ভোটে ট্রাম্পের উত্থান বাজারে আস্থার পতন
- অর্থ ও বাণিজ্য
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ে রাজনীতি ও বাজার বিশ্লেষকদের আস্থায় চিড় ধরেছে। নির্বাচনের ফলাফলে যেভাবে জনমত জরিপ ও পর্যবেক্ষকদের মন্তব্যের অসারতা প্রমাণিত হয়েছে, সেভাবেই আস্থাহীনতার প্রতিফলন ঘটেছে পুঁজিবাজারে। খবর ব্লুমবার্গ।
হিলারি ক্লিনটনের জয়ের আশায় বিনিয়োগকারীরা যেসব খাতে লগ্নি করেছিলেন, ট্রাম্পের উত্থান দেখে তারা সেখান থেকে পুঁজি প্রত্যাহারে হুমড়ি খেয়ে পড়েছেন। বাজারে এ আতঙ্ক ও হুজুগের জের ধরে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ ফিউচারস সূচক মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ৫ শতাংশ অবনমনের শিকার হয়। শিকাগো মার্কেন্টাইল এক্সচেঞ্জের নিয়ম অনুযায়ী, ৫ শতাংশ পতনের পর পর সেখানে লেনদেন বন্ধ করে দেয়া হয়। এর আগে ব্রেক্সিট গণভোটের পর যুক্তরাষ্ট্রের এ বাজারে লেনদেন বন্ধ হয়েছিল। ব্রেক্সিট ভোটের পর সবচেয়ে বড় পতন শুধু যুক্তরাষ্ট্রে নয়, গতকাল এশিয়ার বাজারেও দেখা গেছে।
জুনের ২৩ তারিখ ব্রিটিশ ভোটাররা ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ছাড়ার পক্ষে রায় দেয়ায় ব্যবসায়ী ও বিনিয়োগধারীদের আস্থা ধাক্কা খেয়েছিল। গণভোটের পরবর্তী দুদিনে এসঅ্যান্ডপি ৫০০ সূচকের ৫ দশমিক ৩ শতাংশ অবনমন ঘটেছিল। ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের সম্ভাবনা দেখে গতকাল কয়েক ঘণ্টার মধ্যে বাজারে একই রকম আস্থাহীনতা ও আতঙ্ক দেখা গেছে।
যুক্তরাষ্ট্রে ভোটের ফলাফল প্রকাশের সময় যে কয়টি বাজারে লেনদেন হচ্ছিল, সিডনি তার অন্যতম। এসঅ্যান্ডপি/এএসএক্স ২০০ সূচক গতকাল দিনের শুরুতেই ১ দশমিক ৯ শতাংশ অবনমনের শিকার হয়। রাজনীতিতে নবাগত ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে কেমন নীতি গ্রহণ করেন, সে ব্যাপারে বিনিয়োগকারীরা ভীষণ অনিশ্চয়তায় ভুগছেন।
সিডনির সম্পদ ব্যবস্থাপনা তহবিল শ অ্যান্ড পার্টনারসের কার্ল গুডি বলেন, ট্রাম্প সত্যিই প্রেসিডেন্ট হবেন, এটা জানতে পেরে বাজার মুখ থুবড়ে পড়েছে। বিনিয়োগকারীরা রীতিমতো অপ্রস্তুত বোধ করছেন। আমরাও খুব অবাক হয়েছি।
যুক্তরাষ্ট্রের উদ্যোগে ট্রান্স-প্যাসিফিক পার্টনারশিপ (টিপিপি) চুক্তি স্বাক্ষর করেছে অস্ট্রেলিয়া। ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, এ চুক্তি মার্কিন কোম্পানি ও মার্কিন জনগণের জন্য কল্যাণকর নয়। টিপিপি চুক্তি মুখ থুবড়ে পড়ছে— এমন আশঙ্কায় গতকাল অস্ট্রেলীয় কোম্পানির শেয়ার বিক্রির হিড়িক পড়ে যায়। সে দেশের ব্যাংক, স্বাস্থ্যসেবা ও জ্বালানি খাতের কোম্পানিগুলোর দরপতন হয়েছে সবচেয়ে বেশি।
নাইননিউজ জানিয়েছে, এএসএক্স সূচকের ২ দশমিক ৭ শতাংশ পতন ঘটেছে। একইভাবে অল অর্ডিনারিজ সূচকের ২ দশমিক ১৭ শতাংশ অবনমন ঘটেছে। সবমিলিয়ে দিনের প্রথমার্ধে অস্ট্রেলিয়ার শেয়ারবাজার থেকে ৩ হাজার ৫০০ কোটি ডলার হাওয়ায় উবে গেছে।
ফ্লোরিডা থেকে শুরু করে একেকটি রাজ্যে ভোট গণনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের খবর যখন আসছিল, বিশ্বজুড়ে পুঁজিবাজার সূচকের পতন ঘটছিল। ফ্লোরিডা, ওহাইও ও নর্থ ক্যারোলাইনায় ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের খবর প্রকাশের পর পর মার্কিন পুঁজিবাজারে মঙ্গলবারের আফটার-আওয়ারস ট্রেডিংয়ে বড় ধরনের আতঙ্ক দেখা দেয়। নাইন-ইলেভেনের ধাক্কার চেয়ে বড় দরপতন দেখেছে দেশটির পুঁজিবাজার। ডাও জোনস ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাভারেজ সূচক ৩ দশমিক ৭ শতাংশ নিচে নেমেছে।
এএমপি ক্যাপিটালের চিফ ইকোনমিস্ট শেন অলিভার বলেছেন, ডোনাল্ড ট্রাম্পের সংরক্ষণবাদী মনোভাবে বিনিয়োগকারীরা উদ্বিগ্ন। তাদের আশঙ্কা, ট্রাম্প হয়তো চীন ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করবেন।
সিডনির পাশাপাশি এশিয়ার অন্যান্য বাজারেও ছিল একই রকম আতঙ্ক। টোকিওতে নিক্কেই সূচক ৫ দশমিক ৫ শতাংশ নেমেছে। দিনের প্রথমার্ধে হংকংয়ে হ্যাংসেং ও সাংহাইয়ে কম্পোজিট সূচক যথাক্রমে ২ দশমিক ৮ ও ১ দশমিক ৩ শতাংশ নেমেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় কোসপি সূচকে চার বছরের বৃহত্তম পতন ঘটেছে। ভারত ও তাইওয়ানের বেঞ্চমার্ক সূচকে ২০১৫ সালের আগস্টের পর গতকাল সবচেয়ে বড় পতন ঘটেছে। জাপানের টোপিক্স সূচক পতন হয়েছে ৫ শতাংশের বেশি।
এশিয়ার ধারাবাহিকতায় পশ্চিমের বাজারগুলোয়ও আস্থাহীনতার প্রতিফলন পরিদৃষ্ট হয়েছে। দ্য গার্ডিয়ান জানিয়েছে, বুধবারের লেনদেন শুরুর পর লন্ডন, ফ্রাংকফুর্ট ও প্যারিসের শেয়ারসূচকে ২ শতাংশের বেশি পতন দেখা যায়। এফটিএসই সূচকে ফিউচারসের পতন হয়েছে ৪ দশমিক ৬ শতাংশ। এমএসসিআই এশিয়া-প্যাসিফিক সূচকের পতন হয়েছে ২ শতাংশের বেশি।
অ্যাবারডিন অ্যাসেট ম্যানেজমেন্টের সিনিয়র ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট রিচার্ড ডানবার নিউইয়র্ক টাইমসকে বলেছেন, বাজার কুঁকড়ে যাচ্ছে। বাজার কখনো অনিশ্চয়তা পছন্দ করে না। ট্রাম্প যেহেতু বাজারসংশ্লিষ্টদের কাছে অজ্ঞাত লোক, তাই এ অবস্থা আপাতত চলবে।
প্রেসিডেন্ট পদে ডোনাল্ড ট্রাম্পের জয়ের পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেটেও রিপাবলিকানরা জিতেছেন। মিত্সুবিশি ইউএফজে মরগান স্ট্যানলি সিকিউরিটিজের সিনিয়র ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট নরিহিরো ফুজিতো বলেন, প্রেসিডেন্ট হিসেবে ট্রাম্প কংগ্রেসের উভয় কক্ষে রিপাবলিকান সংখ্যাগরিষ্ঠতা পাচ্ছেন। এ অবস্থায় তিনি যা ইচ্ছে তা করার স্বাধীনতা পেতে পারেন। বিশ্বজুড়ে বিনিয়োগকারীরা তাই অপ্রত্যাশিত ঝুঁকির জন্য প্রস্তুত হচ্ছেন।
লন্ডনে ওয়ার্ল্ড ফার্স্ট ইউকের চিফ ইকোনমিস্ট জেরেমি কুক ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয়কে ‘স্মরণকালের সবচাইতে বড় রাজনৈতিক ধাক্কা’ বলে অভিহিত করেছেন। তিনি বলেন, ট্রাম্পের জয়ের পরিণাম পরিমাপের অযোগ্য।
ডোনাল্ড ট্রাম্প চীন ও অন্যান্য দেশের সঙ্গে বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু করবেন— এমন আশঙ্কায় সার্বভৌম বন্ডের দামে পতন ঘটছে বলে জানিয়েছেন নিউজার্সির প্রুডেনশিয়াল ফিন্যান্সিয়াল ইনকরপোরেশনের চিফ ইনভেস্টমেন্ট স্ট্র্যাটেজিস্ট রবার্ট টিপ। জাপানের ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ইল্ড ১ বেসিস পয়েন্ট কমেছে। দক্ষিণ কোরীয় বন্ডের ইল্ড কমেছে ৮ বেসিস পয়েন্ট। ভারত ও তাইওয়ানের বন্ডের ইল্ড যথাক্রমে ১১ ও ৬ বেসিস পয়েন্ট কমেছে। যুক্তরাষ্ট্রের ১০ বছর মেয়াদি বন্ডের ইল্ড কমেছে ১০ বেসিস পয়েন্ট, যা ব্রেক্সিট ভোটের পর সর্বোচ্চ পতন।