ইউরোপে বাংলাদেশি পণ্যের বিপুল বাজার
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোতে বাংলাদেশি পণ্য ও সেবাখাতের অফুরন্ত বাজার সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও শুধুমাত্র কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার কারণে তা কাজে লাগানো যাচ্ছে না। এই বাজার দখল করে নিচ্ছে চীন, ভারত ও কম্বোডিয়া। বাংলাদেশি ব্যবসায়ীরা স্ব-উদ্যোগে এই বাজার ধরতে গেলে ভোগান্তির স্বীকার হচ্ছেন নানাভাবে। সাবেক সোভিয়েত-রাশিয়া থেকে মুক্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর সাথে রাশিয়ার সম্পর্ক তিক্ত থাকার কারণে এই দেশগুলোর ক্রেমলিনভিত্তিক সমস্ত ব্যবসা-বাণিজ্য এখন প্রায় বন্ধ। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত এই দেশগুলো নিজেদের উদ্যোগে চীন, ভারত, কম্বোডিয়া, লাওস, দক্ষিণ কোরিয়ার ও তাইওয়ানের সাথে ব্যবসায়িক সম্পর্ক জোরদার করে নিজেদের প্রয়োজনীয় পণ্যাদি আমদানি করছে। এই দেশগুলোর সরকারও ব্যবসায়ীদের সাধ্যমতো সহযোগিতা প্রদান করছে যাতে ইউরোপের এই দেশগুলোতে তাদের একচ্ছত্র বাজার তৈরি হয়।
বাংলাদেশ সেখানে মার খাচ্ছে শুধুমাত্র যোগাযোগ ব্যবস্থা, সহযোগিতা চুক্তি, দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য চুক্তি ও কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার কারণে। কূটনৈতিক সম্পর্ক না থাকার ফলে বাংলাদেশি ব্যবসায়ীদের ভিসা পেতে সমস্যা হয়। এসব দেশের ভিসার জন্য বাংলাদেশিদের চীন বা ভারতের রাজধানীতে যেতে হয়। ফলে ব্যবসায়ীরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন মাঝপথেই। পূর্ব ইউরোপের এই দেশগুলোতে বাংলাদেশি জনশক্তিরও একটি বাজার সম্ভাবনা রয়েছে। কিন্তু যথাযথ উদ্যোগের অভাবে তাও চলে যাচ্ছে চীন ও ভারতের কাছে।
পূর্ব ইউরোপের দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশের বাজার সম্ভাবনা থাকা দেশগুলো হচ্ছে: মন্টিনিগ্রো, সার্বিয়া, ইউক্রেন, মলডোভা, আলজেরিয়া, বেলারুশ, জর্জিয়া, আজারবাইজান, তুর্কিমেনিস্তান, আর্মেনিয়া, মেসিডোনিয়া, রোমানিয়া, বুলগেরিয়া, কসোভো এবং বসনিয়া ও হারজিগোবিনা।
মন্টিনিগ্রোতে বাংলাদেশি জনশক্তি রফতানির একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করা হলেও পরবর্তীতে তা আর এগোয়নি। ফলে মন্টিনিগ্রোতে ২০১০ সালে চীন প্রায় তিন হাজার শ্রমিক পাঠিয়ে দেশটির জনশক্তি শূন্যতা পূরণ করেছে। ঠিক একইভাবে, বেলারুশ, ইউক্রেন, জর্জিয়া, তুর্কিমেনিস্তান, বুলগেরিয়া, রোমানিয়া ও মলডোভাতে বাংলাদেশি শ্রম বাজারের সম্ভাবনা রয়েছে। এসব দেশে বাংলাদেশি তৈরি পোশাক, কৃষিজাত পণ্য বিশেষ করে তাজা শাক-সব্জি, মাছ, ওষুধ, সিরামিক পণ্য, হস্তশিল্পজাত পণ্য, চামড়াজাত পণ্য, বিভিন্ন শুকনা খাদ্য ও কম্পিউটার সেবার ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
এই দেশগুলোতে দু’একটি প্রতিষ্ঠান নিজস্ব উদ্যোগে চেষ্টা করলেও তা খুব বেশিদূর এগোয়নি নানা প্রতিবন্ধকতার কারণে। এর মূল কারণ ভিসা সহজলভ্য না হওয়া, পণ্য প্রেরণের জন্য জাহাজের সরাসরি রুট না থাকা এবং কিছু কিছু দেশে দ্বৈত শুল্ক আরোপ থাকা। রাষ্ট্রীয় বাণিজ্য চুক্তি না থাকার কারণে কিছু দেশে দ্বৈত শুল্ক আরোপিত রয়েছে। ফলে বাংলাদেশি পণ্য ভিন্ন নামে বা ইউরোপীয় ইউনিয়নের মাধ্যমে এসব দেশে পুনঃরফতানি হচ্ছে। যার কোনো সুবিধা বাংলাদেশি রফতানিকারক বা উৎপাদনকারী ভোগ করতে পারেন না।
গত বছর সেপ্টেম্বর মাসে বাংলাদেশের পক্ষে কাজ করা একটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ঢাকা চেম্বার অব কমার্স এন্ড ইন্ডাস্ট্রির সাথে চুক্তিবদ্ধ থাকার সুবাদে মন্টিনিগ্রোর সাথে একটি সমঝোতা স্বাক্ষর হয়েছিলো। ঢাকা চেম্বারের পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলেও মন্টিনিগ্রো কর্তৃপক্ষ বিষয়টি রাষ্ট্রীয়ভাবে প্রস্তাব করার উপর গুরুত্ব দিচ্ছে বলে ঢাকা চেম্বারের সাবেক সভাপতি মোহাম্মদ শাহজাহান খান জানান। ব্যবসায়ী সংগঠনগুলোর মতে, পূর্ব ইউরোপের বাজার ইউরোপীয় ইউনিয়নের চেয়ে কোনো অংশে কম নয়। কিন্তু এই বাজার ধরতে যে রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ দরকার তা নেই। তাদের মতে, এসব দেশে ব্যবসায়ী প্রতিনিধিদের বাজার সম্ভাব্যতা যাচাই করার জন্য ভ্রমণের ব্যবস্থা করা, ভিসা সহজলভ্য করা এবং কূটনৈতিক সম্পর্ক জোরদার করা জরুরি।
উল্লেখ্য, বহুদিন যু্দ্ধের কারণে পূর্ব ইউরোপের এসকল দেশে তেমন কোনো শিল্প-কারখানা গড়ে ওঠেনি। তাছাড়া তাদের অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড মস্কোভিত্তিক হওয়ায় নতুন করে এসব দেশকে ব্যবসা-বাণিজ্যের ‘সাপ্লাই চেইন’ তৈরি করতে হচ্ছে। ভারত ও চীন এই সাপ্লাই চেইন তৈরিতে এগিয়ে থাকার কারণে দেশগুলো ওইসব বাজারের উপরই নির্ভরশীল হয়ে পড়ছে। তারা বাংলাদেশি সস্তা পণ্য কিনতে আগ্রহী হলেও সামর্থ্য হচ্ছে না শুধুমাত্র সহজলভ্যতা না থাকার কারণে।
ব্যবসায়ীদের মতে, বাংলাদেশের উচিত কঠিন শর্তে ইউরোপীয় ইউনিয়নের উন্নয়ন সহযোগিতা ও বাজার সুবিধায় সীমাবদ্ধ না থেকে বিকল্প হিসেবে নতুন এই ইউরোপীয় অর্থনৈতিক গতিপথে অগ্রগামী হওয়া। তারা বলেন, ইউরোপীয় ইউনিয়ন বর্তমানে বাংলাদেশকে যেভাবে কিছু সহযোগিতা প্রদানের বিনিময়ে কঠিন শর্তের বেড়াজালে আবদ্ধ করে রেখেছে তার বিকল্প পথ খুঁজে নিজেদের শক্ত অবস্থান তৈরি করা। ব্যবসা সম্প্রসারণ ও অর্থনৈতিক কৌশলপত্র তৈরিতে কাজ করা আন্তর্জাতিক সংগঠন-গ্লোবাল ইকোনমিস্ট ফোরামের প্রেসিডেন্ট ডক্টর এনায়েত করিম বলেন, অতি দ্রুত বিকল্প বাজার খুঁজে বের না করলে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক ও ওষুধ রফতানি আমেরিকা ও ইউরোপীয় ইউনিয়নভুক্ত দেশগুলোতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে। কারণ, এসব দেশে সহসা নতুন করে অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে। ফলে, তারা একদিকে যেমন ক্রয় সক্ষমতা হারাচ্ছে অন্যদিকে নিজস্ব পণ্যের উপর গুরুত্ব দিচ্ছে।
ডক্টর এনায়েত করিমের মতে, বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশে উন্নীত হোক এটা অনেক প্রতিযোগী দেশতো বটেই উন্নত দেশও চায় না কারণ তারা প্রতিযোগিতায় এগিয়ে থাকতে ও দারিদ্র্যপীড়িত দেশের সস্তা সেবা পেতে বেশি পছন্দ করে।