পাটখড়ির চারকোলে নতুন সম্ভাবনা
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
‘অন্যতম অর্থকরী ফসল পাটের কোনো কিছুই ফেল না নয়। আগে অনাদরে-অবহেলায় পড়ে থাকত পাটকাঠি বা পাটখড়ি। পাটকাঠি সাধারণত কৃষকের রান্নার জ্বালানি, ঘরের বেড়া, পানের বরজে কিংবা বড়জোর আখের ছোবড়ার সঙ্গে মিশিয়ে পার্টিকেল বোর্ড তৈরির কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার হতো। এখন চারকোল তৈরির মিলে ব্যবহৃত হওয়ায় পাটকাঠির চাহিদা বেড়েছে কয়েকগুণ। ভালো দাম পেয়ে লাভবান হচ্ছেন কৃষক। পাটের দাম না পাওয়ার ক্ষতি পুষিয়ে নিচ্ছে কৃষক। একদিকে সোনালী আঁশ, অন্যদিকে রূপালী কাঠি- দু’টো মিলে এক নতুন সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে পাট চাষে।’
কথাগুলো বলছিলেন শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ রোগতত্ত্ব বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আবু নোমান ফারুক আহম্মেদ। দীর্ঘদিন ধরে পাট নিয়ে কাজ করছেন তিনি। এই পাট বিশেষজ্ঞের সঙ্গে কথা বলে পাটখড়ি থেকে তৈরি চারকোলের নানা সম্ভাবনার বিষয়ে জানা গেল।
পাটখড়ি বা পাটকাঠির কার্বন চারকোল নামে পরিচিত। চীনসহ বিভিন্ন দেশে পাটকাঠি পুড়িয়ে পাওয়া কার্বন থেকে আতশবাজি, কার্বন পেপার, প্রিন্টার ও ফটোকপিয়ারের কালি, মোবাইলের ব্যাটারি, ফেসওয়াশের উপকরণ ও প্রসাধণপণ্য, পানির ফিল্টার, বিষ ধ্বংসকারী ওষুধ, জীবন রক্ষাকারী ওষুধ, দাঁত পরিষ্কারের ওষুধ ও সারসহ নানা পণ্য তৈরি করা হয়। চারকোল বা কয়লা ছাড়াও পাটকাঠি থেকে অ্যাকটিভেটেড কার্বন উৎপাদন করা যায়। ইউরোপে ওয়াটার পিউরিফিকেশন প্লান্টে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে পাটকাঠির কার্বনের প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। চার বছর আগে পাটকাঠিকে ছাই বানিয়ে তা রপ্তানির পথ দেখান ওয়াং ফেই নামের চীনের এক নাগরিক। বর্তমানে চীন ছাড়াও তাইওয়ান, জাপান, হংকং ও ব্রাজিলেও এটি রপ্তানি হচ্ছে। এছাড়া চারকোলের বড় বাজার রয়েছে মেক্সিকো, যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জাপান, তুরস্ক, দক্ষিণ কোরিয়া, জার্মানিসহ ইউরোপের দেশগুলোতে।
এই শিল্পে জড়িত একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বহির্বিশ্বে প্রতিনিয়তই চারকোলের চাহিদা বাড়ছে। দেশি উদ্যোক্তারাও আগ্রহী হয়ে উঠছে এ খাতের প্রতি। সংশ্লিষ্টদের মতে, পাটখড়ি থেকে কার্বন দেশের ব্যবসা-বাণিজ্যে নতুন দিগন্তের সূচনা করেছে। একইসঙ্গে উঁকি দিচ্ছে নতুন এক সম্ভাবনার। বাংলাদেশ চারকোল উত্পাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির তথ্যমতে গতবছরও ১৫০ কোটি টাকার চারকোল বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। তবে যাত্রা শুরুর পাঁচ বছরের মাথায় হঠাত্ রপ্তানি বন্ধ হওয়ায় হতাশাও সৃষ্টি হয়েছে।
অপার সম্ভাবনার এই চারকোল নিয়ে হতাশার কথা জানালেন বাংলাদেশ চারকোল উৎপাদন ও রপ্তানিকারক সমিতির (প্রস্তাবিত) আহ্বায়ক মির্জা জিল্লুর রহমান। তিনি জানান, দেশে চারকোলের ব্যাপক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও বর্তমানে শিপমেন্ট বন্ধ। দুর্ঘটনাজনিত কারণে বাংলাদেশ ও সিঙ্গাপুর পোর্টে কন্টেইনার পরিবহনে একটি সমস্যা তৈরি হয়। ফলে কয়েক মাস ধরে চারকোল রপ্তানি বন্ধ রয়েছে। তবে তিনি আশা প্রকাশ করে বলেন, সমস্যা কাটিয়ে দ্রুত রপ্তানি শুরু হবে।
সমিতি সূত্রে জানা গেছে, ২০১২ সালে দেশে এই শিল্পের যাত্রা শুরু হয়। সে বছরই চীনে চারকোল রপ্তানি শুরু হয়। বর্তমানে দেশে অন্তত ৩০টি চারকোল কারখানা রয়েছে। জামালপুর, নারায়ণগঞ্জ, রাজশাহী, পাবনা, রাজবাড়ী, ফরিদপুর ও গাজীপুর জেলায় এসব কারখানা অবস্থিত। চারকোল উত্পাদক উল্লেখযোগ্য কয়েকটি প্রতিষ্ঠান হচ্ছে- সানবিম কর্পোরেশন, মাহফুজা অ্যান্ড আহান এন্টারপ্রাইজ, জামালপুর চারকোল লিমিটেড, রিগারো প্রাইভেট লিমিটেড ইত্যাদি।
পাট অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, দেশে বছরে প্রায় ৩০ লাখ টন পাটকাঠি উৎপাদিত হয়। এর ৫০ শতাংশের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করা গেলেও পাটকাঠির কয়লার বার্ষিক উত্পাদন দাঁড়াবে প্রায় ২ লাখ ৫০ হাজার টন, যা বিদেশে রপ্তানি করে বছরে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা আয় সম্ভব। এটি সম্ভব হলে একই সঙ্গে সৃষ্টি হবে ব্যাপক কর্মসংস্থান।
প্রসঙ্গত, চারকোল বা এক্টিভেটেড কার্বন পাটখড়ি থেকে উৎপাদিত একটি পণ্য। এছাড়া কাঠের গুঁড়া, নারকেলের ছোবড়া ও বাঁশ থেকেও চারকোল উৎপাদন হয়ে থাকে। তবে দেশে এখন পর্যন্ত পাটখড়ি থেকেই চারকোল উৎপাদিত হয়ে আসছে। জানা গেছে, বিশেষ চুল্লিতে পাটখড়ি লোড করে তাতে আগুন দেওয়া হয়। ১০-১২ ঘণ্টা রাখার পরে চুলা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেওয়া হয়, যাতে চুলার ভেতরে অক্সিজেন প্রবেশ করতে না পারে। এভাবে ৪ দিন রাখার পরে এটি কার্বনে পরিণত হয়। পরে সেই কার্বন প্যাকেজিং করে রপ্তানি হয় বিদেশে।
পাট অধিদফতরের মহাপরিচালক মোছলেহ উদ্দিন জানান, দেশে চারকোল উৎপাদনের ব্যাপক সম্ভাবনা রয়েছে। কারণ ১০ টাকার পাটখড়ি দিয়ে যদি ৮ ডলারের চারকোল উৎপাদন করতে পারি এবং তা বিদেশে বিক্রি করতে পারি; তবে তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে যথেষ্ট সহায়ক হবে। খাতটি জনপ্রিয় হয়ে উঠলে দেশের রপ্তানি আয় বৃদ্ধিতে যথেষ্ট ভূমিকা রাখবে।
বৈশ্বিক তথ্য থেকে দেখা গেছে, বিশ্বে প্রতিবছর ৮ দশমিক ১ শতাংশ হারে চারকোলের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১৮ সালে বিশ্বে চারকোলের চাহিদা হবে ২১ লাখ মেট্রিক টন। এই তথ্য ক্লিভল্যান্ডভিত্তিক শিল্প বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান ফ্রিডোনিয়া গ্রুপ ইনকরপোরেশনের। আর গ্র্যান্ড ভিউ রিসার্চের তথ্যমতে, ২০২৪ সালে চারকোলের বৈশ্বিক বাজার হবে ১০ দশমিক ১৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।