চা উৎপাদন ও রপ্তানিতে গুরুত্ব দিতে হবে
- অর্থ ও বাণিজ্য ডেস্ক
চা মৌসুমী অঞ্চলের পার্বত্য ও উচ্চ ভূমির ফসল। এক প্রকার চিরহরিত বৃক্ষের পাতা শুকিয়ে চা প্রস্তুত করা হয়। পানির পরেই চা বিশ্বের সর্বাধিক ব্যবহূত পানীয়। প্রস্তুত করার প্রক্রিয়া অনুসারে চা-কে পাঁচটি শ্রেণিতে ভাগ করা যায় যেমন-কালো চা, সবুজ চা, ইষ্টক চা, উলং বা ওলোং চা এবং প্যারাগুয়ে চা। চা বর্তমানে বিশ্বে সবচেয়ে জনপ্রিয় পানীয়। চা গাছ এক জাদুকরী বৃক্ষ যা কচিপাতার নির্যাস সারা বিশ্বের মানুষকে মুগ্ধতায় ভরিয়ে রেখেছে। ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায়, চীনা দার্শনিক কনফুসিয়াসের সময় অথবা খ্রিষ্টপূর্ব ৫৫০ শতাব্দীতে ব্যবহার শুরু হয় চায়ের। ৭৯৩ সালে চীনে চায়ের উপর কর ধার্য করা হয়েছিল। ৯ম শতাব্দীতে চীন থেকে জাপানে চা পৌঁছালেও জাপানিরা ১২০৬ সালে এর চাষ শুরু করে। চীনারা আরও দাবি করে যে খ্রিষ্টপূর্ব পাঁচ হাজার বছর আগে সম্রাট শেন নাং চায়ের আবিষ্কার করেন।
বিশ্বে শীর্ষ চা উৎপাদনকারী ও রপ্তানিকারক দেশগুলো হচ্ছে শ্রীলঙ্কা, চীন, কেনিয়া, ভারত, সংযুক্ত আরব আমিরাত, জার্মানী, পোল্যান্ড, যুক্তরাজ্য, ইন্দোনেশিয়া ও ভিয়েতমান। চা রপ্তানিতে শীর্ষস্থানে অবস্থান করছে শ্রীলঙ্কা। চা শ্রীলঙ্কার অন্যতম রপ্তানি পণ্য যা জিডিপিতে ২ শতাংশ অবদান রাখে। শ্রীলঙ্কা ১৮৪৭ সাল থেকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে চা রপ্তানি করে আসছে। শ্রীলঙ্কায় প্রতি বছর ৩২৭,৫০০ মেট্রিক টন চা উত্পাদন হয় যার মধ্যে ৩১৮,৩২৯ মেট্রিক টন রপ্তানি করা হয়। যার মূল্য ১.৪৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। বিশ্বের চায়ের ৬ দশমিক ৩ শতাংশ উত্পাদন হয় শ্রীলঙ্কায়। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম চা রপ্তানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। চীন ১৮৮০ সাল থেকে চা রপ্তানি করে আসছে। দেশটি প্রতি বছর প্রায় ১৬৪০,৩১০ মে. টন চা উৎপাদন করে যার মধ্যে রপ্তানি করে ২৯৯,৭৮৯ মেঃ টন। চা রপ্তানিতে তৃতীয় অবস্থানে আছে ভারত। দেশটি প্রতি বছর ৯৬৬,৭৩৩ মেট্রিক টন চা উৎপাদন করে যার মধ্যে ২০৩,২০৭ মেঃ টন রপ্তানি করে। ১৯৮০ সালের শুরু থেকে ভিয়েতনামে চা উত্পাদন হয়ে আসছে। পণ্যটির উত্পাদন বৃদ্ধির পর থেকে দেশটি ইউরোপ ও আফ্রিকায় বাণিজ্য সম্প্রসারণ করেছে। ভিয়েতনামে বিভিন্ন জাতের চা উত্পাদন হয়। বিশ্বের চায়ের ৪ শতাংশ উত্পাদন হয় ভিয়েতনামে। কেনিয়া সম্প্রতি চা উত্পাদনে নতুনত্ব, উন্নয়ন ও গবেষণার জন্য জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। এখন দেশটিতে নতুন চায়ের বৈচিত্র্য বাড়ছে। যা চা প্রেমিকদের জন্য বেশি উপভোগ্য। বিশ্বের চায়ের ৮ শতাংশ উত্পাদন হয়ে থাকে কেনিয়াতে।
নব্বইয়ের দশকে চা রপ্তানিকারক দেশ হিসাবে বিশ্বে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল পঞ্চম। দেশীয় চায়ের গুণগত মান ভালো থাকায় বিদেশি ক্রেতাদের কাছে চায়ের চাহিদা ছিল বেশি। তখন এ দেশের রপ্তানি পণ্যের তালিকায়ও উপরের দিকেই ছিল চা। চলতি মৌসুমে দেশে চা উত্পাদনে সর্বকালের রেকর্ড ছাড়িয়ে ৮০ মিলিয়ন কেজি উত্পাদন হয়েছে। গত মৌসুমে ৬৭ দশমিক ৩২ মিলিয়ন কেজি চা উত্পাদন করে রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছিল। এবার শুধু সে রেকর্ডই অতিক্রম হয়নি তা এবার দেশের চা শিল্পের ১৬২ বছরের ইতিহাসে সর্বোচ্চ উৎপাদন হয়েছে। এর কয়েক বছর পর দেশে চায়ের উৎপাদন গত পাঁচ বছর ধরে কমছে ব্যাপক হারে। দেশে গত পাঁচ বছরে চায়ের উৎপাদন বেড়েছে ৪৫ লাখ টন। একই সময়ে দেশে চায়ের চাহিদা বেড়েছে ৮৮ লাখ টন। অর্থাৎ উৎপাদন দ্বিগুণ হারে দেশে চায়ের চাহিদা বাড়ছে। সে কারণেই পাঁচ বছরের ব্যবধানে চায়ের রপ্তানি ৮০ লাখ কেজি থেকে কমে দাঁড়িয়েছে ১৫ লাখ কেজিতে। দেশীয় চাহিদা বাড়ার কারণেই চায়ের রপ্তানি কমে যাচ্ছে।
মৌলভীবাজারে ৯০টি, হবিগঞ্জে ২৩টি, চট্টগ্রামে ২২টি, সিলেটে ১৯টি, পঞ্চগড়ে সাতটি এবং রাঙ্গামাটি ও ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় একটি করে চা বাগান আছে। আবার বিদেশ থেকে আমদানি করা হয় ১৬ মিলিয়ন কেজি। বাংলাদেশে এ চা শিল্পের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন প্রায় দেড় লাখ শ্রমিক। চা বোর্ড সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, ২০০৫ সালে দেশে চা উত্পাদন হয় ৬ কোটি ১ লাখ ৪০ হাজার কেজি। কিন্তু ২০০৬ সালে উত্পাদন ৫ কোটি ৩৪ লাখ ৭০ হাজার কেজিতে নেমে আসে। পরবর্তী বছর থেকে উত্পাদন ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। ২০১৫ সালে বাগানগুলোতে ৬ কোটি ৭৩ লাখ ৮০ হাজার কেজি চা উত্পাদন করে অতীতের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে।
দেশে রেকর্ড পরিমাণ চা উৎপাদন হলেও রপ্তানির ক্ষেত্রে নির্ভর করতে হচ্ছে অপেক্ষাকৃত নিম্নমানের চায়ের উপর, যার সিংহভাগের ক্রেতা আবার পাকিস্তান। মুষ্টিমেয় কয়েকটি প্রতিষ্ঠান দেশে মানসম্পন্ন চা রপ্তানি করলেও তা উল্লেখ করার মতো নয়। জানা যায়, বাগানমালিকরা হেক্টর প্রতি চা উত্পাদন বাড়ালেও ভালো মানের চা উত্পাদনে পিছিয়ে আছে। এ কারণে দেশে ভালো মানের চায়ের চাহিদা মেটাতে আমদানির উপর নির্ভর করতে হচ্ছে।
দেশীয় চা শিল্পে যে সংকট পড়েছে তা আমাদের জাতীয় অর্থনীতিসহ এ শিল্প সংশ্লিষ্ট সবার জন্যই উদ্বেগজনক। চা বোর্ড ও সরকারকে চা শিল্প নিয়ে পরিকল্পিত উদ্যোগের পাশাপাশি চা গবেষণা প্রতিষ্ঠানকে শক্তিশালী করতেও নজর দিতে হবে।