সবুর খানের সাফল্যের দুনিয়া
- মো. সাইফ
বাংলাদেশের নব্য-উদ্যোক্তাদের অনেকের কাছেই তিনি আদর্শ-অনুকরণীয় ব্যাক্তিত্ব। আদর্শ মেনেই পাড়ি দিয়েছেন দীর্ঘ পথ। ১৯৯০ সালে মাত্র দুইটি কম্পিউটার ছিল যার ব্যবসায়ের একমাত্র মূলধন, আজ তার ব্যবসায় হয়েছে বহুমাত্রিক। তিনি দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যবসায়ী মো. সবুর খান। ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির নাম শোনেনি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। অল্প সময়ের মধ্যে এই প্রতিষ্ঠানকে দেশের অন্যতম সেরা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে গড়ে তোলার পেছনের কারিগর সবুর খান। তিনি এই ইউনিভার্সিটির প্রতিষ্ঠাতা; একই সাথে ড্যাফোডিল গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ এর চেয়ারম্যান।
চাঁদপুর জেলার বাবুরহাটে ১৯৬৫ সালে জন্মগ্রহন করেন মো. সবুর খান। সাত ভাই বোনের মধ্যে তিনি ছিলেন দ্বিতীয়। এত মানুষের সংসারে উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি একজনই ছিলেন। তিনি সবুর খানের পিতা মো. ইউনুস খান। মা রওশন আরা ছিলেন গৃহিণী। সংসারে টানাপোড়েন হয়ত ছিল তবে সেটা কখনো সবুর খানের বড় হওয়ার পথে বাঁধা হয়নি। পরিবারে পড়ালেখার গুরুত্ব ছিল সর্বাধিক। পড়ালেখার যেন কোনো ক্ষতি না হয় সেটিই নিশ্চিত করতেন সবুর খানের বাবা-মা।
উচ্চ-মাধ্যমিক পর্যন্ত চাঁদপুরেই পড়ালেখা করেছেন। ইচ্ছে ছিল পাইলট হবেন। আকাশে উড়বেন। সে ইচ্ছে তখন অবশ্য পূরণ হয়নি। তিনি হয়েছেন বড় বড় প্রতিষ্ঠানের পাইলট। যার আকাশে শুধু সাফল্যের ওড়াউড়ি!
ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে সুযোগ পান সবুর খান। স্কলারশীপের ব্যবস্থা হয়ে যায়। তাই জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগেই ভর্তি হন। ১৯৮৮ সালে স্নাতকোত্তর পাশ করেন এখান থেকেই।
সরকারী চাকরী মানে নিশ্চিন্ত থাকার জীবন। একজন গ্র্যাজুয়েটের কাছে এটাই জীবনের কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য। তবে কেউ কেউ নিজের গন্তব্য নিজেই ঠিক করেন। হোক সেটা অনিশ্চয়তার, হোক সেটা ঝুঁকির। তবে কাজের জায়গায় ভালবাসা থাকলে দুর্গম পথ পাড়ি দেওয়ার সাহস করাই যায়। সাহসটা অবশ্য সবুর খানের স্বভাবজাত! এই কারণেই হয়েছেন উদ্যোক্তা।
পিতা ইউনুস খান যিনি নিজে ছিলেন একজন সরকারী চাকরীজীবী। তাই তার ইচ্ছে, ছেলেও হবে সরকারী অফিসার। হয়ত বাবার কথা রাখতেই বিসিএস পরীক্ষা দেন। উর্ত্তীন হন। ডাক বিভাগের সে চাকুরীর নিয়োগপত্র পেয়েছিলেন তবে শেষমেশ আর আগ্রহ পাননি। মনে মনে যে আগেই ঠিক করা-হবেন ব্যবসায়ী।
নব্বই সনের কথা। রাজধাণীর গ্রীনরোডের ১০১/এ ঠিকানায় ড্যাফোডিল কম্পিউটার্স নাম দিয়ে ব্যবসা শুরু করলেন। প্রথম পণ্য ছিলো ৮০৮৮ মডেলের দুইটি পিসি। তখন কী কেউ ভেবেছিল, গলির মোড় পেরিয়ে সবুর খান একদিন হয়ে উঠবেন শহরের অসংখ্য গলিতে বেড়ে উঠা স্বপবাজ তরুণদের আইকন?
দেশের স্বনামধন্য ব্যবসায়ী হয়ে উঠার গল্প একদিনে তৈরি হয় না। গল্পের পেছনেও গল্প থাকে। সবুর খানও শুরুতে অসংখ্য সমস্যার কবলে পড়েছেন। আর এটাকেই তিনি মনে করেন আজকের পর্যায়ে আসার একমাত্র রহস্য। তার মতে, বাধাগুলোই তাকে নতুন করে ভাবতে শিখাত। প্রতিবন্ধকতাকে ভয় পেলে সেটা বাড়ে। তাই তিনি বাধার মুখোমুখি হতেন তা সে যত বড়ই হোক। সবসময়ই ভিন্ন রাস্তা থাকে সমস্যা মোকাবেলার। সবুর খানের চিন্তাশীল মনন ও মেধা খুঁজে বের করতো সেই ‘অল্টারনেটিভ অপরচুনিটিজ’। তাতে হয়ত সবসময় শত ভাগ সফল হতেন না, তবে শিখতে পারতেন নতুন কিছু।
ব্যবসায় বড় করার অংশ হিসেবে ১৯৯৩ সালে শুরু করেন আমদানি। সিঙ্গাপুর, চায়না এবং যুক্তরাষ্ট্র থেকে কম্পিউটার যন্ত্রাংশ আমদানি করতেন। সেসব দিয়েই সিডিকম ক্লোন পিসি বাজারজাত শুরু করেন দেশের বাজারে । ব্যাংক থেকে টাকা উত্তোলন করেছিলেন ব্যবসায়ের মূলধনের জন্যে। তবে দূর্ঘটনার কবলে পড়ে খোয়াতে হয় অর্থগুলো। বিপদে পড়ে যান। অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েও মনোবল হারাননি। পরিচিতজনদের নিকট হতে ধারে টাকা নেন এবং বাকিতে যন্ত্রাংশ আমদানি করেন। এটা ছিল খুবই ঝুঁকিপূর্ণ কারণ এবারও তিনি ঘুরে দাঁড়াতে না পারলে টিকে থাকা খুব মুশকিল হয়ে যেত। তবে সৎ ছিলেন, কর্মঠ ছিলেন। তাই শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে সক্ষম হন। এই ঘটনা তাকে নতুনভাবে ভাবিয়েছে। তিনি এটিকে দেখেন তার দীর্ঘ-পথচলার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে। তার মতে, কেউ সত্যিকারের বিপদে না পড়লে আসলে মানুষ চিনতে পারবে না, সবচেয়ে বড় কথা নিজেকেও চিনতে পারবে না। তাকে যে মানুষ বিশ্বাস করে অর্থ-ঋণ দিয়ে সাহায্য করবে এটিও কখনো জানতেই পারতেন না যদি না দূর্ঘটনা ঘটত।
১৯৯৪ সালে তার নেতৃত্বে ‘ড্যাফোডিল কম্পিউটারস লিমিটেড’ কমটেক ফেয়ারে অংশগ্রহণ করে যেটি তৎকালীন সময়ে খুবই সাড়া ফেলে। এতে করে মানুষ সবুর খানকে একজন নিষ্ঠাবান ব্যবসায়ী হিসেবে চিনতে শুরু করে। তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের বিস্তৃতির লক্ষ্যে ১৯৯৫ সালে ধানমন্ডির রাসেল স্কয়ারে দেশের সর্বপ্রথম কম্পিউটার সুপার-স্টোর এর যাত্রা শুরু করেন। একচেটিয়া ব্যবসা করতে থাকে এটি। তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের বাংলাদেশি প্রথম প্রতিষ্ঠান হিসেবে ১৯৯৬ সালে এই প্রতিষ্ঠানের ওয়েবসাইট চালু করেন তিনি।
তার সুপার-স্টোর ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত খুবই জনপ্রিয় ছিল সাধারণের মাঝে। তবে এর মধ্যে আগারগাঁও বিসিএস কম্পিউটার মার্কেট হওয়ার পর তার ব্যবসায়ে ধীর গতি নেমে আসে। তিনি বুঝলেন পরিবর্তনের সময় এসেছে। যদি তিনি সুপারস্টোর আঁকড়ে ধরে পড়ে থাকতেন তাহলে এই পর্যায়ে আসতে পারতেন না। ব্যবসায় কখনো আবেগ দিয়ে হয় না। তাই সময়ের পরিবর্তনের সাথে যা নতুন এসেছে সেটাই তিনি গ্রহন করেছেন। নতুনত্বের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারা ব্যবসায়ের অন্যতম সাফল্যের রহস্য বলে মনে করেন তিনি। কম্পিউটারের যন্ত্রাংশের ব্যবসায় থেকে তিনি চলে আসেন সফটওয়্যারে। সফটওয়্যার থেকে শিক্ষায় বিনিয়োগ। তার ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি এখন প্রতিষ্ঠিত। নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, ফ্রিল্যান্সিং, আউটসোর্সিং নিয়েও কাজ চলছে।
১৯৯৮ সালে ‘ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি’র যাত্রা শুরু হয় তাঁর হাত ধরে। ‘ড্যাফোডিল পিসি’ নামে তার নিজস্ব ব্র্যান্ড আত্মপ্রতিষ্ঠা লাভ করে। নিজের ব্র্যান্ড নিয়ে হাজির হন বিভিন্ন আইসিটি মেলায় যা ব্যাপক সাড়া ফেলে। বাংলাদেশের প্রথম আইসিটি কোম্পানি হিসেবে তার প্রতিষ্ঠান আইএসও (ISO) সনদ লাভ করে।
ধীরে ধীরে বড় হয় সবুর খানের রাজ্য! তৈরি করেন ড্যাফোডিল গ্রুপ। যার অধীনে রয়েছে ড্যাফোডিল কম্পিউটারস, ড্যাফোডিল পিসি, ড্যাফোডিল অনলাইন, ড্যাফোডিল মাল্টিমিডিয়া, ড্যাফোডিল সফটওয়্যার, ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক বিশ্ববিদ্যালয়, ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক কলেজ, ড্যাফোডিল আন্তর্জাতিক স্কুল, ড্যাফোডিল ইনস্টিটিউট অব আইটি, বাংলাদেশ স্কিল ডেভলপমেন্ট ইনস্টিটিউট, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল প্রফেশনাল ট্রেনিং ইনস্টিটিউট, মাই কিডস, জবসবিডি ডট কম, কম্পিউটার ক্লিনিক, ডলফিন কম্পিউটার্স লিমিটেড, ড্যাফোডিল ওয়েব অ্যান্ড ই-কমার্স প্রভৃতি। বিপুল সংখ্যক মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়েছে তার ড্যাফোডিল গ্রুপের মাধ্যমে।
কাজ করেছেন একজন আদর্শ সংগঠক হিসেবেও। তথ্যপ্রযুক্তি খাতের আন্তজার্তিক সংগঠনগুলোর জোট ‘ওয়ার্ল্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি সার্ভিস এসোসিয়েশন’ এর পরিচালক হয়েছেন। গ্লোবাল ট্রেড কমিটির চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়া ঢাকা চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি হিসেবে কাজ করেছিলেন ২০১৩ সালে।
২০০২ সালে দেশের শীর্ষস্থানীয় আইটি সংগঠন ‘বাংলাদেশ কম্পিউটার সমিতি’র সাধারণ নির্বাচনে তিনি সভাপতি নির্বাচিত হন। একই বছর প্রধানমন্ত্রীর তথ্যপ্রযুক্তি টাস্কফোর্স এর সদস্য হিসেবেও কাজ করেন তিনি।
গুণী এই উদ্যোক্তা তাঁর কাজের স্বীকৃতি পেয়েছেন অসংখ্য। এখনো পাচ্ছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে অমর একুশে স্বর্ণ পদক (২০০০), সাউথইস্ট ব্যাংক – দ্যা ইন্ড্রাস্ট্রি পুরস্কার (২০০১), বেষ্ট আইটি পুরস্কার ( ২০০২), স্বাধীনতা ফোরাম পুরস্কার (২০০২), ফাইন্যান্সিয়াল মিরর বিজনেস পুরস্কার (২০০২), বেষ্ট পার্সনালিটি পুরস্কার (২০০৪), ওয়াল্ড হিউম্যান রাইটস্ পদক (২০০৫), ওয়ার্ল্ড কোয়ালিটি কমিটমেন্ট স্বর্ণ পদক (২০১০), লিডারশীপ পুরস্কার (২০১৩), ওয়ার্ল্ড এডুকেশন কংগ্রেস গ্লোবাল পুরস্কার (২০১৩) এশিয়ান মোস্ট ইন্সপাইরিং নেশন বিল্ডার অ্যাওয়ার্ড (২০১৩)!
সম্প্রতি ফিলিপাইনের প্যানফ্যাসিফিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে বক্তব্য দিয়েছেন সফল ব্যাক্তিত্ব মো. সবুর খান। গত ১৬ এপ্রিল বিশ্ববিদ্যালয়টির ২৩তম সমাবর্তন অনুষ্ঠানে সমাবর্তন বক্তা হিসেবে তিনি প্রায় ৩ হাজার স্নাতক শিক্ষার্থীর সামনে অনুপ্রেরণাদায়ী বক্তব্য প্রদান করেন এই গুণী ব্যবসায়ী।
স্বপ্নের মতোই এক যাত্রা বলতে হয়। এত অর্জনের পরও থেমে নেই পথচলা। বর্তমানে নতুন উদ্যোক্তা সৃষ্টির প্রজেক্টসহ সামাজিক বিভিন্ন কাজে অংশ নিচ্ছেন। সবুর খানের মতো কেউ হতে চাইলে কী করতে হবে? তার মতে, কিছু অর্জন করতে চাইলে প্রথমে কষ্ট স্বীকার করার মানসিকতা থাকতে হবে। বড় হতে চাইলে প্রথমেই মেনে নিতে এখানে সফলতার সংক্ষিপ্ত কোনো রাস্তা নেই। পরিশ্রম, একাগ্রতা, সততা দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করলে সাফল্য আসবেই।