দ্রুতবর্ধনশীল বাজার থেকে উৎপাদন কেন্দ্র হতে চায় ভারত
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
বৈশ্বিক প্রযুক্তি খাতের গুরুত্বপূর্ণ বাজার ভারত। চলতি বছরই বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্ স্মার্টফোন বাজারে পরিণত হবে এটি। তা সত্ত্বেও দেশটির বাজারে বিক্রি হওয়া ফোন ডিভাইসের মাত্র ৬ শতাংশ স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত বা সংযোজিত। এ পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোকে কারখানা স্থাপনের জন্য উদ্দীপনা দিচ্ছে দেশটির সরকার। ফলে আগামী পাঁচ বছরে দেশটির বাজারে স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত ডিভাইসের অবদান ৩০ শতাংশ ছাড়িয়ে যাবে বলে আশা করা হচ্ছে। আর এর মধ্য দিয়ে প্রযুক্তি খাতের দ্রুতবর্ধনশীল বাজার থেকে উৎপাদনকারী দেশে পরিণত হবে। বাজার গবেষণা প্রতিষ্ঠান কাউন্টারপয়েন্ট ও দেশটির ‘ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব ম্যানেজমেন্ট ইন বেঙ্গালুরুর’ এক জরিপে এমন তথ্যই বেরিয়ে এসেছে। খবর ব্লুমবার্গ।
নরেন্দ্র মোদি সরকার গঠনের পর পরই বিপুলসংখ্যক উৎপাদন-সংশ্লিষ্ট কর্মসংস্থান তৈরির ঘোষণা দিয়েছিলেন। এক্ষেত্রে খুব বেশি সফল না হলেও বর্তমানে তিনি বৈশ্বিক প্রযুক্তি জায়ান্টগুলোকে ভারতে বেশি বেশি উৎপাদন কারখানা স্থাপনে উত্সাহিত করতে গুরুত্বারোপ করছেন। ভারতকে প্রযুক্তিপণ্য উৎপাদনের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করতে মোদি সরকার ‘মেক ইন ইন্ডিয়া’ উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। সরকারের এ উদ্যোগ সফল করতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে মাইক্রোসফট, গুগল, ফেসবুক, ইনটেল, ওরাকলের মতো মার্কিন প্রতিষ্ঠানগুলোর পাশাপাশি জাপানভিত্তিক সফটব্যাক করপোরেশন ও তাইওয়ানের ফক্সকনসহ আরো বেশকিছু কোম্পানি।
কাউন্টারপয়েন্টের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির সরকার বর্তমানে মোবাইল ডিভাইসের গুরুত্বপূর্ণ কমপোনেন্ট যেমন— ব্যাটারি, ক্যামেরা ও সেমিকন্ডাক্টর পণ্য স্থানীয়ভাবে উৎপাদনে জোর দিচ্ছে। এ চেষ্টায় সফল হলে দেশে উৎপাদিত পণ্যে স্থানীয় গ্রাহকদের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করা সম্ভব হবে। এক্ষেত্রে দেশটির ক্রমবর্ধমান চাহিদার বিষয়টি সামনে এনে উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে আকৃষ্ট করার সুযোগ রয়েছে।
ব্যবহাকারী বিবেচনায় বর্তমানে স্মার্টফোনের দ্বিতীয় বড় বাজার যুক্তরাষ্ট্র। চলতি বছরের শেষ নাগাদ ভারত স্মার্টফোন বাজার হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রকে পেছনে ফেলে দ্বিতীয় অবস্থানে উঠে আসবে। আগামী পাঁচ বছরে দেশটিতে প্রায় শতকোটি স্মার্টফোন ডিভাইস বিক্রি হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে স্মার্টফোনের গুরুত্বপূর্ণ এ বাজারে স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর অবদান অত্যন্ত নগণ্য। গ্রাহক বিবেচনায় স্মার্টফোনের সবচেয়ে বড় বাজার চীন। দেশটির বাজারের ৭০ শতাংশই স্থানীয় ডিভাইস নির্মাতাদের দখলে। স্যামসাংয়ের কারণে দক্ষিণ কোরিয়া স্মার্টফোনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ বাজার। বাজারটির ৫০ শতাংশই স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণে।
বিষয়টি ঘিরে ভারতের ইলেকট্রনিকস অ্যান্ড ইনফরমেশন টেকনোলজি মন্ত্রণালয়ের সচিব অরুণা সুন্দররাজন বলেন, শিগগিরই আমরা সেলফোন উৎপাদন ইকোসিস্টেম হিসেবে বিশ্বে নেতৃত্ব দেব। এটি পর্যায়ক্রমে অর্জন সম্ভব।
তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে এরই মধ্যে প্রায় ১০০ ডিজাইন ইঞ্জিনিয়ারকে তাইওয়ানে প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো হয়েছে। সেখানে তারা পণ্যের নকশা ও গ্রাহক চাহিদা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ নিচ্ছেন।
বর্তমানে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রে স্মার্টফোনের বাজার প্রবৃদ্ধি শ্লথ হয়ে এসেছে। প্রধান এ দুই বাজারের চেয়ে ভারতের পরিস্থিতি সম্পূর্ণ ভিন্ন। ফলে অ্যাপল, স্যামসাং ও শাওমির মতো ডিভাইস নির্মাতারা এখন ভারতের বাজারকেই বেশি গুরুত্ব দিচ্ছে। এরই অংশ হিসেবে অ্যাপলের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা টিম কুক গত মে মাসে প্রথমবার ভারত সফর করেন। বর্তমানে দেশটিতে নিজস্ব খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র খোলার বিষয়েও কাজ করছে অ্যাপল। আর এক্ষেত্রে বর্তমান নীতি অনুযায়ী, নিজস্ব খুচরা বিক্রয়কেন্দ্র পরিচালনা করতে হলে দেশটিতে অন্তত ৩০ শতাংশ প্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ উৎপাদন করতে হবে।
বিশ্লেষকদের মতে, ভারতে আগামী পাঁচ বছরে স্মার্টফোন ও ফিচার ফোন মিলে যে পরিমাণ ডিভাইস বিক্রি হবে, সামগ্রিকভাবে এসব ডিভাইস উৎপাদনে ৮ হাজার কোটি ডলারের বেশি মূল্যের কমপোনেন্ট বা উপাদান লাগবে। বর্তমানে এ দুই ধরনের ডিভাইসের জন্য প্রয়োজন হয় ১ হাজার ১০০ কোটি ডলারের উপাদান। এক্ষেত্রে ভারত যদি সরাসরি উৎপাদনে না গিয়ে স্থানীয়ভাবে শুধু সংযোজন কার্যক্রমের বিস্তার ঘটায়, তা হলেও ২০২০ সাল নাগাদ বাজারটিতে স্থানীয়ভাবে তৈরি ডিভাইসের অবদান দাঁড়াবে ৩২ শতাংশ।
এদিকে স্থানীয়ভাবে প্রযুক্তি উৎপাদনের ওপর জোর দিতে এরই মধ্যে বিভিন্ন প্রযুক্তিপণ্যের ওপর আমদানি শুল্ক বাড়িয়েছে দেশটির সরকার। দেশটির স্থানীয় সংবাদমাধ্যমগুলোর তথ্যমতে, এরই মধ্যে দেশটিতে কারখানা স্থাপনের কাজ শুরু করেছে ফক্সকন। চলতি বছরেই সেলফোন সংযোজন শিল্পের ক্ষেত্রে বড় ধরনের অগ্রগতি হয়েছে। কাউন্টারপয়েন্টের তথ্যমতে, চলতি বছরের শেষ নাগাদ দেশটিতে বিক্রি হওয়া মোট মোবাইল ডিভাইসের সংখ্যা দাঁড়াবে ২৬ কোটি ৭০ লাখে। এর মধ্যে স্থানীয়ভাবে সংযোজিত ডিভাইসের সংখ্যা দাঁড়াবে ১৮ কোটিতে, যা মোটের ৬৭ শতাংশ। ২০১৪ সালে এ হার ছিল মাত্র ১৪ শতাংশ।
ভারত সরকারের প্রধান পরিকল্পনা কেন্দ্র নীতি আয়োগের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অমিতাভ কান্ট বলেন, পর্যাপ্ত পরিকল্পনার মাধ্যমে স্থানীয় উদ্যোগ ও আরঅ্যান্ডডি (রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট) খাতে যত বেশি বিনিয়োগ করা হবে, তত দ্রুত ও কার্যকরভাবে ভারতের অর্থনীতিরও বিস্তৃতি ঘটবে।