‘আমরা পণ্যের ভ্যালু অ্যাডিশন বুঝতে চাই না’
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
বাংলাদেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণে প্রায় আড়াইশ’ প্রতিষ্ঠান নিয়ে বাংলাদেশ অ্যাগ্রো প্রসেসরস অ্যাসোসিয়েশন (বাপা)। ১৯৯৮ সালে প্রতিষ্ঠার পর থেকে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পকে এগিয়ে নিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে সংগঠনটি। আর শুরু থেকেই এ সংগঠনের সঙ্গে রয়েছেন এ এফ এম ফখরুল ইসলাম মুন্সী। বর্তমানে তিনি সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। এছাড়া কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণে যুক্ত আয়ুর্বেদীয় ফার্মেসি (ঢাকা) লিমিটেডের চেয়ারম্যান তিনি। এর আগে দায়িত্ব পালন করেছেন অর্থ উপমন্ত্রী হিসেবে। দেশের বর্তমান প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের অবস্থা ও বাজার সম্পর্কে বিভিন্ন কথা বলেছেন তিনি।
দেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের শুরুটা নিয়ে কিছু বলুন।
যতটুকু মনে পড়ে দেশে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের শুরুটা করেছিল আহমেদ ফুড প্রডাক্ট। সেটা নব্বইয়ের দশকে। কোম্পানিটি সে সময় খুব ছোট পরিসরে আচার-চাটনির মতো পণ্য তৈরি করতো। এরপর সজীব গ্রুপ আমদানির মাধ্যমে দেশের বাজারে ফ্রুটজুস বিক্রি শুরু করে। সেসব পণ্য জনপ্রিয়তা পাওয়ার পরে ছোট ছোট আরো অনেক প্রতিষ্ঠান প্রক্রিয়াকরণ শিল্পে আসে। সে সবই ক্ষুদ্রশিল্প। আর বৃহদাকারে দেশে প্রক্রিয়াকরণ শিল্পের শুরু প্রাণ-আরএফএল গ্রুপের হাত ধরে।
এরপর থেকে এখন পর্যন্ত আমরা কতটুকু এগিয়েছি?
দেশের অভ্যন্তরীণ বাজারে প্রক্রিয়াকরণ পণ্য সরবরাহে আমাদের কোম্পানিগুলো অনেক এগিয়েছে। আগে চকোলেট, বিস্কুট, ড্রিংকস এসব খাবার আমদানিনির্ভর ছিল। এখন এই বাজারের ৯০ শতাংশ দেশি কোম্পানির দখলে এসেছে।
তাহলে এ শিল্পের সমস্যা কোথায়?
এখন আর শুধু দেশের বাজার নিয়ে ভাবলে চলবে না। কারণ দেশে শাক-সবজি, মাছ-মাংস, ফল উৎপাদন বাড়ছে। উদ্বৃত্ত এসব কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ দুর্বলতায় পচে নষ্ট হচ্ছে। অন্যদিকে বিশাল রফতানি বাজার তৈরি হয়েছে। সেখানে প্রক্রিয়াজাতকৃত ও হালাল খাদ্যের চাহিদা প্রচুর। আমরা পিছিয়ে আছি সেই রফতানির বাজার তৈরির ক্ষেত্রে।
পিছিয়ে থাকার সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ রয়েছে?
আসলে প্রক্রিয়াকরণ মানেই যে পণ্যের ভ্যালু অ্যাডিশন—সেটাই আমরা বুঝতে চাই না। এক কেজি আলু উৎপাদন করে তা বাজারে ২০ টাকা দরে বিক্রি করতে তোড়জোড় শুরু করি। কিন্তু এর ১৫ গ্রাম আলুর চিপস বানিয়ে যে ৩০ টাকায় বিক্রি করা যায় সেটা ভাবি না। এ ধারণা থেকে না বেরিয়ে এলে রফতানির বাজার ধরাও সম্ভব নয়। কারণ ওই বাজারে প্রতিদিন নতুন নতুন পণ্য তৈরি হচ্ছে। একটি পণ্য কতভাবে ব্যবহার হতে পারে, প্রতিনিয়ত সেটা আবিষ্কার করতে হবে।
রফতানির বাজার কত বড়?
বিশ্বে শুধু হালাল খাদ্যের বাজার ৫৫৬ বিলিয়ন ডলারের। আর আমরা এখন পর্যন্ত মাত্র ৫০০ মিলিয়নের বাজার ধরতে পেরেছি। মুসলিম দেশ হিসেবে আমাদের এ বাজারের বড় অংশীদার হওয়ার কথা। কিন্তু মুসলিম দেশগুলোর পিছিয়ে থাকায় থাইল্যান্ডের মতো অমুসলিম দেশ এ বাজারে আধিপত্য বিস্তার করছে।
আমাদের রফতানি বাড়ছে না কমছে?
বিশ্বের ১৮৪ দেশে আমরা পণ্য রফতানি করছি। গত বছরের থেকে এ বছর রফতানি ১৮৪ শতাংশ বেড়েছে। এর মধ্যে বড় অংশ যাচ্ছে ভারতে। কিন্তু উন্নত দেশগুলোয় চড়া মূল্যে পণ্য রফতানিতে অনেক পিছিয়ে রয়েছি।
দেশে এখন কতগুলো রফতানিকারক প্রতিষ্ঠান রয়েছে?
বিদেশে প্রক্রিয়াকরণ পণ্য রফতানির জন্য আমাদের অ্যাসোসিয়েশনের সদস্য হতে হয়। আর অ্যাসোসিয়েশনে রফতানিকারক রয়েছে ১৪০ প্রতিষ্ঠান। তবে শেষ কয়েক বছরে এ সংখ্যা খুব দ্রুত বেড়েছে।
সরকার এ বাজার ধরতে কতটা আগ্রহী বলে আপনার মনে হয়?
সরকারের চেষ্টা রয়েছে, তবে সেটার বাস্তবায়ন কম। গত শিল্পনীতিতে কৃষিপণ্য ও খাদ্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পকে অগ্রাধিকার খাতের তালিকায় এক নম্বরে রেখেছে। এরপর গত বছর প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনায় কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণ খাত উন্নয়নে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। কিন্তু এরপর আর কোনো সাড়া নেই। নেই কোনো সহায়তা। কোনো পলিসি এখনো হয়নি। অর্থাৎ আন্তরিকতা কাগজে-কলমেই আটকে আছে।
সংগঠনের পক্ষে এসব কার্যক্রম তদারকির জন্য আপনারা কী করছেন?
তদারকি করতে গেলেও তো সমস্যা রয়েছে। সবচেয়ে বড় সমস্যা, আমরা কোথায় যাব এটাই পরিষ্কার নয়। কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণের কোনো বিষয় নিয়ে গেলে কৃষি মন্ত্রণালয় বলে- আমরা শুধু উৎপাদন দেখি। শিল্প মন্ত্রণালয়ে গেলে বলে- রফতানির বিষয় জড়িত, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে যান। তিন মন্ত্রণালয় একে অন্যকে কাজ চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে। আবার অনেক সময় খাদ্য মন্ত্রণালয়ে যেতে বলা হয়।
অন্যান্য দেশে প্রক্রিয়াকরণ খাত কারা দেখছে আর কীভাবে এ সমস্যার সমাধান করা যায়?
পাশের দেশ ভারতে কৃষিপণ্য প্রক্রিয়াকরণে আলাদা মন্ত্রণালয় রয়েছে। এ ছাড়া ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডে সরকারি একাধিক তদারকি প্রতিষ্ঠান রয়েছে। আমাদের দেশে আলাদা মন্ত্রণালয় করা সম্ভব না হলে কৃষি মন্ত্রণালয়ের অধীনে আলাদা উইং গঠন করা যেতে পারে।
প্রক্রিয়াকরণ খাতকে এগিয়ে নিতে আর কী কী উদ্যোগ প্রয়োজন বলে মনে করেন?
আমাদের প্রধান দাবি, যারা খাদ্য প্রক্রিয়াকরণে যাবে, তাদের বিনাসুদে অর্থায়ন করতে হবে। এটা এখন কোনোভাবেই বেশি চাওয়া নয়। কারণ খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ শিল্প না এগিয়ে গেলে উৎপাদন ব্যাহত হবে। খাদ্য পচে নষ্ট হবে। এমনিতেই শত শত কোটি টাকা লোকসান হবে।ৎ