চা উৎপাদনে রেকর্ড
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
টানা নয় বছর ধরে চায়ের উৎপাদন ৫৮ থেকে ৬৭ মিলিয়ন কেজিতে আটকে ছিল। এবারই প্রথম এই বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এল চা-শিল্প। শুধু নয় বছর ধরে নয়, এ অঞ্চলে চা চাষের ইতিহাসে এবার সর্বোচ্চ রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হয়েছে। গতকাল মঙ্গলবার চা উৎপাদনের এ তথ্য প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ চা বোর্ড।
আবার উৎপাদন বাড়লেও চা আমদানি কমেনি। চা বোর্ডের হিসাবের চেয়ে বাস্তব চাহিদা বেশি হওয়ায় চড়া শুল্ককর পরিশোধ করে চা আমদানি হচ্ছে বলে ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন। তবে আমদানি হওয়ায় বাজারে চায়ের সরবরাহ এখন বেশি। নিলাম বাজারে চায়ের দামও পড়তির দিকে। এর সুফল পাবে ভোক্তারা।
বাংলাদেশ চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৬ সালে ১৬২টি বাগানে চা উৎপাদন হয়েছে সাড়ে আট কোটি কেজি। প্রতি কাপ চা তৈরিতে দুই গ্রাম চা-পাতা দরকার হয়। এ হিসাবে গত বছরের উৎপাদন হিসাব করা হলে ৪ হাজার ২৫২ কোটি কাপ চা তৈরির সমান চা উৎপাদিত হয়েছে দেশে। তবে এ সময়ে চায়ের চাহিদা ছিল ৮ কোটি ১৬ লাখ কেজি। এ হিসাবে চাহিদার চেয়ে চা উৎপাদন বেশি হয়েছে ৩৪ লাখ কেজি। এ সময়ে চা আমদানি হয়েছে ৭৭ লাখ কেজি।
চা বোর্ডের চেয়ারম্যান মেজর জেনারেল মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, এ অঞ্চলে ১৬২ বছরের চা-শিল্পের ইতিহাসে এবার উৎপাদনে রেকর্ড হয়েছে। আগামী দু-তিন বছর যদি এই উৎপাদন ধরে রাখা যায়, তাহলে আশাবাদী হওয়া যাবে। সে ক্ষেত্রে আমদানিরও দরকার হবে না। চাহিদা মিটিয়ে রপ্তানি করা যাবে।
মো. সাফিনুল ইসলাম বলেন, চা চাষের জন্য এবার আবহাওয়া অনুকূল ছিল। সঠিক সময়ে বৃষ্টি এবং সঠিক তাপমাত্রা চা উৎপাদনে ভূমিকা রেখেছে। এ ছাড়া চা বোর্ডের তদারকি, বাগানমালিকদের বাগান পরিচর্যা এবং বাজারে শুরুতে ও মাঝামাঝি সময়ে ভালো দাম পাওয়ায় উৎপাদন বাড়াতে ভূমিকা রেখেছে।
চা বোর্ড সূত্র জানায়, গত বছরের চেয়ে এবার চা চাষের জমির পরিমাণ বেড়েছে প্রায় ৫৫০ হেক্টর। এরপরও হেক্টরপ্রতি উৎপাদনও অন্য সময়ের তুলনায় বেড়েছে। গত বছর চায়ের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন হয়েছে ১ হাজার ৫৮৭ কেজি। এর আগে ২০১৩ সালে হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ছিল সর্বোচ্চ, ১ হাজার ৩২০ কেজি।
চা-বাগানমালিকদের সংগঠন বাংলাদেশীয় চা সংসদের জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি এম শাহ আলম বলেন, গত কয়েক বছরে চা-বাগানে সংস্কার হয়েছে। ৫০-৬০ বছরের পুরোনো চারা উঠিয়ে নতুন চারা লাগানো হয়েছে। চা চাষের আওতাও বেড়েছে। আবহাওয়া অনুকূল হওয়ার পাশাপাশি এসব পদক্ষেপের কারণে এর সুফল মিলেছে এবার। এখন উৎপাদনের তুলনায় চায়ের চাহিদায় ফারাক নেই। এভাবে উৎপাদন অব্যাহত থাকলে সামনে চা আমদানিও কমবে।
চা বোর্ডের তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, আমদানি ও উৎপাদন মিলে এই মৌসুমে বাজারে চায়ের সরবরাহ ৯ কোটি ২৭ লাখ কেজি। অভ্যন্তরীণ চাহিদা ও রপ্তানিসহ মোট চায়ের পরিমাণ ছিল ৮ কোটি ২১ লাখ কেজি। চা বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, এই মৌসুমে বাজারে চায়ের উদ্বৃত্ত রয়েছে ১ কোটি ৬ লাখ কেজি। আবার চা ব্যবসায়ীদের হিসাবে, চা বোর্ডের হিসাবের চেয়ে চায়ের চাহিদা বেশি। নাম প্রকাশ না করে চা বিপণনে জড়িত ব্যবসায়ীরা জানান, এ মৌসুমে চায়ের চাহিদা সাড়ে আট কোটি কেজির কম হবে না। চা ব্যবসায়ী এবং চা বোর্ডের হিসাব তুলনা করলেও এবার বাজারে চায়ের উদ্বৃত্ত রয়েছে।
বাংলাদেশ চা ব্যবসায়ী সমিতির সভাপতি শান্তনু বিশ্বাস বলেন, বাজারে চাহিদা আছে বলেই চা আমদানি হচ্ছে। যখন চাহিদা থাকবে না, তখন আমদানিও হবে না। কারণ, এই আমদানি চা বাজারে বিক্রি করার জন্যই আনা হয়।
চা বিপণন অনুযায়ী, দেশের বাগানে উৎপাদিত চা নিলাম বাজারে ব্রোকারেজ হাউসের মাধ্যমে বিক্রি করতে হয়। উৎপাদন বেশি হওয়ার পাশাপাশি আমদানি হওয়ায় নিলাম বাজারে শেষ দিকে চায়ের দাম পড়ে গেছে। এ মৌসুমে শুরুর দিকে গত নভেম্বরের মাঝামাঝি থেকে জানুয়ারির প্রথম সপ্তাহ পর্যন্ত চায়ের দাম গত বছরের চেয়ে কমেছে।
ব্যবসায়ীরা জানান, প্রতিবছরই চায়ের চাহিদা বাড়ছে। চাহিদা বাড়ায় বাজারের আকারও বাড়ছে। ২০১৬ সালে চা উৎপাদনের হিসাব অনুযায়ী, এ বাজারের আকার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা।
চা বিপণনে জড়িত ব্রোকারেজ হাউসগুলোর তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭২ থেকে ২০০৪ সাল পর্যন্ত প্রতিবছর গড়ে ২ কোটি ৪০ লাখ কেজির বেশি চা রপ্তানি হয়। এরপর ২০০৭ সালে চা রপ্তানি এক কোটি কেজির বেশি বাড়লেও ধারাবাহিকভাবে কমছে। এ সময়ে সবচেয়ে বেশি পরিমাণ চা রপ্তানি হয় ১৯৮২ সালে, ৩ কোটি ৪৪ লাখ। সবচেয়ে কম রপ্তানি হয় গত বছর ৪ লাখ ৭০ হাজার কেজি।
উৎপাদনের চেয়ে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় চা রপ্তানি যেমন কমেছে, তেমনি আমদানিও বেড়েছে। ২০১০ সাল থেকে চা আমদানি শুরু হয়। চা বোর্ডের হিসাবে, ২০১৫ সালে ১ কোটি ১৪ লাখ কেজি চা আমদানি হয়, যা এক বছরে সর্বোচ্চ।