বিদেশি বিনিয়োগ বেড়েছে ৭২ ভাগ
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশিদের বিনিয়োগ বাড়ছে। আগে বহুজাতিক কোম্পানির শেয়ারে বিদেশিদের বেশি আগ্রহ ছিল। এখন দেশীয় কিছু কোম্পানিতে সর্বাধিক বিনিয়োগ তাদের। প্রতি মাসেই এ বিনিয়োগ বাড়ছে। সাম্প্রতিক পরিসংখ্যানে ইতিবাচক দিক দেখা যাচ্ছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরের শেষে দেশের শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত ৮৮টি কোম্পানিতে বিদেশিদের মোট বিনিয়োগ ছিল বাজারদরে ৯ হাজার ১৩২ কোটি টাকা। গত নভেম্বর শেষে ১১৪ কোম্পানিতে বিদেশিদের মোট বিনিয়োগ বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৫ হাজার ৬৬৫ কোটি টাকায়। অর্থাৎ গত ১১ মাসে বাজার মূল্যে বিদেশিদের পোর্টফোলিও বিনিয়োগ বেড়েছে ৬ হাজার ৫৩৩ কোটি টাকা বা প্রায় ৭২ শতাংশ। ডিএসইতে প্রকাশিত বিভিন্ন কোম্পানিতে বিদেশি শেয়ারের হিসাব গণনা করে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ রয়েছে উন্নত বিশ্বের বহুজাতিক কয়েকটি বিনিয়োগ কোম্পানি। বিভিন্ন দেশে ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক বা ইনভেস্টমেন্ট ম্যানেজার হিসেবে পরিচিত এসব কোম্পানি। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো_ যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াসাটচ্, মর্গান স্ট্যানলি, জেপি মর্গান ও গোল্ডম্যান স্যাকস, যুক্তরাজ্যভিত্তিক এবারডিন, সিঙ্গাপুরভিত্তিক এরিসাইগ, নর্ডিক দেশভুক্ত দেশগুলোর ব্যবসায়ীদের সমন্বিত বিনিয়োগ প্রতিষ্ঠান ব্রামার্স অ্যান্ড পার্টনার্স। এসব প্রতিষ্ঠানের প্রতিটির বিশ্ব শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ রয়েছে ১০০ বিলিয়ন থেকে হাজার বিলিয়ন ডলারের। তবে ফ্রন্টিয়ার বাজার হিসেবে বাংলাদেশের শেয়ারবাজারে এসব প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ তাদের নিজস্ব বিনিয়োগ ফান্ডের হাজার ভাগের একভাগও নয়। বিনিয়োগযোগ্য ভালো কোম্পানির সংখ্যা, আর্থিক প্রতিবেদনের বিশ্বাসযোগ্যতা এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন বৃদ্ধি পেলে বিশ্বের বড় বড় ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের আরও বিনিয়োগ নিয়ে আসার সম্ভাবনা আছে বলে মনে করেন শেয়ারবাজার সংশ্লিষ্টরা।
এছাড়া ডিএসই সূত্রে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বর পর্যন্ত চলতি বছরের প্রথম ১১ মাসে বিদেশি পোর্টফোলিও বিনিয়োগ অ্যাকাউন্টে নিট বিনিয়োগ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। এ সময়ে বিদেশিরা কিনেছেন ৪ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকার শেয়ার। বিক্রি করেছেন ৩ হাজার ৪২১ কোটি টাকার। এর মাধ্যমে শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক সময়ের লেনদেনে বিদেশিদের অংশগ্রহণ প্রায় ৮ দশমিক ৩৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।
প্রাপ্ত তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত নভেম্বর শেষে শেয়ারের বাজার মূল্যে বিদেশিদের সর্বাধিক প্রায় ২ হাজার ৪১১ কোটি টাকার বিনিয়োগ ছিল স্কয়ার ফার্মায়। এরপরের অবস্থানে ছিল অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজে ২ হাজার ২২৬ কোটি টাকার, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোতে ২ হাজার ২০৫ কোটি টাকা। এছাড়া বাজারদরের হিসেবে বিদেশিদের বিনিয়োগ করা শেয়ারের মূল্যে ব্র্যাক ব্যাংকের ক্ষেত্রে ১ হাজার ৯২২ কোটি টাকা, রেনেটাতে ১ হাজার ২৫৮ কোটি টাকা, বেক্সিমকো ফার্মাতে ১ হাজার ২৩৮ কোটি টাকা, গ্রামীণফোনে ৮৫৭ কোটি টাকা, বিএসআরএম লিমিটেডে ৭৭৬ কোটি টাকা, ডিবিএইচে ৪৩৯ কোটি টাকা, ইসলামী ব্যাংকে ৩০৯ কোটি টাকা দাঁড়িয়েছে।
ডিএসইর তথ্য বিশ্লেষণে দেখা গেছে, গত নভেম্বর শেষে ১১৪ কোম্পানিতে বিদেশিদের বিনিয়োগ থাকলেও শীর্ষ ১০ কোম্পানিতেই ছিল মোট বিনিয়োগের ৮৭ শতাংশ। শীর্ষ ২০ কোম্পানির ক্ষেত্রে এ হার ছিল ৯৪ শতাংশ। অর্থাৎ তালিকাভুক্ত ২৯৪ কোম্পানির মধ্যে বিদেশিদের পছন্দের তালিকায় রয়েছে গুটিকয় শেয়ার।
অবশ্য ২-৩ বছর আগে বিদেশিদের বিনিয়োগের প্রধান আগ্রহ ছিল বহুজাতিক কোম্পানি। বিশেষত গ্রামীণফোন, লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট, বার্জার পেইন্টস, বাটা সু, রেকিট বেনকিজার, গ্গ্নাক্সোস্মিথ ক্লাইনসহ কিছু কোম্পানি। এখন চিত্রটা একেবারে বদলে গেছে। বিদেশিরা দেশীয় কিছু কোম্পানিতে বিনিয়োগ করছেন বেশি।
যেমন কোনো তালিকাভুক্ত কোম্পানির শেয়ার ধারণের হারের দিক বিবেচনায় গত নভেম্বরে সর্বাধিক প্রায় ৩ শতাংশ শেয়ার ধারণ বেড়েছে ডেফোডিল কম্পিউটার্সে। গত অক্টোবর শেষে এ কোম্পানিতে বিদেশিদের কোনো বিনিয়োগ ছিল না। অর্থাৎ নভেম্বরে তা ২ দশমিক ৯১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এছাড়া জিএসপি ফাইন্যান্সে ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ, বেক্সিমকো ফার্মায় ১ দশমিক ০৬ শতাংশ শেয়ার ধারণ বেড়েছে। উল্লেখযোগ্য শেয়ার ধারণ বেড়েছে আর্গন ডেনিম, সিটি জেনারেল ইন্স্যুরেন্স, ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক, বারাকা পাওয়ার, ইউনিয়ন ক্যাপিটাল, এপেক্স ফুডস, বে লিজিংসহ কিছু কোম্পানিতে।
তবে বিদেশিরা কোনো কোম্পানির মোট শেয়ারের মধ্যে (শতাংশের হারে) সর্বাধিক ৪১ দশমিক ৩৮ শতাংশ শেয়ার ধারণ করছে ব্র্যাক ব্যাংকের। এরপরের অবস্থানে আছে অলিম্পিক ইন্ডাস্ট্রিজের ৩৯ দশমিক ৫৫ শতাংশ, বেক্সিমকো ফার্মার প্রায় ৩৯ শতাংশ, ডিবিএইচের ৩৫ শতাংশ, নর্দার্ন জুটের ৩০ শতাংশ, বিএসআরএম লিমিটেডের ২৯ দশমিক ৩১ শতাংশ, রেনেটাতে পৌনে ২২ শতাংশ, স্কয়ার ফার্মার পৌনে ১৯ শতাংশ, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকোর সাড়ে ১৪ শতাংশ, বেক্সিমকো লিমিটেডের প্রায় ১০ শতাংশ শেয়ার রয়েছে বিদেশিদের পোর্টফোলিওতে।
ধারণকৃত শেয়ারের মোট বাজার মূল্য বা কোম্পানির মোট শেয়ারের অংশ হিসেবে প্রথম ১০ কোম্পানির নয়টিই দেশীয় কোম্পানি। এ তালিকার নবম স্থানে আছে ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো।
সংশ্লিষ্টরা আরও জানান, প্রতি মাসেই বিদেশিদের নতুন বিনিয়োগ বাড়ছে। বিনিয়োগ থেকে প্রাপ্ত মুনাফার কিছু অংশ নিজ নিজ দেশে ফিরিয়েও নেওয়া হচ্ছে। তবে মুনাফাসহ বিনিয়োগ যতটা তুলে নেওয়া হচ্ছে, তার তুলনায় নতুন বিনিয়োগ আসছে বেশি। শেয়ারবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির সর্বশেষ একটি পরিসংখ্যান বলছে, ২০১৫ সালের ৩০ জুনে দেশের শেয়ারবাজারে ৮৫৬ বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের বিনিয়োগ ছিল। ওই সময়ে তাদের নিট বিনিয়োগ ছিল ৫ হাজার ১১১ কোটি টাকা। আবার ২০১৪-১৫ অর্থবছরে তারা ২ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা নিজ দেশে ফেরত নিয়েছিলেন। ২০১৫-১৬ অর্থবছরের এ সংক্রান্ত তথ্য এখনও তৈরি করেনি সংস্থাটি। তবে বিএসইসির কর্মকর্তারা জানান, এ ক্ষেত্রে বিনিয়োগ প্রবৃদ্ধি আরও বেশি।
ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ (ডিএসই) থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গত নভেম্বরে কেবল ডিএসইতে ৬৬৩ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করেন বিদেশিরা। এরমধ্যে ৪০৯ কোটি টাকার শেয়ার কিনেছেন। বিপরীতে বিক্রি করেছেন ২৫৪ কোটি টাকার শেয়ার। অর্থাৎ নভেম্বরে নিট বিনিয়োগ করেন ১৫৫ কোটি টাকা। গত আগস্ট থেকে অক্টোবর পর্যন্ত সময়ে প্রতি মাসে প্রায় ৭৫০ কোটি টাকার শেয়ার লেনদেন করেন বিদেশিরা। ওই সময়ে নিট বিনিয়োগ করেন ৩৫১ কোটি টাকার। আর চলতি বছরের ১১ মাসে নিট বিনিয়োগ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়েছে।
অর্থনীতিবিদ ও শেয়ারবাজার বিশেষজ্ঞ আবু আহমেদ মনে করেন, বাংলাদেশের টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি বিদেশিদের এখানে বিনিয়োগে আকৃষ্ট করছে। তিনি বলেন, দুই-তিন বছর আগের তুলনায় দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্থিতিশীলতা দেখা যাচ্ছে। বিভিন্ন দেশ বিনিয়োগে আগ্রহ দেখাচ্ছে। বিশেষত বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে অংশীদার হতে চাইছে, যা দেশের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আরও প্রবৃদ্ধির আশা জাগায়। অর্থনীতিতে প্রবৃদ্ধি হলে শেয়ারবাজারেও তার ছোঁয়া থাকবে। এখান থেকে মুনাফা করারও সুযোগ বাড়বে। এ সুযোগ নিতেই বিদেশিরা আসছে।
তবে তালিকাভুক্ত কোম্পানির ব্যবস্থাপনায় ও আর্থিক হিসাবে স্বচ্ছতা না থাকায় বিদেশিদের সিংহভাগ বিনিয়োগ গুটিকয় শেয়ারে সীমাবদ্ধ। নিরীক্ষিত আর্থিক প্রতিবেদনে এবং প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসন এবং স্বচ্ছতা বাড়ানো গেলে এ বিনিয়োগ অনেক বাড়বে বলে মনে করেন আবু আহমেদ।
ডিএসইর ২৩৮ ব্রোকারেজ হাউসের মধ্যে ৪-৫টি বিদেশিদের পোর্টফোলিও ব্যবস্থাপনা করে। এর উল্লেখযোগ্য হলো লংকাবাংলা, ব্র্যাক ইপিএল, সিটি ব্রোকারেজ। ব্রোকারেজ হাউসগুলোর শীর্ষ কর্মকর্তারা জানান, গত এক বছরে তালিকাভুক্ত কোম্পানিগুলোর মুনাফায় গড় প্রবৃদ্ধি ছিল প্রায় ১৬ শতাংশ। এছাড়া দেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ৭ শতাংশের ওপরে। তাছাড়া এখান থেকে মুনাফা সহজে নিয়ে যাওয়া যায়। এ কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগে আসছে।
ব্র্যাক ইপিএল নামক ব্রোকারেজ হাউসের সিইও শরীফ এমএ রহমান মনে করেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিদেশি বিনিয়োগ বাড়লেও তা সার্ক এবং এশিয়ার প্যাসিফিক অঞ্চলের দেশগুলোর তুলনায় কম। প্রতিবেশী ভারত তো বটেই, এমনকি পাকিস্তানের তুলনায়ও কম। তিনি বলেন, পাকিস্তানে দাঙ্গা-হামলা নিত্য ব্যাপার। তারপরও দেশের শেয়ারবাজারের দৈনিক লেনদেনের ৪০ শতাংশের ওপরে থাকে বিদেশিদের। অথচ এখানে তা ৮ শতাংশ। কিছুদিন আগেও যা ছিল ২-৩ শতাংশ। এর কারণ, আমরা বিনিয়োগ করার মতো তাদের ভালো শেয়ার দিতে পারছি না। ভালো ও বড় কোম্পানির উদ্যোক্তারা শেয়ারবাজারে আসতে চান না। যে ক’টি ভালো কোম্পানি শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত আছে, সেগুলোর বাজার মূল্যও অনেক বেশি।
তারপরও বৈশ্বিক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতার কারণে উন্নত বিশ্বের অনেক সম্পদ ব্যবস্থাপক কোম্পানি ভালো মুনাফা করতে পারছে না। তারা তাদের ফান্ডের একটা বড় অংশ ইমার্জিং শেয়ারবাজারে এবং কিছু অংশ ফ্রন্টিয়ার বাজারে নিয়ে যাচ্ছে। ফ্রন্টিয়ার বাজারের ছিটেফোঁটা বিনিয়োগই আমরা পাচ্ছি বলে মনে করেন এ কর্মকর্তা।
সংশ্লিষ্টরা বলেন, দেশের শেয়ারবাজারকে এখনও ব্র্যান্ডিং করা হচ্ছে না। প্রাতিষ্ঠানিক সুশাসনের অভাব ও আর্থিক ক্ষেত্রে অস্বচ্ছতার অভিযোগের কারণে বিদেশিরা বিনিয়োগ করতে চান না। এ সীমাবদ্ধতা দূর করতে পারলে দেশের শেয়ারবাজারে বিদেশি বিনিয়োগ বর্তমানের তুলনায় বহুগুণ বৃদ্ধি পাবে।