বড় হচ্ছে সিমেন্টের বাজার
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
চলতি বছর শেষে দেশের সিমেন্টের বাজারের আকার বেড়ে দাঁড়াবে ২০ হাজার কোটি টাকায়। গত বছর এ বাজারটির আকার ছিল প্রায় ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। সিমেন্ট খাতের বিভিন্ন কোম্পানি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য পর্যালোচনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছর শেষে সিমেন্টের ব্যবহারের পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় আড়াই কোটি মেট্রিক টনে। এরই মধ্যে গত ১১ মাসে ২ কোটি ২৭ লাখ মেট্রিক টন সিমেন্টের ব্যবহার হয়ে গেছে। ২০১৫ সালে দেশে সিমেন্ট ব্যবহারের পরিমাণ ছিল ২ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন।
এদিকে, সিমেন্টের বিশাল বাজারের সিংহভাগই মাত্র ১২ কোম্পানির দখলে। দেশে বর্তমানে ৩৩টি সিমেন্ট উৎপাদক প্রতিষ্ঠান থাকলেও বাজারের প্রায় ৮০ শতাংশই ১২ কোম্পানির হাতে। বাকি ২১ কোম্পানির বাজার অংশীদারত্ব মাত্র ২০ শতাংশ।
সিমেন্ট কোম্পানি সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশের সিমেন্টের বাজারে আধিপত্যের শীর্ষে রয়েছে শাহ্ সিমেন্ট। কোম্পানিটি এককভাবে সিমেন্টের বাজারের সাড়ে ১৪ শতাংশ দখলে রেখেছে। আর দ্বিতীয় অবস্থানে রয়েছে বসুন্ধরা গ্রুপের দুটি প্রতিষ্ঠান। বসুন্ধরা গ্রুপের মেঘনা ও বসুন্ধরা সিমেন্ট মিলে যৌথভাবে দখলে রেখেছে সিমেন্টের বাজারের প্রায় ১০ শতাংশ। তৃতীয় অবস্থানে রয়েছে সেভেন রিংস ব্র্যান্ডের সিমেন্ট। কোম্পানিটির বাজার অংশীদারত্ব ৮ শতাংশের কিছুটা বেশি।
বাজার অংশীদারত্বে চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে মেঘনা গ্রুপের ফ্রেশ সিমেন্ট। দেশের সিমেন্টের চাহিদার প্রায় সাড়ে ৭ শতাংশ পূরণ করছে কোম্পানি। পঞ্চম অবস্থানে হাইডেলবার্গ সিমেন্ট। এটির বাজার অংশীদারত্ব প্রায় ৭ শতাংশ। ষষ্ঠ অবস্থানে রয়েছে প্রিমিয়ার সিমেন্ট। কোম্পানির বাজার অংশীদারত্ব প্রায় ৬.৯ শতাংশ। সপ্তম অবস্থানে রয়েছে ক্রাউন ব্র্যান্ডের এম আই সিমেন্ট। এ কোম্পানিটির বাজার অংশীদারত্ব ৬.৬৮ শতাংশ।
বাজার অংশীদারত্বের দিক থেকে অষ্টম অবস্থানে রয়েছে লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট। এই কোম্পানিটির বাজার অংশীদারত্ব প্রায় পৌনে ৬ শতাংশ। নবম অবস্থানে রয়েছে হোলসিম সিমেন্ট। সিমেন্টের বাজারের ৪ দশমিক ৩২ শতাংশ রয়েছে কোম্পানিটির দখলে। দশম অবস্থানে আকিজ সিমেন্ট। এটির বাজার অংশীদারত্ব ৪ দশমিক ১৭ শতাংশ। ১১তম অবস্থানে রয়েছে মদিনা সিমেন্ট। কোম্পানিটির বাজার অংশীদারত্ব ৩ দশমিক ৩১ শতাংশ। আর ১২তম অবস্থানে রয়েছে কনফিডেন্স সিমেন্ট। সিমেন্টের বাজারের ২ দশমিক ২১ শতাংশ রয়েছে এই কোম্পানিটির দখলে।
উল্লেখিত ১২ কোম্পানির বাইরে সিমেন্টের বাজারের বাকি ২০ শতাংশ দখলে রেখেছে যে ২১ কোম্পানি, সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো ডায়মন্ড সিমেন্ট, অ্যাংকর ব্র্যান্ডের অলিম্পিক সিমেন্ট, দুবাই বাংলা সিমেন্ট, ইমিরেটস সিমেন্ট, সিয়াম সিটি সিমেন্ট এবং সেনাকল্যাণ সংস্থার মোংলা সিমেন্ট কোম্পানি।
একাধিক সূত্রে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে নভেম্বর পর্যন্ত যে তথ্য পাওয়া গেছে, তাতে ১১ মাসে দেশে সিমেন্টের চাহিদা ছিল ২ কোটি ২৭ লাখ মেট্রিক টন। আগের বছরের একই সময়ে যার পরিমাণ ছিল প্রায় ১ কোটি ৯০ লাখ মেট্রিক টন। সেই হিসাবে আগের বছরের একই সময়ের চেয়ে চলতি বছরের ১১ মাসে সিমেন্ট খাতে প্রবৃদ্ধি হয়েছে প্রায় সাড়ে ১৯ শতাংশ। ১১ মাসের হিসাবে চলতি বছরে প্রতি মাসে গড়ে ২১ লাখ মেট্রিক টন সিমেন্টের চাহিদা ছিল। সিমেন্ট ব্যবসায়ীদের ধারণা, চলতি বছর শেষে সিমেন্টের চাহিদা আড়াই কোটি মেট্রিক টন ছাড়িয়ে যাবে।
জানতে চাইলে লাফার্জ সুরমা সিমেন্টের প্রধান অর্থ কর্মকর্তা (সিএফও) মাসুদ খান বলেন, বর্তমান বাজারমূল্যে দেশে প্রতি টন সিমেন্টের দাম আট হাজার টাকা। বছর শেষে যদি আড়াই কোটি মেট্রিক টন সিমেন্ট বিক্রি হয় তাহলে সিমেন্টের বাজারটি দাঁড়াবে ২০ হাজার কোটি টাকায়।
মাসুদ খান জানান, ২০১৫ সালে দেশে মোট সিমেন্টের চাহিদা ছিল ২ কোটি ১০ লাখ মেট্রিক টন। প্রতি টন সিমেন্টের দাম ৮ হাজার টাকা ধরে গত বছর শেষে সিমেন্টের বাজারটি ছিল ১৬ হাজার ৮০০ কোটি টাকার। চলতি বছর শেষে এই বাজারটির আকার ৩ হাজার ২০০ কোটি টাকা বাড়বে।
শেয়ারবাজারের প্রতিষ্ঠান লঙ্কাবাংলা সিকিউরিটিজের গবেষণা বিভাগের প্রধান মাহফুজুর রহমান এ খাত নিয়ে করা তাঁর এক গবেষণা প্রতিবেদনে বলেছেন, বাংলাদেশে সিমেন্টের যে ব্যবহার, তার ৪০ শতাংশ যায় ব্যক্তিগত বাড়ি নির্মাণে। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ২৭ শতাংশ সিমেন্টের ব্যবহার হয় সরকারি বিভিন্ন ভবন নির্মাণে। আবাসন খাতের ভবন নির্মাণে সিমেন্টের ২০ শতাংশ ব্যবহার হয়।
মাহফুজুর রহমান তাঁর গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলেন, নয় বছর ধরে ১০ শতাংশের বেশি হারে সিমেন্টের চাহিদা বাড়ছে। ভবিষ্যতে এ চাহিদা আরও বাড়বে। কারণ হিসেবে তিনি বলেন, বিদ্যমান চাহিদার পাশাপাশি সরকারি অবকাঠামো খাতে সিমেন্টের চাহিদা বাড়বে। পদ্মা সেতুসহ একাধিক বড় অবকাঠামো প্রকল্প চলমান রয়েছে। বর্তমানে সরকারি অবকাঠামো খাতে সিমেন্টের মোট চাহিদার ৬ শতাংশ ব্যবহার হয়।
চলতি মাসের শুরুতে ঢাকায় অনুষ্ঠিত শেয়ারবাজার মেলায় সিমেন্ট খাতের চ্যালেঞ্জ ও সম্ভাবনা নিয়ে আয়োজিত এক সেমিনারে মাহফুজুর রহমান গবেষণা প্রতিবেদনটি উপস্থাপন করেন। ওই সেমিনারে একাধিক সিমেন্ট কোম্পানির শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।
গবেষণা প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, প্রতিবছর দেশে সিমেন্টের চাহিদা গড়ে ১০ শতাংশের বেশি হারে বাড়লেও এখনো মাথাপিছু সিমেন্ট ব্যবহারে বাংলাদেশ আশপাশের অনেক দেশ থেকে পিছিয়ে রয়েছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ১২৫ কিলোগ্রাম বা কেজি। ভারতে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার ২২৫ কেজি। পাকিস্তানে ১২৯ কেজি। মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহারের দিক থেকে শীর্ষে রয়েছে সৌদি আরব। দেশটিতে মাথাপিছু সিমেন্টের ব্যবহার প্রায় ১ হাজার ৭০০ কেজি। আর সারা বিশ্বে সিমেন্টের মাথাপিছু গড় ব্যবহার ৫০০ কেজি।
মাসুদ খান বলেন, বিশ্বের এক গবেষণায় দেখা গেছে, সাধারণত কোনো দেশে সিমেন্টের মাথাপিছু ব্যবহার ৬০০ কেজিতে উন্নীত হওয়ার পর এ খাতের প্রবৃদ্ধি কিছুটা মন্থর হয়ে পড়ে। সেই হিসাবে বাংলাদেশে সিমেন্টের মাথাপিছু ব্যবহার আরও চার গুণ বৃদ্ধির সম্ভাবনা রয়েছে।