশনের অধীনে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো একটা কুকুর দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে আবর্তন করালো। কুকুরটির নাম ছিলো ‘লাইকা’। এই লাইকা ছিলো মস্কোর পথে ঘুরে বেড়ানো একটা যাযাবর কুকুর। সোভিয়েত বিজ্ঞানীরা মনে করেছিলো, যেহেতু একটি রাস্তার কুকুর এমনিতেই বিরূপ পরিবেশে বেঁচে থাকতে অভিযোজিত, সেহেতু এ জাতীয় বিপদজনক মিশন পরিচালনায় ‘লাইকা’-ই হবে তাদের শ্রেষ্ঠ মাধ্যম। ফলত তারা লাইকাকেই পৃথিবীর কক্ষপথে আবর্তনের মিশনে গিনিপিগের দায়িত্ব দিয়েছিলো। লাইকা অক্সিজেনের স্বল্পতায় মহাকাশেই মারা গিয়েছিলো। তবে মৃত্যুর আগে আমাদেরকে দিয়ে গিয়েছিলো অনেক তথ্য। যার দরুন আজ মানুষের পৃথিবীর কক্ষপথে বিচরণ কতোই না সহজ!
এই লাইকা মানুষের দ্বারা মহাকাশে প্রেরণকারী সর্বপ্রথম প্রাণী ছিলো না। ১৯৪৭ সাল থেকেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও সোভিয়েত রাশিয়া মহাকাশে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের খেলার মত্ত হয়ে রকেটে পুরে একের পর এক বিভিন্ন প্রাণীকে মহাকাশে পাঠিয়েছিলো।
এমনটা কেন করা হতো?
প্রথমদিকের রকেট বিজ্ঞানে কেউই জানতো না, মহাকাশে মাইক্রোগ্রাভিটিতে-ভরশূন্যতায় মানুষের ওপর কী কী শারীরিক বা মানসিক প্রভাব পড়তে পারে। সেকারণে মানুষকে মহাকাশে প্রেরণ করা অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ ছিলো। শুরুরদিকে তাই কুকুর, বিড়াল কিংবা শিম্পাঞ্জিকে মহাকাশে পাঠিয়ে মানুষকে নিরাপদে মহাশূন্যে প্রেরণ এবং কোনো প্রকার ক্ষতিগ্রস্ত না হয়ে পৃথিবীতে আবার ফিরিয়ে আনার সম্ভাব্যতা যাচাই করা হতো। এসব প্রাণীরা আমাদেরকে মহাকাশে প্রেরণকৃত কোনো জীবন্ত প্রাণীর ওপর ক্ষতিকর মহাজাগতিক রশ্মির বিকিরণ এবং মাইক্রোগ্রাভিটির প্রভাব বুঝতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বলে রাখা ভালো, মাইক্রোগ্রাভিটি হলো এমন একটি অবস্থা, যখন নভোচারীরা মহাকাশযাত্রার সময় অভিকর্ষ বলের অপ্রতুলতায় নিজেদের ওজনশূন্য অনুভব করে। আমরা হোমো সেপিয়েন্সরা অনেক স্বার্থপর, তাই না?
যাদের অবদান আমরা কোনোদিন ভুলবো না
এবার মহাকাশ বিজ্ঞানে অবদান রাখা কয়েকটি প্রাণী সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নেই:
গর্ডো: একটা স্কোরেল প্রজাতির বানর। যাকে ১৯৫৮ সালের ১৩ ডিসেম্বর, মহাকাশে ৬০০ মাইল উচ্চতায় উৎক্ষেপণ করা হয়েছিলো। দুর্ভাগ্যবশত যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তাকে বাঁচানো সম্ভব হয়নি।
এ্যাবেল ও বেকার: প্রথমটি রেসাস প্রজাতির ও অপরটি স্কোরেল প্রজাতির বানর। ১৯৫৯ সালের ২৮ মে, বানর দুটিকে একসাথে মহাকাশে পাঠানো হয়েছিলো। তারা নিরাপদেই পৃথিবীতে ফেরত এসেছিলো।
হ্যাম: একটি শিম্পাঞ্জি। এটি ‘হ্যাম দ্য এস্ট্রোচিম্প’ নামেও পরিচিত। এই শিম্পাঞ্জিটি শুধুই মহাকাশ ভ্রমণ করেনি। ১৯৬১ সালের ৩১ জানুয়ারি, মহাকাশ ভ্রমণের পর সে রীতিমতো সেলিব্রিটি হয়ে পড়ে। কারণ সেই প্রথম মানবপ্রেরিত প্রাণী, যে মহাকাশ ভ্রমণকালে নভোযানে থাকাকালীন সময়ে যানটির মধ্যে বেশকিছু কাজ সম্পাদন করে।
ফেলিক্স: ১৯৬৩ সালের অক্টোবরের ১৮ তারিখ, ফরাসী বিজ্ঞানীরা মহাকাশে প্রথমবারের মতো ফেলিক্স নামের একটি বিড়ালকে পাঠিয়েছিলো।
ভ্যাটারক ও উগালিয়ক: দুইটি কুকুর। ১৯৬৬ সালের ২২ ফেব্রুয়ারিতে তাদের একসাথে পৃথিবীর কক্ষপথে প্রেরণ করা হয়। ইতিহাসে প্রথমবারের মতো এই কুকুরদ্বয় পৃথিবীকে রেকর্ড ২২ দিন ধরে প্রদক্ষিণ করেছিলো।
শেষকথায় বলি, এই প্রাণীরা আমাদের মহাকাশ ভ্রমণকে সঠিকভাবে বুঝতে অনেক সহায়তা করেছে। ফলাফলস্বরূপ আমরা এখন মহাকাশে হরহামেশাই নিরাপদে নভোচারী পাঠাতে পারি। জ্ঞাতার্থে বলে রাখি, ‘ডিয়ারমুন প্রজেক্ট’-এর অধীনে বেসরকারি মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা,স্পেস এক্স আসছে ২০২৩ সালের পরপরই মহাকাশে পর্যটকবাহী চন্দ্রভ্রমণ বাস্তবায়ন করবে, যা অতীতে এসব প্রাণীর মহাকাশযাত্রার অভিজ্ঞতা ছাড়া কখনই সম্ভবপর হবে না।
তথ্যসূত্র:
১. Lewis, Robert. “𝑳𝒂𝒊𝒌𝒂”. Encyclopedia Britannica, 30 Oct. 2020, Web link: [https://www.britannica.com/topic/Laika] Accessed 25 August 2021.
২. Royal Museums Greenwich. 𝑾𝒉𝒂𝒕 𝒘𝒂𝒔 𝒕𝒉𝒆 𝒇𝒊𝒓𝒔𝒕 𝒂𝒏𝒊𝒎𝒂𝒍 𝒔𝒆𝒏𝒕 𝒊𝒏𝒕𝒐 𝒔𝒑𝒂𝒄𝒆? Web link: [https://www.rmg.co.uk/…/topics/what-was-first-animal-space]
৩. 𝑨𝒏𝒊𝒎𝒂𝒍𝒔 𝒊𝒏 𝒔𝒑𝒂𝒄𝒆. Wikipedia. Web link: [https://en.m.wikipedia.org/wiki/Animals_in_space]
৪. 𝑫𝒆𝒂𝒓𝒎𝒐𝒐𝒏 𝒑𝒓𝒐𝒋𝒆𝒄𝒕. Wikipedia. Web link: [https://en.m.wikipedia.org/wiki/DearMoon_project]