‘বিনিয়োগকারীকে বুঝতে হবে কোথায় থামা উচিত’
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
ইউনাইটেড ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটির স্কুল অব বিজনেসের ডিন অধ্যাপক ড. মোহাম্মদ মূসা। ১৯৮৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক হিসেবে কর্মজীবন শুরু করেন। ১৯৯৮ সালে স্বদেশ ইনভেস্টমেন্ট নামের এক মার্চেন্ট ব্যাংকে গবেষণা পরামর্শকের দায়িত্বে ছিলেন। তিনি ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের স্বতন্ত্র পরিচালক হিসেবেও কাজ করেছেন। শেয়ারবাজারের সাম্প্রতিক পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলেছেন একটি দৈনিকের সঙ্গে।
:শেয়ারবাজারের বর্তমান অবস্থা নিয়ে আপনার পর্যবেক্ষণ কী?
ড. মূসা : সাম্প্রতিক সময়ে শেয়ারবাজারের সব সূচকে ইতিবাচক ধারা দেখা যাচ্ছে। মোট কথা সব ভালো। তবে এ কথাও মনে রাখতে হবে ‘সব ভালো’ সময় সময় ভালো থাকে না। বাজার ঊর্ধ্বমুখী হলে অনেকে না বুঝে খারাপ শেয়ার কিনে বিপাকে পড়েন। এ থেকে সতর্ক থাকা প্রয়োজন।
:বাজারে গতি আসার কারণ কী?
ড. মূসা : মানুষ শেয়ারবাজারের ভবিষ্যৎ নিয়ে আশাবাদী। তারা আশা করছেন, এখন বিনিয়োগ করে লাভ হবে। এক্ষেত্রে প্রভাবকের ভূমিকা রেখেছেন কৌশলী বিনিয়োগকারীরা। গত বছরের শুরুতে যখন শেয়ারদর অনেক কম ছিল, তখন অনেকে শেয়ার কিনেছেন। বিদেশিদের বিনিয়োগ বেড়েছে। এসব প্রবণতা মানুষকে আকৃষ্ট করেছে। এ অবস্থায় বিনিয়োগে তেমন ঝুঁকি নেই। তাদের কথা শুনে কেউ কেউ বিনিয়োগ করে ভালো ফলও পেয়েছেন। তা দেখে অন্যরা এসেছেন। তাছাড়া ব্যাংক সুদের হার ব্যাপক কমায় শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ বেড়েছে।
:ডিএসইতে দৈনিক লেনদেন এখন দেড় হাজার কোটি টাকা। তবে এতে প্রাতিষ্ঠানিক বিনিয়োগ ১০ শতাংশের বেশি নয়। লেনদেনের এ ধারা কি টেকসই হবে?
ড. মূসা : ছোট বাজারে এমনটাই হয়। আমরা জানি, ২০০৯-১০ সালে ব্যাংকগুলো সবচেয়ে বেশি বিনিয়োগ করত। আমানতকারীদের স্বার্থে তাদের বিনিয়োগ নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। মার্চেন্ট ব্যাংকগুলো ২০০৯-১০ সালে মূলধনের বড় অংশ মার্জিন ঋণ দিয়ে আটকে আছে। ফলে তারাও বিনিয়োগ করতে পারছে না। এক্ষেত্রে মিউচুয়াল ফান্ডগুলোর ভালো ভূমিকা রাখার সুযোগ ছিল। এখানেও চিত্র হতাশাজনক। একমাত্র বিদেশি বিনিয়োগ আগের বছরগুলোর তুলনায় যথেষ্ট বেড়েছে। আর থাকে সাধারণ বিনিয়োগকারী। তারা দেখছেন, শেয়ারদর ও লেনদেন বাড়ছে। যারা এর আগে লোকসান দিয়ে দূরে ছিলেন, তাদের কেউ কেউ ফিরছেন। নতুনরাও আসছেন। সবাই এখন কম-বেশি মুনাফা করছেন। এটাই এ ধরনের বাজারের চিত্র। বাজার যখন ভালো হয়, সাধারণ বিনিয়োগকারীরা তখন আসবেন। আবার যখন শেয়ারদর কমতে থাকবে তখন তারাই হুড়মুড় করে বিক্রি করে টাকা তুলে নেবেন। তখন লেনদেন কমবে।
:বিএসইসির দাবি, আইন-কানুন করেছে বলেই বাজারের প্রতি মানুষের আস্থা ফিরেছে। আপনিও কি তাই মনে করেন?
ড. মূসা : নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির দাবি আংশিক সত্য। বর্তমান কমিশন যে আইন করেছে, তার বেশিরভাগই দুই-তিন বছর আগে। কেবল এ কারণেই বাজার বাড়লে তা আরও আগে বাড়ত। আমি মনে করি, মানুষ যখন বুঝেছে এখন বিনিয়োগ করলে লোকসানের আশঙ্কা কম বরং লাভের সম্ভাবনা বেশি, তখনই তারা বিনিয়োগে এসেছে। তখনই বাজারে গতি এসেছে।
:সম্প্রতি বিএসইসির চেয়ারম্যান বলেছেন, বাজার সূচক ১০ হাজার পয়েন্ট ছাড়ালেও ভয়ের কিছু নেই। এ বক্তব্যকে আপনি কীভাবে দেখেন?
ড. মূসা : এটা একেবারেই অনভিপ্রেত। বাজার সূচক এখন ৫ হাজারের ঘরে। এখান থেকে ১০ হাজারে উন্নীত হওয়ার অর্থ হলো শেয়ারগুলোর দর দ্বিগুণ হওয়া। দ্বিগুণ হওয়াটা কোম্পানিগুলোর মুনাফার সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কি-না তিনি নিশ্চিত করে বলতে পারবেন না। ফলে তার এ মন্তব্য করা ঠিক হয়নি।
:স্বল্প মূলধনি কোম্পানির দর বেশি বাড়ছে। এটা কি ভালো লক্ষণ?
ড. মূসা : স্বল্প মূলধনি কোম্পানির শেয়ারদর বাড়বেই। কারণ বাজারে এর শেয়ার কম। বাজারে অনেক বিনিয়োগকারী আছেন, যারা একাই এ ধরনের একাধিক কোম্পানির সব শেয়ার কিনে ফেলতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের মতো উচ্চ নিয়ন্ত্রিত বাজারেও ‘পেনি স্টক’-এর অস্বাভাবিক দর বাড়ে। এগুলোর ক্ষেত্রে গুজব বড় কারণ। এটা একেবারে বন্ধ করা যাবে না। তবে নিয়ন্ত্রক সংস্থার উচিত, যতটা সম্ভব নজরদারিতে রাখা। অবশ্য এখন যেসব শেয়ারের দর বাড়ছে, তার সবটাই খারাপ নয়। আমি একটি উৎপাদনশীল কোম্পানির কথা জানি, যার মুনাফা গত তিন বছরে গড়ে ৩০ শতাংশ হারে বেড়েছে। এর শেয়ারদর বাড়তেই পারে। অবশ্য কিছু শেয়ারের অস্বাভাবিক বৃদ্ধিও হচ্ছে। এগুলোর পেছনে কারসাজিকারকদের হাত থাকতে পারে।
:দর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে আগের মতো মূল্য সংবেদনশীল তথ্য ফাঁস হওয়ার খবরও মিলছে…
ড. মূসা : হতে পারে। তবে তা ধরা সহজ নয়। এটাও সব দেশে হয়। শেয়ারবাজারে সব সময় কোনো না কোনো কোম্পানির বিষয়ে কিছু গুজব থাকে। তার কিছুটা সত্য হয়। অনেকটাই ভুয়া বলে প্রমাণ হয়। এক্ষেত্রে সাধারণ বিনিয়োগকারীদের সতর্ক থাকা ভালো। গুজবে কান দিয়ে শেয়ার কিনলে লোকসানের আশঙ্কা বেশি থাকে।
:বাজারের চলমান উত্থানকে দীর্ঘমেয়াদে ধরে রাখতে কি করা উচিত?
ড. মূসা : কোনো বাজারই সব সময় বাড়তে পারে না। আজকের উত্থান এক সময় থামবেই। এ বিষয়ে বোধশক্তি অধিকাংশ বিনিয়োগকারীর মধ্যে আসা প্রয়োজন। যে কোম্পানির শেয়ারের দর ২০ টাকা থেকে ৫০ টাকা হলো, তার মুনাফা ওই দরের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ না হলে ওই শেয়ারদর আবারও ২০ টাকায় নেমে আসবে। এর নিচেও নামতে পারে। এখন যারা বিনিয়োগ করছেন, তাদের কোথায় থামতে হবে, তা বুঝতে হবে। এই বোঝার ক্ষমতা যত বেশি মানুষের হবে তখন কোনো বাজারের উত্থান হলেও তার পতনও সহনীয় হবে।