- মোস্তাফিজুর রহমান
ঈদ-পরবর্তী পাঁচ ছয়দিন ঢাকার যে চেহারা দেখা যায়, তা নিঃসন্দেহে সবারই কাম্য। রাস্তায় কোনো যানজট নেই, যানবাহনের বিকট শব্দ নেই, বাতাসে ধোঁয়া-ধুলা নেই, রাস্তাভর্তি গিজগিজ করা মানুষ নেই। বাসস্টপেজে গিয়ে দাঁড়াতেই বাসে সিট পাওয়া যায়। অন্য সময় যে গন্তব্যে পৌঁছতে ২ ঘণ্টা সময় লাগে, তা ১৫ মিনিটে পৌঁছানো যায়; তাতে সবচেয়ে বেশি যে উপকার হয় তা হলো, জীবনের সবচেয়ে মূল্যবান জিনিস সময়ের অপচয় হয় না, পরিকল্পনামাফিক সব কাজ নির্বিঘ্নে করা যায়।
কিন্তু বরাবরই এ চেহারা বেশি দিন থাকে না। কয়েক দিনের মধ্যেই ঢাকা আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ে। রাস্তা-ঘাট, অফিস-আদালত, উঁচু-নিচু বিল্ডিং, মধ্যম আর নিম্ন আয়ের মানুষের বস্তির মতো ঘরবাড়ি, শহরের অলি-গলি বৈধ-অবৈধ নানা শ্রেণীপেশার মানুষে কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে ওঠে। দিন দশেকের মধ্যেই শহরটাকে একটা চলন্ত ডাস্টবিনে পরিণত করে। অফিস শুরুর আগে ও অফিস শেষে মানুষ উদভ্রান্তের মতো সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে ছুটতে থাকে অথচ তার মূল্যবান সময় প্রচণ্ড যানজটে থমকে যায়। শুধু যানজট নয়, আরো সমস্যা আছে, যা বলতে শুরু করলে এ নিবন্ধ আর শেষ হবে না।
এ শহরে আমাদের এমন যাপিত জীবন কারো কাম্য নয়। এ নিয়ে খুব বেশি মাথা না ঘামালেও প্রতি পদে পদে আমরা এর প্রতিকার খুঁজি। এ দুঃসহ যন্ত্রণাদায়ক জীবন থেকে পরিত্রাণ চাই। পরিত্রাণ পাওয়া যে সম্ভব, তা ঈদ-পরবর্তী ঢাকার চেহারা দিয়ে প্রমাণিত। প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা। ধীরে ধীরে ঢাকাকে ঢেলে সাজাতে হবে। তাই বলে কেউ ভাববেন না, আমি ড্যাপ নিয়ে নতুন করে আলোচনা করতে বসেছি। ড্যাপ ছিল ভুলে ভরা। যুগ যুগ ধরে বসবাস করা মানুষের বসতবাড়িকে ড্যাপে দেখানো হয় জলাধার, রাস্তা অথবা খেলার মাঠ হিসেবে। এত পরিকল্পিত কাজে এমন বড় মাপের ভুল লজ্জাজনক। যদিও ড্যাপ পর্যালোচনা কমিটির আহ্বায়ক অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী ২০১৪ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ড্যাপের ভুল সংশোধন করে ২০১৫ সালের মধ্যে সবার কাছে গ্রহণযোগ্য ড্যাপ প্রণয়নের কথা বলেছেন।
প্রয়োজনে নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিসের মতো শহরের পরিকল্পনাবিদদের দিয়ে পরিকল্পনা করাতে হবে। আর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে ১০০ বছর মেয়াদে। আমাদের এখনই ভাবতে হবে ঠিক ১০০ বছর পর বাংলাদেশের চেহারা কেমন দেখতে চাই। আমার বিশ্বাস, এমন একটি পরিকল্পনা করে যথাযথভাবে এগোতে পারলে সত্যিই সে স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখতে পাব, যেমনটা আমরা স্বপ্ন দেখি।
ইতিপূর্বে পরিকল্পিত ড্যাপ নিয়ে নয়, আমি বলতে চাইছি অন্য একটি পরিকল্পনার কথা। যে পরিকল্পনা হবে ড্যাপের আদলেই, তবে ড্যাপের চেয়ে আরো বৃহত্, আরো বিস্তৃত, সময়সাপেক্ষ ও সুসংগঠিত। পরিকল্পিত ড্যাপ ছিল শুধু ঢাকার ডিটেইলড এরিয়া প্ল্যান। আমি বলতে চাইছি ‘ড্যাপ ফর বাংলাদেশ’-এর কথা। এখনই উপযুক্ত সময় ‘ড্যাপ ফর বাংলাদেশ’ নামক একটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা তৈরির, যা শুধু অবকাঠামোগত নয়, নয় নেহাতই নগর পরিকল্পনা। এ পরিকল্পনা হবে আমাদের জীবনযাপনের সঙ্গে সম্পর্কিত সব সূচকের সুষম প্রাপ্তির কথা বিবেচনা করে। এ পরিকল্পনা হবে আমাদের দৈনন্দিন চলাচল, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, নিরাপত্তা, কর্মসংস্থান, অধিকারের মতো সব সূচক বিবেচনায় নিয়ে।
ঈদের সময় ঢাকা ফাঁকা হয়ে যাওয়ার মূল কারণ, মানুষ নিজ নিজ বাড়িতে চলে যায়। রাজধানীর লাখ লাখ মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়াই দেশের অবকাঠামোগত বিশেষ কোনো পরিবর্তন কিন্তু হয় না, যা হয় তা হলো, পরিবারের মানুষগুলো তাদের অভিভাবক, আপনজনকে কিছু সময়ের জন্য ফিরে পায়। ভেবে দেখুনতো, এ কাজটা যদি স্থায়ীভাবে করা যায়, তাহলে কেমন হয়! আপাতদৃষ্টিতে অসম্ভব বলে মনে হলেও এমন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা খুবই সম্ভব।
আমাদের দেশটাও একটা ছোট্ট ঘরের মতো। প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সঙ্গে তুলনা করলে তার একটা প্রদেশের সমান। অথচ আমাদেরও একটা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে সবকিছু আছে। এমনকি কোনো কোনো মেয়াদে তাদের চেয়ে তুলনামূলক বেশি মন্ত্রণালয়ও থাকে। কাজেই আমাদের বলতে গেলে বাধ্য হয়েই পরিকল্পনা করতে হবে। নইলে সামনের দিনে ভয়াবহ পরিণতির সম্মুখীন হতে হবে, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ক্রমবর্ধমান জনগোষ্ঠী, তার বিপরীতে স্বল্প সম্পদ আর কর্মসংস্থানের সুষম বণ্টন করতে ছোট ঘরটা সাজানোর মতো হিমশিম খেতে হবে। কাজেই পরিকল্পনা করতেই হবে, এটা এখনকার জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। সে পরিকল্পনা ১০০ কিংবা ২০০ বছরের জন্য নয়, করতে হবে ভবিষত্ বাংলাদেশের জন্য। স্বল্প সম্পদের এ দেশে ১ টাকা ক্ষতিও অনেক বড় ক্ষতি। ভেবে দেখুন, একটা ২০ তলা বিল্ডিং করলে তা ৩০ বছর পরই ভেঙে ফেলা যায় না। সেটা সরকার করুক কিংবা বেসরকারি উদ্যোগে হোক। ক্ষতি সবসময় ক্ষতিই। সেটা সরকারের হোক বা অন্য কারো; সম্পদ কিন্তু নষ্ট হচ্ছে দেশেরই।
পরিকল্পনা কেমন হবে আর তড়িঘড়ি করে কারো সম্পদ নষ্ট না করে কীভাবে আগামী ৫০ কী ১০০ বছর পর স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখতে পাব, তার বিক্ষিপ্ত ভাবনাগুলো আমি তুলে ধরছি। ঠিক জ্যামিতিক কোনো পরিকল্পনা নয়, বলা যায় তত্ত্বীয় পরিকল্পনা।
ঢাকা শহরকে সব কাজের কেন্দ্রবিন্দু না করে সেটা সারা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। ঢাকাকে বিকেন্দ্রীকরণ করে বিভাগীয় শহরকে সরকারি কাজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা দিলে ঢাকার ওপর অনেকখানি চাপ কমবে। ব্যাংক, বীমাসহ এ জাতীয় আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সদর দফতর বিভাগীয় শহরে সরিয়ে দিতে হবে। অনেকেই হয়তো ভাবছেন, তাহলে প্রতিষ্ঠানগুলো আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে পারে। না, তা হবে না। কেননা তার আগে বিভাগীয় ও জেলা শহরকে সর্বোচ্চ নাগরিক সুবিধার আওতাই আনতে হবে।
দেশের সব জেলা, উপজেলা ও বিভাগীয় শহরের হাসপাতালে ব্যাপক পরিবর্তন আনতে হবে। আরো বেশিসংখ্যক ডাক্তার নিয়োগ দিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, স্বাস্থ্য আর শিক্ষা খাতে যত বেশি বিনিয়োগ করা হবে, দেশের জনসাধারণ তত শারীরিক ও মানসিকভাবে সুস্থ থাকবে, কর্মতত্পরতা বাড়বে। জেলা, উপজেলা পর্যায়ে সর্বোচ্চ চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত হলে মানুষ চিকিৎসার জন্য দৌড়ঝাঁপ করে ঢাকায় আসবে না।
যত দ্রুত সম্ভব দেশের সব বিমানবন্দর আরো আধুনিক করে গড়ে তুলতে হবে। পর্যায়ক্রমে সব বিমানবন্দর থেকে আন্তর্জাতিক ফ্লাইট চালুর ব্যবস্থা করতে হবে।
ঢাকায় অবস্থিত সব বিশ্ববিদ্যালয় গোটা দেশে ছড়িয়ে দিতে হবে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে নির্দিষ্ট সময় বেঁধে দিয়ে নির্দেশ দিতে হবে জেলা শহরের উপকণ্ঠে মনোরম পরিবেশে স্থানান্তরিত হতে। নিশ্চিত করতে হবে, গোটা দেশে নিজ নিজ জেলার জনসংখ্যার বিপরীতে কাঙ্ক্ষিত সংখ্যক বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা হচ্ছে কিনা। বিশ্ববিদ্যালয় হতে হলে প্রতিষ্ঠানগুলোকে সবচেয়ে বেশি ব্যয় করতে হবে গবেষণা খাতে।
তৈরি পোশাক খাতকে দেশের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিল্পের মর্যাদা দিয়ে এর শ্রমিকদের সব অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নির্দিষ্ট সময় দিয়ে ঢাকা শহরের সব গার্মেন্ট শহরের সম্পূর্ণ বাইরে কোনো জেলা শহরের উপকণ্ঠে নিয়ে যেতে হবে। গার্মেন্টের কাছাকাছি বিমানবন্দর থাকতে হবে। বিদেশী বায়াররা ওই বিমানবন্দর ব্যবহার করে পণ্য দেখতে আসবে। এদিকে মফস্বল অঞ্চল হওয়ায় অপেক্ষাকৃত কম খরচে শ্রমিকরা বাসা ভাড়া পাবেন। মালিকপক্ষেরও উত্পাদন ব্যয় কমে আসবে। ইচ্ছামতো যেমন তেমন বাড়ি ভাড়া করে গার্মেন্ট করা যাবে না। গার্মেন্টের বিল্ডিং হবে কেবল গার্মেন্ট হিসেবেই। সব দুর্ঘটনা, দুর্যোগ মোকাবেলার পর্যাপ্ত ব্যবস্থা করতে হবে। ভবন নির্মাণের সময় দুর্যোগ মোকাবেলায় ফায়ার সার্ভিসের ক্ষমতা জেনে নিতে হবে। গার্মেন্ট এরিয়ায় সুসজ্জিত অতি আধুনিক ফায়ার সার্ভিস থাকতে হবে।
প্রতিটি বিভাগীয়, জেলা, উপজেলা শহরে আলাদাভাবে প্রতি ইঞ্চি জায়গার বাস্তবসম্মত ডিটেইল এরিয়া প্ল্যান করতে হবে। ১০০ বছর পর আমাদের কেমন রাস্তা লাগতে পারে, সেটা অনুমান করে রাস্তার জায়গা ছাড়তে হবে। নতুন পরিকল্পনা বাস্তবায়নের জন্য জোর-জবরদস্তি করা যাবে না। ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠানের সামর্থ্য অনুযায়ী পরিকল্পনা বাস্তবায়নে সময় দিতে হবে। সহজ শর্তে দীর্ঘমেয়াদি সরকারি ঋণ দিতে হবে। কঠোরভাবে নিশ্চিত করতে হবে, নতুন সব স্থাপনা নতুন পরিকল্পনার আওতায় হচ্ছে।
বিল্ডার্স কোম্পানি ইচ্ছামতো জলাধার, আবাদি জমি ভরাট করে প্লট বিক্রি করতে পারবে না। সারা দেশের কথা বিবেচনা করে দেশের কোথায় কোথায় নতুন শহর হতে পারে, তার বিজ্ঞানসম্মত গবেষণার ভিত্তিতে বিল্ডার্স কোম্পানিকে ভবন নির্মাণের ক্লিয়ারেন্স দিতে হবে এবং যথাযথভাবে নিশ্চিত করতে হবে, সেসব স্থাপনা পরিকল্পনামাফিক হচ্ছে।
ঢাকা শহরের মানুষ যখন সারা দেশে সমানভাবে ছড়িয়ে পড়বে, তখন সব বেসরকারি প্রতিষ্ঠান আপনা থেকেই রাজধানী ছেড়ে গোটা দেশে মানুষের পিছে পিছে ছুটতে থাকবে। আমি শতভাগ নিশ্চিত, গোটা দেশ একযোগে এগিয়ে যাবে।
জন্ম নিয়ন্ত্রণে আরো সক্রিয় ভূমিকা নিতে হবে। মনে রাখা দরকার, সব নাগরীকের যথাযথ স্বাভাবিক ও কারিগরি শিক্ষা দিতে না পারলে জনগণ সম্পদ না হয়ে বোঝায় পরিণত হবে। তার জন্য জন্ম নিয়ন্ত্রন পরিকল্পনা মাফিক হওয়া অতীব জরুরী। প্রতিটি সবজি বাজারে পর্যায়ক্রমে আধুনিক মাননিয়ন্ত্রিত সবজি প্রক্রিয়াজাত বা প্যাকেটজাতের ব্যবস্থা করতে হবে। তারা নামমাত্র মূল্যে কৃষক বা পাইকারকে সবজি প্যাকেটজাত কিংবা বস্তাবন্দি করতে সহযোগিতা করবে। এদিকে মানুষ সারা দেশে ছড়িয়ে পড়াই প্রাত্যহিক খাদ্য বা সবজি হাতের নাগালে পাবে। তাতে কৃষকের সবজি নষ্ট হবে না, ভোক্তাও তাজা সবজি ও ফল খেতে পারবে। মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হবে।
সব শহরে আধুনিক পরিবেশবান্ধব বর্জ্য শোধনাগার থাকতে হবে। শহরের পয়ঃনিষ্কাশন, বিদ্যুত্, গ্যাস, ইন্টারনেট, মেট্রোরেল ব্যবস্থা হবে সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনার আলোকে। প্রয়োজনে নিউইয়র্ক, লন্ডন, প্যারিসের মতো শহরের পরিকল্পনাবিদদের দিয়ে পরিকল্পনা করাতে হবে। আর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে ১০০ বছর মেয়াদে। আমাদের এখনই ভাবতে হবে ঠিক ১০০ বছর পর বাংলাদেশের চেহারা কেমন দেখতে চাই। আমার বিশ্বাস, এমন একটি পরিকল্পনা করে যথাযথভাবে এগোতে পারলে সত্যিই সে স্বপ্নের বাংলাদেশ দেখতে পাব, যেমনটা আমরা স্বপ্ন দেখি।